রবিবার ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

চতুর দমনক সঞ্জীবকের কাছে এসে দার্শনিকের মতো বেশ রসিয়ে রাজার চাকরি করবার যে কতো অসুবিধা সেগুলোকে তুলে ধরতে শুরু করল। এমনকি এই চাকুরেদের জীবনটা যে কুকুরের থেকেও অধম সে কথা কিন্তু নানা ভাবে পঞ্চতন্ত্রের বিভিন্ন গল্পগুলোর মধ্যে আমরা পেয়েছি। অন্যের অধীনে থেকে চাকরি করার চেয়ে নিজের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করাটাই যে অধিক লাভজনক সেটা পঞ্চতন্ত্রে বার বার বলা হয়েছে।

দমনকের মতে, ভূমিতে বিছানা পেতে কোনওক্রমে শুয়ে থাকা, ব্রহ্মচর্য পালন করা আর সেইসঙ্গে অল্প খাবার-দাবার পেয়ে কাজের চাপে শরীর ক্ষ্ণীণ হয়ে যাওয়া, এ দুটোই রাজ-সেবক এবং সন্ন্যাসী এদের দু’জনেরই কেবল হয়ে থাকে। কিন্তু তফাৎ শুধু একটাই। এই কষ্ট সহ্য করে সন্ন্যাসীদের শুধু পুণ্যই সঞ্চয় হয় কিন্তু রাজকর্মচারীদের পাপ। শুধু সামান্য কটা টাকাপয়সা রোজগারের জন্য একজন রাজসেবক শীত-গ্রীষ্মের দুঃখ সহ্য করে কাজের ক্ষেত্রে ধর্মাধর্মের বিচার পর্যন্ত করে না। তাই সেবা করে শুধু পাপ সঞ্চয়ই হয় আর কিছু না। অতিশ্রমের শেষে মধুর ফলটা খেয়ে হবেটা কি যদি তার অন্তে পুণ্য না থাকে?

সঞ্জীবক সব শুনে দমনককে বললে, “অথ ভবান্‌ কিং বক্তুমনাঃ?” আপনি আসলে চাইছেনটা কী?

দমনক তখন বলল, ওহে মিত্র! রাজার সচিবদের মন্ত্রণাভেদ করাটা উচিত নয়। রাজা তাঁর সচিবদের সঙ্গে গোপনের যে পরামর্শ করেন সেটা গোপন করে রাখাটাই সচিবদের কাজ। সেই মন্ত্রণা যাতে তৃতীয় ব্যক্তি পর্যন্ত না পৌঁছয় সেইটাই আমাদের দেখতে হয়। রাজনীতি শাস্ত্রে বলে, যিনি মন্ত্রিপদে অধিষ্ঠিত থেকেও স্বামীর গুপ্তমন্ত্রণা বাইরে প্রকাশ করে দেয় বলা যেতে পারে যে তিনি বিনা অস্ত্রেই তার স্বামীকে বধ করে দিলেন। নারদ ঋষিও তাঁর রাজনীতি শাস্ত্রে এমনই বলেছেন। এইরকম মন্ত্রীদের নরকই একমাত্র গতি হয়।

কিছুক্ষণ থেমে দমনক বললে, কিন্তু ভাই সঞ্জীবক! তোমার সঙ্গে এতোদিনে স্নেহের যে বন্ধনটা গড়ে উঠেছে তার জন্যই আজ আমি বাধ্য হচ্ছি স্বামী পিঙ্গলকের মন্ত্রভেদ করতে। মনু মহারাজ স্বয়ং বলেছেন যে কাউকে বিশ্বাস করে এসে যদি কেউ মৃত্যু বরণ করে তবে তার মৃত্যুর দায় সেই বিশেষ ব্যক্তিটিকে নিতেই হবে যাকে বিশ্বাস করে সেই হতভাগ্যটি এসেছিল। সেই কারণেই আমি আজ এসেছি তোমার কাছে সিংহ পিঙ্গলকের মন্ত্রভেদ করতে, কারণ কোনটা ধর্ম আর কোনটা অধর্ম সে জ্ঞান আমার ভালোই আছে।

কিছু সময় থেমে সঞ্জীবকের প্রতিক্রিয়াকে ভালোভাবে বুঝে-নিয়ে দমনক আবার সহানুভূতির সুরে বলতে শুরু করল, ভাই সঞ্জীবক! সত্যি বলতে কি তোমার প্রতি ওই দুর্বুদ্ধি পিঙ্গলকের হাবভাব আমি খুব একটা ভালো বুঝছিতে পারছি না। উনি আজ আমাকে গোপনে ডেকে বলেছেন যে সকালেই সঞ্জীবককে মেরে সমস্ত জন্তুদের বহুদিনের আহারের একটা ব্যবস্থা করে তাদের তৃপ্ত করবো। এ-কথা শুনে আমি তখন তাঁকে ধর্মশাস্ত্রের কথা মনে করালাম—
অপি ব্রহ্মবধং কৃত্বা প্রাযশ্চিত্তেন শুধ্যতি।
তদর্হেণ বিচীর্ণেন ন কথঞ্চিৎ সুহৃদ্‌দ্রুহঃ॥ (মিত্রভেদ, ২৯৮)


সেই সিংহ পিঙ্গলককে তখন আমি সাবধান বাণী শুনিয়ে বললাম, হে রাজন্‌! ধর্মশাস্ত্র বলে, ব্রহ্মবধ করবার পরে চতুর্বিংশতি বছর ধরে নির্দিষ্ট চান্দ্রায়নাদি প্রায়শ্চিত্ত ব্রত পালন করলে তার থেকে মুক্তি মিললেও, মিত্রদ্রোহের মতন পাপের কোনও রকম শুদ্ধি নেই। তাই জঙ্গলের পশুদের আহারবৃত্তি দিয়ে তুষ্ট করবার জন্য বন্ধুকে হত্যা করাটা আপনার উচিত হবে না।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩২: যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের জীবন একটি কুকুরের থেকেও কঠিন

বারো ক্লাস ফেল ছেলের প্রায় জগৎ জয়ের কাহিনি মন ছুঁয়েছে সবার

পিঙ্গলক তখন গর্জন করে বললে, ওরে দুর্বুদ্ধি! সঞ্জীবক সামান্য একটা তৃণভোজী প্রাণী মাত্র আর আমরা সকলেই মাংসাশী, তার সঙ্গে আমাদের বৈরতা স্বাভাবিক। আমাদের মধ্যে খাদ্যখাদকের সম্পর্ক এ শত্রুতা বিধাতা স্বয়ং আমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। তাই শত্রুর প্রতি মায়া বাড়িয়ে লাভ কী? তাই সাম-দান-ভেদ-দণ্ড যেকোনও একটা উপায়ে তাকে হত্যা করলে কোনও রকম অধর্মের আশঙ্কা নেই। রাজনীতিশাস্ত্রজ্ঞরা বলেন, শত্রুকে যদি অন্য কোনও উপায়ে হত্যা করা সম্ভব না হয়, তাহলে বিজিগীষু রাজার উচিত, প্রয়োজনে সেই শত্রুর সঙ্গে নিজের কন্যাকে বিয়ে দিয়ে সেই কন্যার মাধ্যমে মধুচন্দ্রিমার রাত্রে হলেও শত্রুকে হত্যা করা। যুদ্ধের ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায় বা ভালো-মন্দ বলে কিছু হয় না। না হলে দ্রুপদের পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন কখনও ঘুমন্ত অবস্থায় দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামার হাতে মারা পড়তেন না। তাই শত্রুহত্যার ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করতে নেই।

চতুর দমনক বলল, তোমার প্রতি সিংহ পিঙ্গলকের এইরকম মনোভাবটা বুঝেই আমি ছুটে এলাম এখানে তোমাকে সাবধান করতে। আমাকে তুমি অন্তত এখন কেউ আর বিশ্বাসঘাতক বলে অপবাদ দিতে পারবে না। সমস্ত গুপ্ত মন্ত্রণা আমি তোমাকে জানিয়েছি, এবার তোমার যেটা সঠিক মনে হয় সেটা করো।

সঞ্জীবক তখন দমনকের মুখে এইরকম বজ্রকঠোর কথাবার্তা শুনে একেবারে মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা হল। কোনওক্রমে সম্বিত ফিরে পেয়ে সে অত্যন্ত উদাসীন ভাবে দার্শনিকের মতো জীবনের সমস্ত নেতিবাচক দিকগুলোকে চিন্তা করে বন্ধু দমনকের কাছে আফশোষ করে বলতে শুরু করলো—
দুর্জনগম্যা নার্যঃ প্রাযেণাস্নেহবান্‌ ভবতি রাজা।
কৃপণানুসারি চ ধনং মেঘো গিরিদুর্গবর্ষী চ॥ (ঐ, ৩০১)
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা

স্ত্রীলোক অধিকাংশ ক্ষেত্রে লম্পটেরই ভাগ্যে জোটে; সজ্জন ব্যক্তির কাছে স্ত্রীলোক মর্যাদা পেলেও ভাগ্যের এমনই পরিহাস সুসংস্কৃতা স্ত্রী অধিকাংশই তাদের কপালে জোটে না। রাজার মধ্যেও স্নেহ বলে কিছু থাকে না, অথচ রাজা মানুষকে সামন্য স্নেহ করলেই তারা জীবনপাত করে রাজাকে অনেকটা ফিরিয়ে দেন। তেমনই যার ধনসম্পত্তির প্রয়োজন তার কাছে ধন থাকে না। যিনি কৃপণ ব্যক্তি, যিনি ধনসম্পত্তি খরচ করেন না, শুধু সঞ্চয়ই করেন, তিনিই হন ধনবান। ঠিক যেমন প্রয়োজন নেই যেখানে সেই গিরিদুর্গেই মেঘ জল বর্ষণ করে, কিন্তু মরু অঞ্চলে যেখানে জলের অধিকমাত্রায় প্রয়োজন সেখানে মেঘের দেখা পাওয়া যায় না।

সত্যি কথা বলতে, যে লোক মনে করে আমি খুব রাজার কাছের লোক তার মতো বোকা দুনিয়ায় দুটো নেই; সত্যি বলতে যে ভাবে সে রাজার খুব কাছের লোক সে একটা বলদ ছাড়া আর কিছুই নয়, যার মাথাটায় শিং-টাই শুধু নেই। ভালো লোকের বরং সন্ন্যাসী হয়ে বনে চলে যাওয়া ভালো; ভিক্ষা করে না হয় নয় মোট বয়ে যেভাবে হোক তার উচিত জীবনধারণ করা; এমনকি রোগী হয়ে শুয়ে থাকাটাও ভালো কিন্তু সেবাবৃত্তি করে সম্পত্তি লাভ করাটা অসম্মান ছাড়া আর কিছুই নয়। লোকে সম্পত্তিটাই দেখে কিন্তু সেটা গড়ে তোলবার পিছনে যে অসম্মানটা সেটা দেখে না। তাই সেবাবৃত্তির মতো খারাপ কিছু হতে পারে না।

কিছুটা সময় নিয়ে সঞ্জীবক বললেন, আমি এই সিংহ পিঙ্গলকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ঠিক করিনি। পণ্ডিতেরা ঠিকই বলেন—
যযোরেব সমং বিত্তং যযোরেব সমং কুলম্।
তযোর্মৈত্রী বিবাহশ্চ ন তু পুষ্টবিপুষ্টযোঃ॥ (ঐ, ৩০৪)
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৭: তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথেই যে জন ভাসায়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৭: তীর্থদর্শন

বিবাহের সম্বন্ধ এবং বন্ধুত্ব সর্বদাই এমন দুই পরিবার বা দু’জন ব্যক্তির মধ্যে হওয়া উচিত যারা দু’জন অর্থনৈতিকভাবে, কিংবা বংশগৌরবে প্রায় একে অপরের সমতূল। বংশমর্যাদা কিংবা ধনসম্পত্তিতে অগ্রণী পরিবার বা ব্যক্তির সঙ্গে ধনহীন কিংবা বংশগৌরবহীন পরিবার বা ব্যক্তিবিশেষের বৈবাহিক সম্বন্ধ কিংবা বন্ধুত্ব কোনটাই হওয়া সমীচীন নয়। তাই বন্ধু দমনক! ভুলটা আমারই ছিল। আমি একটা সামান্য বৃষ মাত্র, যে রাজার সঙ্গে বন্ধুত্বের স্বপ্ন দেখেছিলাম। জগতে সব কিছুই সমানে সমানে হয়—মৃগকুল তাদের সজাতীয় মৃগদের সঙ্গেই থাকে, গরুরাও থাকে নিজের দলের সঙ্গেই, মূর্খ লোকেরাও দেখবেন মূর্খদের সঙ্গেই থাকে ঠিক যেমন পণ্ডিতরা থাকেন পণ্ডিতদের নিয়ে। যাঁরা মানসিকতার দিক থেকে বা চরিত্রগত দিক দিয়ে সমান কিংবা একই রকম বিপদ-আপদের মধ্যে থাকেন, বন্ধুত্ব তাঁদের মধ্যেই হয়, অন্যদের মধ্যে নয়।

সঞ্জীবক অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে বলল, তাই আমি গিয়ে যদি এখন তাকে প্রসন্ন করবারও চেষ্টা করি তবুও সে প্রসন্ন হবে না। কারণ একটাই, যে লোক কোনও বিশেষ কারণের জন্য ক্রুদ্ধ হয় সেই বিশেষ কারণ দূরীভূত হলে সে শান্ত হয়, কিন্তু যে ব্যক্তি অকারণে শত্রুতা করে কোনও মানুষের পক্ষ্যেই তাকে প্রসন্ন করা সম্ভব নয়।

সত্যি বলতে, স্বামীভক্ত, উপকারী এবং সেইসঙ্গে সদা পরোপকারে লীন সেবক যিনি কখনও অনিষ্ট চিন্তা করেন না তার সেবায় প্রভুর লাভ হোক বা ক্ষতি হোক, কিন্তু সে যদি সামান্যতমও ভুল কিছু করে বসে তবে সেই সেবককেই বিপদে পড়তে হয়। যেমন রত্ন লাভের আশায় সমুদ্রকে সেবা করা যেমন আশঙ্কাজনক, অর্থাৎ সমুদ্রে রত্ন পাওয়া যেতেও পারে আবার নাও পারে কিন্তু সামান্যতম অমনোযোগী হলেই প্রাণসংশয় অনিবার্য; তেমনই রাজার সেবাও তেমনই। রাজসেবায় পুরষ্কার মিলতেও পারে নাও মিলতে পারে, কিন্তু সামান্য বিচ্যূতি ঘটলে রাজরোষে মৃত্যু নিশ্চিত।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content