বৃহস্পতিবার ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


রুক্ষতা। ছবি: প্রতীকী। সৌজন্যে: সত্রাগ্নি।

একটা ছোট অফিসঘর টপকে তারপর বিনয়কান্তির শোবার ঘর। সে ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। দরজার ফাঁক থেকে হালকা আলো দেখা যাচ্ছে। স্বর্ণময়ীর অসুস্থতা বাড়ার পর থেকে বিনয়কান্তি এ ঘরে একা শুতেন। ঘরের সামনের অফিসঘরে ভূষণ থাকতো। অফিস ঘরের সোফাতে ভূষণের জন্যে সুন্দর করে বিছানার ব্যবস্থা থাকত। স্বর্ণময়ী এখন লিফটের পাশের ঘরে চলে গিয়েছেন। তার ঘরে এখন ২৪ ঘণ্টা নার্স থাকে। দিনে একবার করে ডাক্তার দেখে যায়।
আলতো করে দরজা ঠেলে সুরঙ্গমা ঘরে ঢুকলেন। বিনয় কান্তি বিছানায় আধশোয়া। খাটের পাশে বেড সাইড ল্যাম্পের হালকা আলো, পিছনে দেয়ালজুড়ে বিনয় কান্তি ছায়া।
—আপনি ডেকেছেন বাবা?
—হ্যাঁ, সেজবৌমা বসো।
—এত রাতে আপনি ঘুমোননি? কাল সকালে কথা বলতাম।
—কখনও কখনও দুশ্চিন্তাও ক্লান্ত করে। তখন ঘুম এসে যায়। তবে কিছু কিছু দুশ্চিন্তায় ঘুম আসতে চায় না। আমি জানি তুমি বলবে যে, আমার এই বয়সে দুশ্চিন্তা করা ঠিক নয়। নিয়ম করে আমায় দুশ্চিন্তা কমানোর ওষুধ খেতে হয়। তোমার শাশুড়ি মা আমার চেয়েও বেশি দুশ্চিন্তায় ভোগেন।
—জানি বাবা। আমি চেষ্টা করি। এত কর্মঠ মানুষ ছিলেন। কিন্তু এখন শয্যাশায়ী হয়ে পড়ার পর থেকে সব সময় হয়তো মন মেজাজ ভালো থাকে না। আর মাঝেমধ্যে পরিস্থিতির এমন ঘটে যায় যে ইচ্ছে থাকলেও
—আমি এই বিষয়েই তোমায় ডেকে পাঠিয়েছি।
—বাবা আপনি?
—হ্যাঁ মা, তোমার শাশুড়ি মায়ের আপত্তির কথা আমি সব শুনেছি। আসলে বসুন্ধরা ভিলার অনেক চাপা জটিলতা আছে মা। অমুর কাছে হয়তো তুমি কিছু কিছু শুনেছ।
—আমাকে মা বলেছেন। বড় ঠাম্মি কিছু কিছু বলে গেছেন। কিছু বিয়ে তো ভবিতব্য বাবা। এত কেউ ইচ্ছে করলেও বদলাতে পারে না।
—স্বর্ণ এত বুদ্ধিমতী এত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতো। অথচ নিজের সংসারের ব্যাপারে সময় সময়ে ও বড় দিশেহারা হয়ে পড়ে। তফাৎটা আমি বুঝতে পারি মা বেঁচে থাকা আর না থাকাটা স্বর্ণর ওপর একটা ভীষণ প্রভাব ফেলেছে। মার চলে যাওয়াটা আমার কাছেও একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা। কিন্তু আমি তো নিজেকে সামলে নিয়েছি। নিজেকে বুঝিয়েছি যে মা তো চিরকাল থাকবেন না। স্বর্ণ বোধহয় এখনও সেই সহজ সত্যিটা ঠিক ঠিক করে বুঝতে পারেনি। এ ধরনের সময়ে মাকে জিজ্ঞেস করত, কি বলবো, কি করবো? মা যা বলতেন সেটাই করতো। কখনও দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করতো না মা কেন সে সিদ্ধান্ত নিলেন।
—আসলে কীরা তো আমাদের উপর নির্ভর করছে।
—করবেই তো। আধুনিক সময়ে ওরা মনে করেছে যে একে অপরের থেকে দূরে থাকাটা উচিত, তাই থাকছে। তাই বলে রোসিন বা শ্যাননের সঙ্গে আমাদের তো আর ডিভোর্স হয়নি। তারা তো এই বসুন্ধরা ভিলারই এক্সটেনশন। তাদের বিয়ে বা এনগেজমেন্ট সেরিমনি তো আমাদেরই অনুষ্ঠান।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৫২: বোর্ড মিটিংয়ে প্রণয়ের ভূমিকা ছিল সৈনিকের মতো

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

কথাটা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো সুরঙ্গমাকে ছুঁয়ে গেল। বসুন্ধরা ভিলায় আরও একজন ঠিক এই উপলব্ধির কথাই বলেন এ ভাবেই বলেন। ঈশ্বরের পরম আশীর্বাদে তিনি সুরঙ্গমার স্বামী সাহিত্যিক অমলকান্তি।
—ফুল ঠাকুরপো ছোটবেলায় রোসিন আর শ্যাননকে, আমাদের সম্পর্কগুলো বাংলায় শিখিয়েছিল। দাদু ঠাম্মি সেজমা সেজকা ছোটকা ঠাকুরঘর দুর্গাদালান, ওরা অনর্গল ইংরেজি কথা বলে কিন্তু তার মধ্যে এই বাংলা শব্দগুলোও বলে। কীরা সেই অনুভূতিগুলোকে মর্যাদা দেওয়ার জন্যই তো চার্চের বিয়ের পর বাঙালি মতে বিয়ে দিতে চাইছে। সেখানে তো আমাদের গিয়ে দাঁড়ানো উচিত।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৯: আবার পুরী ভ্রমণ

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৬: যুগান্তরেও সম্মানিতা হন সীতা, তাঁর বনবাস গমনের সিদ্ধান্তে কী তার কোনও প্রভাব আছে?

কথাগুলো বিনয়কান্তিকে বলার সময় সুরঙ্গমার মনের মধ্যে একটা ঝড় চলছিল। এই কথাগুলো বলে কি সে বিনয়কান্তির মতো একজন দেবতুল্য মানুষকে ঠকাচ্ছে না। রোজিন-এর বিয়ে তো এক মাস পরে আর স্যানেনের রিং সেরিমনিও একমাস পরেই ছিল। যে ভয়ংকর কলঙ্ককে আড়াল করার জন্য তড়িঘড়ি এনগেজমেন্ট সেরিমনি আগে আনা হল, সেটা যে কিছুতেই বিনয়কান্তিকে বলা যাবে না।
—তোমরা যাবার ব্যবস্থা করো।
—মা?
—আমি স্বর্ণকে সব বুঝিয়ে বলব। অমু যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু শুনলাম ওর কাজ আছে ও যেতে পারবে না।
—মুমু থাকবে। ও অনেকবার কাজে-কর্মে বিদেশ গেছে-টেছে ।
—হ্যাঁ, তুমি মনে করে দুই দিদি ভাইদের জন্য মায়ের কাছ থেকে আমাদের আশীর্বাদী উপহার নিয়ে যেও। আসলে বিচ্ছেদ ব্যাপারটা স্বর্ণ একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু রোসিন বা শ্যানন যখন হল, তখন থেকেই তোমাদের শাশুড়ি মা তাদের বিয়ের গয়না আলাদা করে রেখেছেন। আমি স্বর্ণকে বুঝিয়ে বলব সে নিশ্চয়ই রাজি হবে। আমার কথার অন্যথা স্বর্ণ কোনওদিন করিনি। আজও করবে না।
—বেশ এবার আমি আসি। আপনি একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন বাবা।
—দুশ্চিন্তা দূর হলো এ বার আমার নিশ্চিন্তে ঘুম আসবে।
সুরঙ্গমার কিন্তু সে রাতে ঘুম হয়নি। খালি মনে হয়েছে সে তার দেবতুল্য শাশুড়ি এবং শ্বশুরমশাইকে ঠকাচ্ছে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৮: শান্তা দেবী— এক মহীয়সী!

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

ভোরবেলা চোখ খুলে অমলকান্তি বুঝতে পারলেন যে সুরঙ্গমা সারারাত ঘুমোয়নি।
—কাল রাতে তো সমস্যা মিটে গেল।
—কোথায় মিটলো? আসল সমস্যার কথা তো তাঁদের কাউকেই বলা হয়নি। আমার খালি মনে হচ্ছে ওঁদের মত মানুষকে আমি বোধহয় ঠকাচ্ছি।
—তোমার মনকে জিজ্ঞেস করো তুমি যেটা করছ সেটা কেন করছ? তাহলেই স্পষ্ট উত্তর পেয়ে যাবে। আর কোনও দোটানা থাকবে না। বাবুকে যখন বসুন্ধরা ভিলার ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে বাবা ছাড়িয়ে আনলেন – তখন সেটা বসুন্ধরা ভিলার কথা ভেবেই করেছিলেন। বাবুর ভবিষ্যতের জন্য করেছিলেন। এই পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য করেছিলেন। অথচ বাবু চিরকাল মনে করে বসুন্ধরা ভিলা এবং বাবা তার জীবনের একটা সর্বনাশ ঘটিয়ে দিয়েছেন। তারকবাবুর ওপর তার রাগ বাবার ওপরে রাগ। বসুন্ধরা ভিলার স্ট্যাটাসের ওপরেও তার ভয়ঙ্কর রাগ। বাবা কিন্তু কোনদিন নাতির কাছে কোনও ক্ল্যারিফিকেশন দেননি।কারণ বাবা জানেন আজ না হলেও দশ বা বিশ বছর বাদে শ্রীমান সৌরভ সেনগুপ্ত নিজেই সব বুঝতে পারবে।
আচমকা ঝনঝন করে ফোনটা বেজে উঠতে চমকে উঠলো সুরঙ্গমা। এত ভোরবেলায় ফোন । কীরা নয়তো? ওর ওখানে তো এখন অনেক রাত। সব ঠিকঠাক আছে তো? শাশুড়ির স্বর্ণময়ীর মতো সুরঙ্গমাকেও জড়িয়ে ফেলছে আশঙ্কা।—চলবে।

আশঙ্কার অস্ত্রে শান। চিত্রশিল্প সৌজন্য: প্রচেতা।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content