শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


আমার মতো অনেকেরই সকাল শুরু হয় এক কাপ চায়ের সঙ্গে। গরম চায়ের কাপটা হাতে আসার পরই যেন আমাদের দিন শুরু হয়। শুধু কি তাই, মাথা ব্যথা করলে, কিংবা কোথাও থেকে অনেক কাজ করে ফিরলে দরকার হয় এক কাপ চায়ের। সন্ধের ঘরোয়া আড্ডায় চায়ের ভূমিকা যথেষ্ট। চা পাতা চা গাছ থেকে আমাদের রান্নাঘর কিংবা আড্ডার আসরে পৌঁছনোর পেছনে রয়েছে অনেক গল্প। আর সেই সব কিন্তু গল্প মনে হলেও সত্যি।

১৮২৩ সালে রবার্ট ব্রুস অসমের জঙ্গলে চা গাছ আবিষ্কার করেন। এর পরে ১৮৩৫ সালে সদিয়াতে প্রথম চা উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯১১ সালে বৈজ্ঞানিক ভাবে চা উৎপাদন করার জন্য টকলাইতে চা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। চা উৎপাদনের জন্য শুরু হল দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অসমে লোকাগমন। ফলে চা শ্রমিকদের এক মিশ্র সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে। ব্রিটিশ সাহেবরাই চা বাগানগুলোর পৃষ্টপোষকতা করতেন। যদিও এর ইতিসাহ খুব একটা ইতিবাচক নয়। বরং নির্মম এবং করুণ। তাই তো তাদের টুসু কিংবা ঝুমুর গানের করুণ সুরে ফুটে উঠে অতীতের সেই সব দিনগুলির ছবি। নিজেদের বাস্তুভিটে ছেড়ে এসে রীতি মতো লড়াই করতে হয়েছে পরিস্থিতির সঙ্গে।

শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনের চাবিকাঠিও ছিল ইরেজ সাহেবদের হাতে। অসাস্থ্যকর ‘কুলি লাইন’ এ চা শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা হল। এই কুলিলাইন শব্দটি বাগান কর্তৃপক্ষরা ব্যবহার করত। শ্রমিকদেরকে শুধু ২৫ বর্গফুট জায়গা ব্যবহার করার জন্য প্রদান করা হত। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য প্রতিবছর বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দীর্ঘদিন তাদের জন্য ছিল না কোনও চিকিৎসক বা হাসপতালও। ১৮৮৯ সালে ডিব্রুগড়ে বেরি হোয়াইট মেডিকেল স্কুল স্থাপিত হওয়ার পর থেকে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়।
এখানে লাবক হাসপাতালতাদের গল্পটিও বলতে হয়। প্রায় একশো বছরেরও আগে অসমের বরাক উপত্যকার দেওয়ান গ্রুপ অফ টি এসটেট-এর লাবক চা বাগানের হাসপাতালে ডাঃ রোনাল্ড রস নিজের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর কাছে যথেষ্ট রসদও ছিল না। নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই তিনি ম্যালেরিয়া রোগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আবিষ্কার করেছিলেন স্ত্রী অ্যানোফিলিস স্টিফেনসাই মশার কামড়ে মেলেরিয়া রোগ হয়। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সেই বৈজ্ঞানিকের গবেষণাগার আজও সংরক্ষিত আছে লাবকে।

ব্রিটিশরাজে চা শ্রমিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না। ছিল শুধু কাজ আর কাজ। ঝড় উঠুক কিংবা অসুখ হোক—মুখে রক্ত তুলে কাজ করে যেতে হবে। ১৯১২ সালে বর্তমানে বন্ধ হয়ে যাওয়া খরিল চা বাগানের সরকারী ম্যানেজার রেজিনাল্ড ইউলিয়ামস রিড গঙ্গাধর নামক একজন শ্রমিকের মেয়ের উপর পাশবিক স্পৃহা পুরণ করতে চায়। মেয়েটি তাতে রাজি না হলে ম্যানেজার তার বাবা এবং ভাই নেপালকে গুলি করে মেরে ফেলে। আর মেয়ে হিরাও শেষ রক্ষা পেল না। কাছাড় জেলায় একটি ছেলের মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়। এক ইউরোপিও সাহেবকে সেলুট না করার অপরাধে। ইছাবিল চা বাগানের ম্যানেজার ডবসন সাহেবের অত্যাচারের কথা আমরা একাধিক বইপত্রে পাই। তার ভয় এবং অত্যাচারে এলাকার শ্রমিকরা সন্ত্রস্ত থাকত, ইংরেজ সাহেবদের মতবিরোধ করলেই তেজপুরের জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হত।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৫: বরাক পাড়ে জঙ্গিয়ার গীত

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩০: সুন্দরবনে লৌকিক দেবতা ছাওয়াল পীর ও রাখাল ঠাকুর

নিজেদের শেকড় থেকে ছিন্নমূল এই সাধারণ মানুষদের সঙ্গে বাইরের জগতের কোনও সম্পর্কই ছিল না। ফলে তারা সম্পূর্ণ ভাবে ইংরেজ বাগান কর্তৃপক্ষের দ্বারা শোষিত হয়েছে। কিন্তু মানুষ চিরদিন অন্যায় সহ্য করতে পরে না। তাই কখনও কখনও তারাও করেছে প্রতিবাদ, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশও নিয়েছে। গজরাম কুর্মি, রাধু মুন্ডা, গবিন তাঁতি, বিষ্ণু শুকু মাঝি এবং আরও অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

১৯১৫ সালে চা বাগানের স্বাধীনতা সংগ্রামী ক্রিস্টিসন মুন্ডাকে ফুলবাড়ি চা বাগানে সর্বজন সম্মুখে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৯২১ সালে মালতী নামের মহিলাকে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য পুলিশ গুলি করে। অসমের প্রথম মহিলা শহিদ স্বাধীনতা সংগ্রামী মালতি দেবী। ইতিহাসের পাতায় এদের নাম থাকলেও এই নামগুলি আমাদের খুব পরিচিত নয়। কিন্তু তাদের অবদান যে যথেষ্ট সে কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। প্রচলিত টুসু গানে তাই পাওয়া যায়—
“লাগলে লাগুক দ্বন্দ
আমরা বেটি হয়ে করব যুদ্ধ
হাতা লিবো সড়কি লিবো
টুসু মা কে গড় লাগিব।”
আরও পড়ুন:

বরসে গা সাওন: স্মরণে উস্তাদ রাশিদ খান

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গে সকাল ৮টা থেকে কাজে যোগ দেন। পুরুষেরা তাদের কাজ শেষ করে বাড়ি যেতে পারেন। মহিলাদের কাজ প্রধানত চা পাতা তোলা। দুপুর বারোটার পর চা গাছের পাতা ওজনের পরে মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতি হয়। তার পর আবার চা পাতা তোলা চলে বিকেল ৪টা থেকে ৪-৩০টা পর্যন্ত। আবার পাতা ওজন শেষ হলে অর্থাৎ প্রায় সন্ধে নাগাদ বাড়ি ফেরা।

এ কথা মেনে নিতে হয় যে, চা জনজাতির সমাজে পুরুষই প্রধান। বহু বিবাহ তাদের সমাজে প্রচলিত আছে আজও। তাই তো টুসু গানে আমরা পাই—
“আয় লো সতিন
পাতাই মিতিন
গাছ বিরিখের তলাতে
সতিন জ্বালা বড় জ্বালা
বাজ পড়ুক তোর মথাতে”


মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, জঙ্গলের সঙ্গে লড়াই করে, হাজার প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে চা জনজাতির মানুষ। নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে অসমে এসে তাদের আদিবাড়িতে ফিরতে পারেনি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম থেকে গিয়েছে এই অসমে। সব ক্লান্তি ভুলতে দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠল মদ, গান-বাজনা। মেয়েদের গানে পাই, “মরদ হামার বড়ই ভালো / পুরা তলব পায় গো /সাঁঝের বেলা মরদ হামার / আটেই আনার পিয়ে গো।”
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৮: শুরু হল কঠিন জীবনচর্যা

এখন অসমের চা বাগানের চেহারা কিন্তু একেবারেই অন্য রকম। শিক্ষার হার যেমন বেড়েছে তেমনি পাল্টেছে তাদের জীবনচর্যাও। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগসূত্র হওয়ায় এখন অনেকেই চা বাগানের বাইরে গিয়েও অর্থ উপার্জন করেন। মোবাইল ফোন, বাইক, টিভি আধুনিক যুগের সব কিছুই আজ পৌঁছে গিয়েছে অন্ধকার ভেদ করে। তবে সবুজের সহজ মানুষরা এখনও তেমনি সহজই রয়েছেন। আজও চা শ্রমিকদের গানে আর মাদলের তালে তালে জোনাকির আলোয় প্রতিটি সন্ধ্যা যেন উৎসবের বার্তাবহ হয়ে উঠে। দূর থেকে ভেসে আসা গানের সুর শহুরে মানুষের মনকেও আকৃষ্ট করে। শুধু কি তাই, সবুজের বুকে সূর্য যখন তার শেষ আলো ফেলে দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে যায়, তখন অসমের চা বাগানকে কোনও নব বিবাহিত সুন্দরীর থেকে কম মনে হয় না। এই নিখাদ সুন্দরের টানে অনেকই ছুটে যান অসমের চা বাগান বেড়াতে।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক।

Skip to content