শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

‘ধুপ জেলেছি মন্দিরে মোর
দীপ জালি নাই’—ভবা পাগলা

ধুপ আমাদের অন্তরের আত্মার ন্যায়। জন্ম থেকে মৃত্যু জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে এর রাজকীয় আবির্ভাব। ঈশ্বরের অর্ঘ্য ধূপ ব্যতীত অসম্পূর্ণ। অতি প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মীয় আচার, উপাচারে মন্দিরের ন্যায় প্রায় সকল ধর্ম স্থানে, সাধনকর্মে, নানান আচার-অনুষ্ঠানে, গৃহের সুগন্ধি হিসাবে, কীটপতঙ্গ দূরীকরণে বা কোনও কারণ ছাড়াই মন ভালো রাখতে ধুপ ব্যবহৃত হয়। ইংরেজি ‘Incense’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘incendere’ থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ হল ‘জ্বালা’।

ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে প্রাচীন মিশরে ধূপের ব্যবহার হতো। তার প্রমাণ পাওয়া যায় এল মাহাসনার মমি থেকে। সেখানে রাখা ছিল সুগন্ধি রেজিন বল, যার হয়তো পূর্বে ধূপের ন্যায় ব্যবহার ছিল। প্রাচীন ব্যাবিলন থেকে এই ধূপ ছড়িয়ে পড়ে প্রাচীন গ্রিস ও রোমে। সিন্ধু সভ্যতায় ধুপের ব্যবহার হত, পরে সনাতন ভারত অবশ্য পূর্ব এশিয়া থেকে ধূপ তৈরির কৌশল রপ্ত করে। প্রাচীন চিনে নব্যপ্রস্তর যুগ থেকেই ধূপের ব্যবহার হত। জাপান ও কোরিয়ার প্রাচীন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ধর্মের কাজে ধূপ ব্যবহার করতেন বলে কথিত। সিল্ক রুটের মাধ্যমে ভারত, চিন, নেপাল ও ভূটানের মধ্যে ধূপের ব্যবসা চলত। ইনসেন্স ট্রেড রুট বলে ধূপ ব্যবসার আলাদা পথই ছিল। তার মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, মিশর, উত্তর পূর্ব আফ্রিকা, আরব ও ভারতে ধূপের আমদানি রপ্তানি চলত।
উন্নত মানের স্বাভাবিক ধুপের জন্য কিছু সুগন্ধি গাছের কাঠ, শাখা প্রশাখা, ছাল, ফুলের পাপড়ি গুঁড়ো, কিছু গাছের সুগন্ধি অপরিহার্য তেল ও চারকোলের মিশ্রণের সাথে জারক হিসাবে সোডিয়াম নাইট্রেট ও পটাশিয়াম নাইট্রেট মেশানো হয়, আঠা হিসাবে থাকে আরবিক আঠা, অ্যাম্বার ও গাছের চটচটে জেলি। বর্তমানে ধূপের পাউডার হিসেবে ম্যাকো, জিগিত, লাহা ও ডার বিক্রি হয়। তবে স্বল্প মূল্যের ধূপে গুণমান বজায় রাখা হয় না। কাঠগুড়োঁ, চারকোল ইত্যাদির সাথে যে কোনো আঁঠা, সুগন্ধী বা জারক পদার্থ মেশানো হয়। ধূপ নানা ধরনের হতে পারে, কোনও ধূপ প্রত্যক্ষ আগুনের উপস্থিতিতে জ্বলে, আবার কোনও ধূপ প্রত্যক্ষভাবে আগুনে দাহিত হয় না বরং কোনও উত্তপ্ত পাত্রে রাখা হয় সুগন্ধ মোচনের জন্য।

ধুপ হতে পারে লম্বাকৃতি, শাঙ্কবাকৃতি, কুন্ডলীকৃত দড়ির ন্যায়, সুগন্ধী কাগজ বা আকৃতিবিহীন গুঁড়োও। ভারতে ধূপশিল্প বৃহৎ ও কুটির শিল্পের মর্যাদা পেয়েছে। এখানে প্রায় পাঁচহাজার কোম্পানি ধূপ ব্যবসার সঙ্গে সংযুক্ত। এর মধ্যে প্রায় ৫০টি কোম্পানির ধূপ বাজারে চলে প্রায় ৩০ শতাংশ। বিভিন্ন তথ্য সূত্রে পাওয়া, তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় ভারতে প্রায় দু’লাখ মহিলা কর্মী নিয়োজিত ধূপ শিল্পে। এক একজন সুদক্ষ কর্মী দিনে প্রায় ৪ হাজার ধূপকাঠি বানাতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় জানা যাচ্ছে, ধূপের ধোঁয়া পরিবেশ ও মানুষের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। ধূপের ধোঁয়া বায়ুদূষণ করে। এই ধোঁয়ার মধ্যে থাকে নানান বিষাক্ত গ্যাস যথা, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি। বদ্ধঘরে এগুলো অনেক সময় মানুষের মৃত্যুরও কারণ হয় অথবা এইগুলি ফুসফুস ও হৃদপিন্ডের সমস্যার সৃষ্টি করে।
আরও পড়ুন:

ছাত্রদরদী বিজ্ঞানী নীরজনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন জৈব-পদার্থ বিজ্ঞানের ভগীরথ

অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৬: ইতিহাসে চা

ধূপের ধোঁয়ার মধ্যে থাকে ভাসমান কণা বা এসপিএম। ২০০৮ সালে ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড মলিকিউলার এলার্জি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বাজার চলতি প্রমাণ সাইজের একটি ধূপের ধোঁয়ায় থাকে ৪৫ মিলিগ্রাম/গ্রাম এসপিএম। মিউটেশনের ‘অ্যামস পরীক্ষা’-য় দেখা গেছে এই ভাসমান কণাগুলি মানুষের শরীরে মিউটেশন বা পরিব্যক্তি ঘটাতে পারে। গবেষকরা বলছেন, ধুপের উপাদানগুলির সাথে ক্যালসিয়াম কার্বনেট মিশিয়ে দিলে এই ভাসমান কণা উৎপাদন ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

ধূপ থেকে উৎপন্ন হয় নানা উদ্বায়ী জৈব যৌগ, যেমন — বেঞ্জিন, টলুইন, ডাইলিন, অ্যালডিহাইড, ডাই ইথাইল ফ্যালেট (ডিইপি), পলি সাইক্লিক অ্যারেমেটিক হাইড্রোকার্বন (পিএএইচ) ইত্যাদি। এইগুলি সম্মিলিতভাবে বা একক ভাবে মানুষের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা ও রোগ সৃষ্টি করে। এগুলি হল হাঁপানি, ফুসফুসের ধারণক্ষমতা হ্রাস, মানবকোষ মিউটেশন যা পরবর্তী সময়ে ক্যান্সার সৃষ্টিতে সাহায্য করে, সর্দিকাশি ইত্যাদি। ভারতীয় ধূপে বেশি পরিমাণে ডিইপি থাকে যা কারসিনোজেন বা ক্যানসারের এক কারক।
আরও পড়ুন:

বরসে গা সাওন: স্মরণে উস্তাদ রাশিদ খান

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

২০০১ সালে তাইওয়ানে এক গবেষণায় উঠে আসে ধূপের বিভিন্ন উপাদান মানব শরীরে ক্ষতিকর বস্তু। তারা স্থানীয় বৌদ্ধ মন্দিরগুলিতে গবেষণা চালায় এবং উপরোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। ২০০১ সালে আমেরিকার ক্যানসার সোসাইটির অফিশিয়াল জার্নাল ‘ক্যানসার’-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, ধূপের ধোঁয়ায় মানব শরীরের শ্বাসতন্ত্রের উপরিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও ক্যানসারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। যারা সারাদিন অতিরিক্ত ধূপের ধোঁয়ায় থাকে তাদের স্কোয়ামাস আবরণী কোষে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ৮০ শতাংশ।

২০১৫ সালে সাউথ চায়না ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির একদল গবেষক ‘এনভায়রনমেন্টাল কেমিস্ট্রি লেটারস্’ জার্নালে প্রকাশ করে দীর্ঘদিন ধরে ধূপের ধোঁয়া নিলে তা আমাদের দেহের কোষ, সাইটোপ্লাজম ও জিনের ক্ষতি করে। এইগুলি প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে সাধারণ কোষকে ক্যানসার কোষে রূপান্তরিত করে। এছাড়াও উত্তর ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলেন, ধুপ থেকে হতে পারে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) ও অ্যাজমা। ২০১৯ সালে ভারতের এক স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা সংস্থা দক্ষিণ ভারতের প্রধান কিছু মন্দিরের পুরোহিতদের উপর গবেষণা করে দেখেন অধিকাংশ এই মানুষরা দিনের বেশিরভাগ সময় ধূপের ধোঁয়ায় থাকার জন্য তাদের ফুসফুস খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও হচ্ছে।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৭: কী করে তোকে বলব!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৮: শুরু হল কঠিন জীবনচর্যা

মানব স্বাস্থ্যের উপর ধূপের এই কু-প্রভাবগুলি দেখে মনে হয় মানুষ কি হাজার বছরের এই সংস্কার ত্যাগ করবে? অবশ্যই না। তবে ব্যবহার কমাতে হবে অনেকাংশে। সম্পূর্ণ জৈবপদার্থ থেকে ধূপ তৈরি হওয়া বাঞ্ছনীয়। দরজা-জানালা মুক্ত রাখা প্রয়োজন। শিশু ও যাদের অ্যালার্জি আছে তাদের ধূপের ধোঁয়া থেকে দূরে থাকাই ভালো।

ঋণ স্বীকার:
ফ্রি ইউকিপিডিয়া
ইন্টারনেট সংস্করণ
সংবাদ প্রতিদিন
ক্যানসা্ ২০০৮
এনভায়রনমেন্টাল কেমিস্ট্রি লেটার্স, ২০০৫
বিএমসি ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড মলিকিউলার অ্যালার্জি ২০০৮
জীবনবিজ্ঞান ও পরিবেশ, দশম শ্রেণি, ছায়া প্রকাশনী,
পৃষ্ঠা ১১৬, প্রকাশকাল ২০১৮।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content