সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

টেনিদার রক আর হযবরল-র জগৎ ছাড়িয়ে আমরা অনেকদূর এসে পড়েছি। হাজার বছর ধরে অতীতের পথে হাঁটতে হাঁটতে যদি উদয়ন-বাসবদত্তার রাজপুরীতে প্রবেশ করা যায়? ওহো! রাজপুরী থাকলেও রাজা সেখানে কোথায়? রাজা রাজ্যচ্যুত। আর রানি! উদয়নের প্রাণপ্রিয় বাসবদত্তা? সে নাকি আর নেই। নেই মানে? মানে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে। ওই যে পাণ্ডবরা জতুগৃহে দগ্ধ হয়েছিল না! তেমনটাই আর কী! আর হবে না কেন! রাজা যদি কৌটিল্যের পথ পরিত্যাগ করে বীণা বাজিয়ে হাতি ধরে খালি, তাহলে রাজ্যের গুরুভার লঘু হতে কতক্ষণ? এবার বলবেন, সমুদ্রগুপ্ত-ও তো বীণা বাজাতেন মনে হয়। হ্যাঁ, তা বৈকি, তবে যুদ্ধটাও করতেন, কোমর বেঁধে দিগ্বিজয় না করলে বাপ-ঠাকুর্দার জমিদারি সূর্যাস্ত আইনে যেতে কতক্ষণ? যা করেছেন তা বেশ ভালো প্রশস্ত করেই প্রশস্তিবদ্ধ করেছেন, হরিষেণকে দিয়ে। আর উদয়ন! কী করেননি, রাজকন্যা হরণ, পালিয়ে বিয়ে, উদাসীন হয়ে রাজ্যবিমুখ সেই রাজা আরও দশটা বিয়ে পর্যন্ত করেননি। সেই একটিই মহিষী, যাকে ভালোবেসে প্রায় ভেসে গেছেন বলা চলে। একি ক্যাবলামি নয়?
রাজসুখ, রাজ্য, সম্মান, শান্তি আর বাসবদত্তাকে হারিয়ে উদয়ন নাকি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। একি রাজার মানায়? দুষ্যন্ত নাকি শকুন্তলার স্মৃতি ফিরে পেয়ে এমনটা করেছিলেন। কিন্তু… কিন্তু আছে একটা, সে কথা পরে।

উদয়ন কেঁদেছেন, মাথা ঠুকেছেন, তারপর বাসবদত্তা মরে গিয়েছে ভেবে নিজেকে খানিক সান্ত্বনা দিয়ে মগধের রাজকন্যা পদ্মাবতীকে বিয়ে করেছেন। তবে তা নাকি হওয়ার ছিলই। জ্যোতিষীরা আগে থেকেই বলে দিয়েছিল যে।

এই গল্প প্রাচীন ভারতের লোকগাথায়। আজ সন্ধ্যায় এমনটাই টিভিতে দেখলেও আশ্চর্য হওয়ার নেই। প্রেমের গল্পে এমনটাই হয়। রাজা-গজা থেকে ভিখু-পাঁচি… যে যার মতো করে সোনার কাঠি রূপার কাঠি খুঁজে পায়, পক্ষীরাজে চড়ে, এ এক যেমন খুশি সাজোর দুনিয়া, এখানে রাজপুত্র রাজকন্যাকে হারায়, ফিরে পাবে বলেই।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: যে মানুষ চেয়ে চেয়ে / ফিরিতেছি পাগল হয়ে

বারো ক্লাস ফেল ছেলের প্রায় জগৎ জয়ের কাহিনি মন ছুঁয়েছে সবার

সুতরাং উদয়ন পদ্মাবতীকে বিয়ে করেন। পিছন থেকে তাঁর প্রাজ্ঞ মন্ত্রী আর অন্তর্যামী কলকাঠি নাড়েন। তাঁরা জানেন এই বিবাহ বাসবদত্তাকে ফিরে পাওয়ার পথ। কারণ, বাসবদত্তা ততদিনে পদ্মাবতীর সখী হয়ে উঠেছেন।

ক্লাসে না উঠতে পারলে যদি ক্যাবলামি হয়, নিজের দোষে উদয়নের রাজ্য হারানোর ব্যাপারটাও তো তা-ই হবে, নাকি রাজকীয় একটা গুরুগম্ভীর নাম দেওয়া যায়? অবিমৃষ্যকারী রাজার পক্ষে বাসবদত্তা বেঁচে থাকতে তাকে নিয়ে ‘আদিখ্যেতা’ আর মরে যেতে ‘হা বাসবদত্তা’ বলে খানিক মূর্চ্ছা গিয়ে তারপর মন শক্ত করে আরেকটা বিয়ে করে ফেলা বেশ উপযুক্ত কাজ, কারণ, একটা আপাত প্রেমের গল্পের পিছনে কাজ করবে রাজশক্তির পেশীবল, সেই মগধকে আশ্রয় করেই ফিরে পেতে হবে তো হারানো রাজ্য। অতয়েব, নিজের দোষে ল্যাজে-গোবরে হয়ে বৌয়ের হাত ধরে রাজ্য পুনরুদ্ধারে পুরুষের আত্মগর্ব কোথায় যেন ধাক্কা খাচ্ছে না? এমনটা যদি সুবর্ণলতার যুগে ঘটত তাহলে? সে কথা থাক বরং। বরং দেখা যেতে পারে বাসবদত্তা কী করতে চায়। বাসবদত্তা বিচক্ষণ মন্ত্রীর প্রেরণায় ঘর ছাড়ে, উদয়নকে বাঁচাতে। তারপর সাধারণ মানুষের মতো পথে নেমে, জনতার ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে, ঘাড়ধাক্কা খেয়ে বিষণ্ণ হয়, ভাবে আমিও একদিন রাণী ছিলাম, রাস্তাঘাটে পেতাম রাজকীয় সম্মান। আর এখন?
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

তবে কি মস্ত ক্যাবলামি হয়ে গেল জীবনে?

একেই কি হঠকারিতা বলে?

বাসবদত্তার এসব ভাবার সময় ছিল না। আসলে, কিছুই ভাবার মতো কিছু ছিল না। ভাবনা থাকে মানুষের। বাসবদত্তা তখন সমাজের চোখে মৃত এক নামানুষ কেবল।
বাসবদত্তার জীবনে তখন একটাই সাধ বুঝি। সে তার প্রেমাস্পদ উদয়নকে দেখবে। এক মৃত মানুষের অজ্ঞাতবাস, একদল জানে সে নেই, একদল জানে সে আছে, তবে সে বাসবদত্তা নয়, সাধারণ কোনও প্রোষিতভর্তৃকা। এমন অবস্থায় একজন মানুষ কেবলই যেন আত্মপ্রবঞ্চনা করতে থাকে, চারপাশের স্বার্থপর মানুষের ভিড়ে কেমন যেন “লার্জার দ্যান লাইফ” হয়ে বেঁচে থাকে কেবল একবার “তাকে” দেখবে বলে? দেখা হয়ে হয়ে হয় না, তার চলে যাওয়ার শব্দ শুনে ঘুম ভাঙে অনিশ্চয় অন্ধকারে, মুখোমুখি বসিবার উত্তরাধুনিক রোম্যাণ্টিকতা তখন ছিল না।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩০: সুন্দরবনে লৌকিক দেবতা ছাওয়াল পীর ও রাখাল ঠাকুর

ক্যাবলামি?

দেখা হয় শেষ পর্যন্ত?

হতেই হয়। মহাকাব্যের নায়করা আজীবন লাঠালাঠি করে জীবনান্তে মিলিত হয়, মিলনান্তকের শর্ত মেনে। অতয়েব রাজপুত্র-রাজকন্যাদের বিরহ কাটবেই একে ক্যাবলামি বলি কোন্ সাহসে? বরং এ মঙ্গলময় পরিণতি বুঝি। তবে জীবনের খাঁজে ভাঁজে তাদের ভুল, ক্যাবলামি, হঠকারিতা, অবিমৃষ্যকারী আকস্মিকতা থাকবেই, না হলে তারা নায়ক-নায়িকাই নয়। এই ক্যাবলামি না থাকলে তারাও নিষ্কর্মা, কবিরাও বেকার। যেদিন শেষ হয় ক্যাবলামি, সেদিন গল্পের নটেগাছটাও মুড়িয়ে যায়, তারাও বড় হয়ে যায়। —চলবে।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content