শুক্রবার ২৯ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

ঘনাদার ঠেক, টেনিদার রক, মজার বোকামি, মজানোর পাগলামি কিংবা উদ্ভট অদ্ভুতুড়ে ক্যাবলামির দুনিয়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে এখন একটা জুয়ার ঠেকে আমরা। কিতবরা অক্ষক্রীড়া করছে। হস্তিনাপুরের রাজসভার দ্যূততক্রীড়া নয়, মহামান্য রাজকীয় ব্যসন নয়, নিতান্ত প্রান্তিক মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণের জুয়া। কেউ বাজি রাখছে সম্পদ, রাজ্য, স্ত্রী, সম্মান, তো কেউ নিজেকেই। কেউ রাজা থেকে ভিক্ষুক হচ্ছে। কেউ অল্পবিত্ত থেকে নিঃস্ব। খেলা চলছে।

তবু, এই গল্প তার, যে বঞ্চিত হয়ে বেঁচে গিয়েছে। সব হারিয়ে ফিরে পেয়েছে নিজেকে।

না না, এ গল্প ধর্মবিজয়ের নয়।
রাজা যান যুদ্ধে কিংবা দিগ্বিজয়ে। সঙ্গে চলে মন্ত্রী-অমাত্য-চতুরঙ্গ সেনা। প্রতিবেশীকে জব্দ করেন। পাশের পাড়ায় শৌর্য স্থাপন করেন। দূরের পাড়ায় তাঁর নীতি বদলায়। মাঠে নামেন। অসি ঘোরান। বেশ যুদ্ধ হয় খানিক। তারপর শত্রু হেরে যায়। কর্ণের মতো যখন তার রথের চাকা ডুবে যাচ্ছে, তখন রথ থেকে নেমে এসে রাজা একটানে তার ডুবন্ত চাকা তুলে এনে বলবেন, এই তো, কোনও ভয় নেই। ঘাবড়াও মত্। নত হও। নত হও। বোসো। বোসো। ওই ভাবে নয়। আরও ঝোঁকো। ব্যস। এবার কান ধরো। পারফেক্ট। শোনো, তুমি বেঁচে গেলে। আমার নামে জয়ধ্বনি দাও। দাও, দাও। দে বলছি। এবার শোন্। আমি তোর জীবন দিলাম। তুই প্রতি বছর কর দিবি। বত্স, তোমার রাজ্যে আমার লোভ নাই। খাজনাটা যথাসময়ে জমা করে দেবে আর রোজ আমার নাম স্মরণ করবে। আমি তোমাদের ফিরেও দেখব না। আজ থেকে তোমার রাজ্য আমার করদ রাজ্য। মনে রেখো, আমাকে দেখতে মানুষের মতো লাগলেও আমি ঈশ্বরের প্রতিভূ। মনুসংহিতা খুলে দেখো, পেয়ে যাবে। অতয়েব, পালিয়ে বাঁচার পথ নেই। এই যে ‘ট্রিটি’ হল, এটার সারাংশ ভালো করে পাথরে কী তামার পাতে লিখে ঐ মন্দিরটার গায়ে টাঙিয়ে দেবে। মনে থাকে যেন। আমার মহামাত্র আসবে ঐ অভিলেখ খতিয়ে দেখতে।

এই হল ধর্মবিজয়।

কিন্তু এ গল্প রাজা-গজা, মন্ত্রী-সান্ত্রীর নয়। তাঁরা মানুষ নন, দেবতা।
এ গল্প হতভাগ্য মানুষের। অবশেন্দ্রিয় বিপথগামী মানুষের।

এই গল্প অমানুষ থেকে ঋষি হয়ে ওঠার।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩০: গিরীশচন্দ্রের মা সারদা

এই গল্পের লোকটা নেহাত ক্যাবলা বোধহয়। তার একটা সুস্থ জীবন আছে, সংসার, একনিষ্ঠা স্ত্রী আর হিতাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়-পরিজন আছে। তবুও সে ঠেকে যায়। ঠকে যায়। তবুও ঠেকে শেখে না। কেন?
তাকে যেন কী এক অমোঘ আকর্ষণ টেনে নিয়ে যায়, পাশার ঘুঁটিগুলো ওলট-পালটে খেয়ে খেয়ে নিশির ডাক ডাকে। এবার জিতবই জিতব এই ভাবতে ভাবতে পুঁজি শেষ। এবার ধার করে খেলতে হয়। সেই ধারের টাকাও ফুরিয়ে যায়। এ ভাবে ধার বাড়ে। তবু সে জেতার আশা ছাড়ে না।
ক্যাবলামি?
অক্ষক্রীড়ক বলতেই পারে, “আমি দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ”… সুদিন কাছে এসো, হাত ধরো।

কিন্তু সকলেই একে একে হাত ছাড়ে। বন্ধু, আত্মীয়, স্ত্রী, আরও সকলেই।
এখন তাকে দেখলে লোক দরজা বন্ধ করে দেয়, পথ বদলায়, পাওনাদাররা টুঁটি টিপে ধরে। কিন্তু ওই অমোঘ আকর্ষণকে অতিক্রম করে ওঠা যে দুষ্কর। অক্ষের ঘুঁটি যেন চিতার কাঠের মতো ডেকে চলে। আশ্চর্য, ওই অলীক লোভ তাকে মুক্তি দেয় না। অথচ সে উপলব্ধি করে, তার এই বন্ধনজর্জর আসক্তি মর্মে মর্মে তাকে গ্রাস করেছে।

মনে পড়ে যায়,
“অথবা খেলায় সব হাতগুলো হারবার
পরেও খেলেছি এক দান,
বুঝিনি কিসের এত টান।
কখনো চটি জামা ছেড়ে রেখে,
রাস্তায় এসে দাঁড়া”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬০: নতুন পথে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৩: সুন্দরবনের এক অনন্য প্রাণীসম্পদ গাড়োল

তবুও সে কোন্ উপায়ে যেন মুক্তি পেয়ে যায়। উপনিষদে ব্যাখ্যাত মোক্ষ কি এটিই? আসক্তি ও ইন্দ্রিয়সুখের করাল বন্ধন থেকে শ্রেয়ঃকে নিঃশেষে লাভের যে অনন্ত রহস্য তা কি সাকার হয়ে ওঠে? রত্নাকর থেকে বাল্মীকি কিংবা অকৃতী মনুষ্যাধম থেকে উত্তীর্ণ ক্রান্তপ্রজ্ঞ ঋষি হয়ে ওঠার পথে মায়াকাজল মুছে দিব্যদর্শন অর্জনের শক্তি, প্রেরণা আসে কোন্ মায়াবীর যাদুমন্ত্রে?

আরও দূর অতীতের এক বিদর্ভনগর কিংবা হস্তিনাপুর। একটা দ্যূতক্রীড়ায় সব পেয়েছির আসর, সব হারানোর দুর্দমনীয় লোভ আর জীবনকে অনায়াসে ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসার ঐহিক আকাঙ্ক্ষার শেষে এই মহাভারতের অন্ধরাতের নক্ষত্রখচিত বিপুল ঊর্ধ্বলোক আর জ্যোতির্ময় শোক একমাত্র সত্য হয়ে প্রোজ্জ্বল হয়ে থাকে।

এরপরেই মঞ্চ অন্ধকার হয়ে আসবে। বেজে উঠবে আড়বাঁশি আর হয়তো বা সারঙ্গী কিংবা সন্তুরের সুর। কোনও মরমী কবি দরদী কণ্ঠে গেয়ে উঠবেন “মন রে কৃষিকাজ জানো না, এমন মানবজমিন রইল পতিত…”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৭: পলায়নপর পঞ্চপাণ্ডব-ভীমসেনের গতিময়তায় কোন মহাভারতীয় দিগদর্শন?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৫: রাণুর মধ্যে মাধুরী

ওহে, ওঠো, জাগো, “প্রাপ্য বরান্ নিবোধত”… তখন হয়ত সুদূর অতীতের কোনও সমাজবিরোধী আত্মপ্রবঞ্চক চোর চালচুলো হারিয়ে ফেলা জুয়াড়ির মধ্য থেকে কাঁদন-বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে জেগে উঠছেন এক অনন্তপ্রজ্ঞ ঋষি, যেমন করে যুগসঞ্চিত জাড্য ভেঙে পাষাণগুহার কক্ষে নির্ঝর ঝর্ণা জাগে, জাগে অমানিশার বুকে তারকাদল, মেঘদলে বজ্রনাদ, অজ্ঞানের ঊর্ধ্বে প্রদীপ্ত জ্ঞানাগ্নি, স্থাবর-জঙ্গমের বুকে মহাছন্দের বিপুল ঐকতান, তেমনই অমানুষ থেকে মনুষ্যত্বের পরপারে এসে সেই ঋষি জানবেন, জানাবেন কিমাশ্চর্যম্ “অক্ষৈর্মা দীব্যঃ কৃষিমিত্ কৃষস্ব বিত্তে রমস্ব বহু মন্যমানঃ”… চাষ করো, সেখানেই তোমার শান্তি, সুখ, বিত্ত, সম্মান। পাশার ছকে ধাবমান অশান্ত কাঠের ঘুঁটিগুলির তাণ্ডব প্রলয়নৃত্য জীবনজুড়ে। তারা বুঝি সর্বশক্তিমান, অজ্ঞেয়। মানুষের সাধ্য কি তাকে বশে আনে!

তাই, ওই মানবজমিনে ফসল ফলাও। সেখানেই তোমার শক্তি, মুক্তি।
ক্যাবলাদের কখনও কখনও হাল চষা ছাড়া আর কোনও সদুপদেশ পাওয়ার থাকে না, মনে হয় মাতুল শকুনি আর যুধিষ্ঠিরের প্রিয় জুয়াখেলা তার তুলনায় অনেক উচ্চমার্গীয়, তখন ঋগ্বেদের অক্ষসূক্তের সেই প্রাক্তন জুয়াড়ির ওই দিব্য অনুভব কি চাষের মাঠেই মারা পড়ে?

ঋণ
ঋগ্বেদের অক্ষসূক্ত, অনুপম রায়ের গান
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content