গঙ্গাসাগরে কপিলমুনির আশ্রম। ছবি: লেখক।
সুন্দরবনের পশ্চিমপ্রান্তে প্রাচীন ও অধুনা অবলুপ্ত আদিগঙ্গা (বর্তমানে ভাগীরথী নদী) এবং বঙ্গোপসাগরের সঙ্গমস্থলে সাগরদ্বীপে প্রতি বছর মকর সংক্রান্তিতে প্রায় পুরো ভারতবর্ষ যেন হাজির হয়ে যায় গঙ্গাসাগর মেলা উপলক্ষে। প্রবল শীতের কামড়কে উপেক্ষা করে সংক্রান্তির ভোরে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী কপিলমুনির আশ্রমকে সাক্ষী রেখে ডুব দেন সাগরের জলে। কুম্ভ মেলার পরে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই গঙ্গাসাগর মেলাকে নিয়ে তাই সুন্দরবনবাসী তথা বঙ্গবাসীর গর্বের শেষ নেই। গঙ্গাসাগরের কপিলমুনির আশ্রম কেন ও কীভাবে গড়ে উঠল, কবেই বা গড়ে উঠল তা নিয়ে রয়েছে নানা মিথ।
তবে পুরাণের গল্পগাথাকে সরিয়ে রেখে ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাবো প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাচীন অনার্য কৌম জাতির বসবাস ছিল। মহাভারতেও দেখি, এই অঞ্চলে অনার্যদের বাস ছিল। তখন তাদের বলা হত ‘ম্লেচ্ছ’। দিগ্বিজয় উপলক্ষ্যে ভীম নিম্নবঙ্গে (রসাতলে) এসে এই ম্লেচ্ছদের জয় করেছিলেন। এই অনার্য জনগোষ্ঠী দেবতাজ্ঞানে পুজো করত প্রকৃতিকে। নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, পশু-পাখি, গাছ-পালা ছিল তাদের আরাধ্য। কপিলমুনিই সম্ভবত প্রথম আর্য যিনি অনার্য অধ্যুষিত নিম্নবঙ্গে বা রসাতলে এসেছিলেন। অনার্যদের অশিক্ষা, দৈন্য, দারিদ্র্য তাঁকে মনে হয় পীড়িত করেছিল। আর তাই তিনি এখানে আশ্রম স্থাপন করে তাদের শিক্ষাদানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩১: সুন্দরবনের ঐতিহ্য গঙ্গাসাগরমেলা ও কপিল মুনির আশ্রম
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
অনার্যদের মধ্যে ক্রমশ তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন মহর্ষি কপিল। আশ্রম ঘিরে বাড়তে থাকে তাঁর অনুগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এই সংবাদে শঙ্কিত সূর্যবংশীয় সগর রাজ মনে হয় ষাট হাজার সেনা দিয়ে কপিলমুনির আশ্রম আক্রমণ করেন। কিন্তু মুনিবরের অনার্য অনুগামীদের কাছে পরাজিত হয় সেই বাহিনী। আর রাজ্যবিস্তার, শাসন ও শোষণ নয়, প্রজাপালনই যে রাজার একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিত তা উপলব্ধি করেন সগররাজের পঞ্চম বংশধর ভগীরথ। তিনি কপিল মুনির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং প্রজাপালনে ব্রতী হন।
গঙ্গাসাগর মেলায় মকর সংক্রান্তির ভোরে পুণ্যস্নান। ছবি: সংগৃহীত।
ভগীরথ দেখেছিলেন নিম্নবঙ্গে প্রজাদের দারিদ্র্য ও দুর্দশা। তখন কৃষিই ছিল মানুষের প্রধান জীবিকা। আর তাই তিনি জলসেচ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে দারিদ্র্য দূরীকরণের উদ্যোগ নেন। গভীর তপস্যার মধ্যে দিয়ে ভগীরথ জল-বিভাজিকা প্রযুক্তিতে নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন। তারপর তিনি ভাগীরথী খনন করিয়ে গঙ্গার স্রোতধারাকে কপিল মুনির আশ্রম পর্যন্ত নিয়ে আসেন। তাই ভগীরথকে পৌরাণিক যুগের প্রথম ‘ইঞ্জিনিয়ার’ বললে একটুও অত্যুক্তি হয় না। সেচবিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ স্যার উইলিয়াম উইলকক্স ভাগীরথী নদীর প্রবাহপথ পর্যবেক্ষণ করে জানিয়েছেন যে এটি একটি কৃত্রিম প্রবাহ। তিনি লিখেছেন—
“Every canal which went southwards, whether it has become a river like Bhagirathi, or remained a canal like Mathabhanga was originally a canal. They were lined out and dug fairly parallel to each other. They were spaced apart and placed just about the distance apart that canal should be placed.”
Ancient System of Irrigation in Bengal—Sir William Willcocks (1930), Page 10.
“Every canal which went southwards, whether it has become a river like Bhagirathi, or remained a canal like Mathabhanga was originally a canal. They were lined out and dug fairly parallel to each other. They were spaced apart and placed just about the distance apart that canal should be placed.”
Ancient System of Irrigation in Bengal—Sir William Willcocks (1930), Page 10.
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৮: শান্তা দেবী— এক মহীয়সী!
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৯: আবার পুরী ভ্রমণ
স্যার উইলকক্সের মতে, প্রাচীন বাংলায় সেচ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে তখনকার রাজন্যবর্গ “Overflow irrigation” চালু করেছিলেন। আর এজন্য তাঁরা প্রচুর খাল খনন করাতেন। যদিও গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের কৃষি মৌসুমী বৃষ্টির উপর নির্ভর করতে পারে কিন্তু নদীর পলিমিশ্রিত জল কৃষিজমিতে তুলে দিলে জমির উর্বরতা বাড়ে। কেবল বৃষ্টির উপর নির্ভর করে চাষ করলে জমির উর্বরতা কমে যায়। শুধু তাই-ই নয়, কেবল বর্ষার জল জমিতে ধরে রেখে চাষ করলে সেই জমা জলে মশার সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে বঙ্গদেশে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু “overflow irrigation” ম্যালেরিয়ার এই প্রকোপ অনেক কমিয়ে দেয়। এই অভিজ্ঞতা তৎকালীন অনেক ভারতীয় রাজন্যের ছিল। তাঁর মতে, ভাগীরথী ও মাথাভাঙা-সহ আরও অনেক জীবিত ও মৃত নদী হল আসলে এই উদ্দেশ্যে মনুষ্যসৃষ্ট খাল। তিনি রামায়ণে উল্লেখিত ভগীরথের মর্ত্যে গঙ্গা আনয়নের কাহিনিকে বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন—
“Today I am privileged to show you what was the system of “overflow irrigation” evolved by the rulers of ancient Bengal some 3000 years ago… Bengal with its heavy monsoon rainfall between June and October is marked out for rice cultivation. Such cultivation is possible without flood irrigation from the rivers, but, if dependent altogether on rainfall it impoverishes the soil… The genius of Bhagirath showed itself in the way he decided to mingle in the fields of standing rice, the fertilising and health-giving waters of the rivers in flood with the poor water of the monsoon rainfall……. the increase of irrigation with muddy flood water and the decrease of malaria are one and the same thing in Bengal”
Ancient System of Irrigation in Bengal—Sir William Willcocks (1930), Page 3, 4 and 9.
“Today I am privileged to show you what was the system of “overflow irrigation” evolved by the rulers of ancient Bengal some 3000 years ago… Bengal with its heavy monsoon rainfall between June and October is marked out for rice cultivation. Such cultivation is possible without flood irrigation from the rivers, but, if dependent altogether on rainfall it impoverishes the soil… The genius of Bhagirath showed itself in the way he decided to mingle in the fields of standing rice, the fertilising and health-giving waters of the rivers in flood with the poor water of the monsoon rainfall……. the increase of irrigation with muddy flood water and the decrease of malaria are one and the same thing in Bengal”
Ancient System of Irrigation in Bengal—Sir William Willcocks (1930), Page 3, 4 and 9.
শিল্পীর তুলিতে মর্ত্যে ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন। ছবি: সংগৃহীত।
মহাভারতে রয়েছে, শাঁখ বাজাতে বাজাতে ভগীরথ গঙ্গাকে পথ দেখিয়ে দ্বীপ অভিমুখে আনার সময় পথে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যখন খাবার খাচ্ছিলেন তখন পদ্মাবতীর শাঁখের শব্দ শুনে বিভ্রান্ত হয়ে গঙ্গা পূর্বদিকে পদ্মা হয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ভগীরথ শঙ্খধ্বনি করলে গঙ্গা তাঁর ভুল বুঝতে পেরে পিছিয়ে এসে পুণরায় দক্ষিণ দিকে বইতে শুরু করেন। এই কাহিনি উল্লেখ করে স্যার উইলকক্স লিখেছেন—
“Following the genius of your country, your ancient writers described the physical facts they were writing about in spiritual language, but the facts were there all the same.”
Ancient System of Irrigation in Bengal—Sir William Willcocks (1930), Page-10.
“Following the genius of your country, your ancient writers described the physical facts they were writing about in spiritual language, but the facts were there all the same.”
Ancient System of Irrigation in Bengal—Sir William Willcocks (1930), Page-10.
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৬: যুগান্তরেও সম্মানিতা হন সীতা, তাঁর বনবাস গমনের সিদ্ধান্তে কী তার কোনও প্রভাব আছে?
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৫: বলবয় থেকে বিশ্বসেরা
অর্থাৎ স্বর্গ থেকে মর্ত্যে ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন যতই পৌরাণিক গল্পগাথা হোক এই ভাগীরথী নদী সৃষ্টির বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না। আবার কপিলমুনির আশ্রম সম্বন্ধে পৌরাণিক কাহিনিতে ছাড়া অন্য কোথাও উল্লেখ বা প্রমাণ না পাওয়া গেলেও একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে তা অবশ্যই ছিল। বর্তমান সাগরদ্বীপ তথা সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চল এক অতি প্রাচীন ভূখণ্ড। ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রমাণিত এই ভূখণ্ড একাধিকবার অবনমনের কবলে পড়ে নিমজ্জিত হয়েছে, আবার নদীবাহিত পলি জমে তার উপরে নতুন ভূভাগ গঠিত হয়েছে। রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণে উল্লেখিত পাতাল বা রসাতল এবং নিম্নবঙ্গ বা গাঙ্গেয় দ্বীপসমূহ যে অভিন্ন তা নিশ্চিত করে বলা যায়। পাতালে বা রসাতলে বসবাসকারীদের পুরাণে অসুর, নাগ, রাক্ষস ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। এঁরা যে অনার্য অধিবাসী এবং বর্তমান বাগদি, কাওরা, তিয়র, রাজবংশী, পোদ-পৌন্ড্র ইত্যাদি গোষ্টী সেই অনার্যদের উত্তরপুরুষ তা সমস্ত বিশেষজ্ঞই মেনে নিয়েছেন। সেই অনার্য অধ্যুষিত অশিক্ষা ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট দ্বীপভূমিতে ২০০০ বছর আগে কপিল মুনি শিক্ষাশ্রম গড়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নতিকল্পে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তা আমাদের সবার কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণযোগ্য।
গঙ্গাসাগরে কপিলমুনির আশ্রমে মহর্ষি কপিল (মাঝে), সগর রাজা (ডানদিকে) ও দেবী গঙ্গা (বামদিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
স্মরণযোগ্য ভগীরথের মতো মহর্ষি কপিলের এক শিষ্যরাজকে যিনি প্রজাকল্যাণের জন্য ২০০ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ খাল খনন করিয়েছিলেন। গঙ্গার সেই পলিমিশ্রিত জলে উর্বর হয়েছে নিম্নবঙ্গের কৃষিক্ষেত্র, শস্যশ্যামলা হয়েছে বঙ্গভূমি, স্তিমিত হয়েছে ম্যালেরিয়ার মতো মহামারির আগ্রাসন। এমন পুণ্যকর্মের প্রতি আপামর ভারতবাসীর আবেগ, অনুরাগ ও ভক্তি থাকবে না তা কি হয়? কবে থেকে সাগর সঙ্গমে মেলা শুরু হয়েছিল তা আজ জানা যায় না, তবে গঙ্গাসাগর মেলা যে আর্য-অনার্য সংস্কৃতির এক মহামিলনক্ষেত্র তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এজন্য গঙ্গাসাগরমেলায় আজও লাখো লাখো পুণ্যার্থীর কন্ঠে শোনা যায় জয়ধ্বনি— ‘গঙ্গা মাঈকি জয়, কপিল মুনিকি জয়, ভগীরথকি জয়!”—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।>