রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁ দিক থেকে) কৌতলা বাপুলিরচক রাখাল ঠাকুর মন্দিরে বিগ্রহ। করঞ্জলি বেলপুকুরে রাখাল ঠাকুরের বিগ্রহ। ছবি: সংগৃহীত।

বর্তমান বাংলাদেশের হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ দাউদনগরে সৈয়দ বংশের বিশিষ্ট দরবেশ ছিলেন সৈয়দ দাউদ। তাঁর দুই পুত্র। একজনের নাম সৈয়দ মহিবুল্লাহ এবং আরেকজনের নাম সৈয়দ হাছান উল্লাহ। তাঁদের একটা বড় খেলার মাঠ ছিল। সেই মাঠে সৈয়দ মহিবুল্লাহ তাঁর বন্ধুদের নিয়ে প্রায়শই খেলতেন।
একদিন এক হিন্দু ভক্ত সৈয়দ মহিবুল্লাহের জন্য মানত করে এক ছড়া পাকা কলা ও তার গাভীর দুধ নিয়ে সেই মাঠ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন মাঠে সৈয়দ হাছান উল্লাহ খেলছিলেন। তিনি তখন শিশু বা ছাওয়াল। হিন্দু ভক্তকে দেখতে পেয়ে শিশু হাছান উল্লাহ জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার গামছায় কি বাঁধা রয়েছে। ভক্তের উত্তর শুনে সৈয়দ হাছান উল্লাহ পাকা কলা খেতে চাইলেন। কিন্তু হিন্দু ভক্তটি শিশুটিকে চিনতে না পেরে মিথ্যে বললেন যে কলাগুলি কাঁচা। শিশুটি বারবার কলা দেখতে চাইলেন, কিন্তু ভক্তটি কলা দেখালেন না এবং খেতেও দিলেন না।

তখন শিশুটি বললেন, তোমার সমস্ত পাকা কলা কাঁচা হয়ে যাবে এবং গাভীর দুধ সব জল হয়ে যাবে। ভক্তটি সৈয়দ মহিবুল্লার বাড়ি গিয়ে যখন গামছা খুলে তাকে কলাগুলি দিতে গেলেন, দেখলেন সমস্ত কলা কাঁচা এবং পাত্রে দুধের পরিবর্তে রয়েছে জল। হিন্দু ভক্তটি সৈয়দ মহিবুল্লাহকে সব কথা খুলে বললেন। তখন মহিবুল্লাহ সাহেব ভক্তটিকে বললেন যে, শিশুটিকে নিয়ে আসুন। ভক্তটি মাঠে দৌড়ে গেলেন, কিন্তু তখন সেখানে শিশুটি নেই। শিশুটি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

আসলে এই শিশুটিই ছিলেন সৈয়দ মহিবুল্লাহ ছোট ভাই হাছান উল্লাহ ওরফে সৈয়দ নাসির প্রকাশ। শিশু পীর অর্থে তাঁকে তখন থেকেই বলা হত ছাওয়াল পীর। হিন্দু ভক্তটি এরপর একদিন স্বপ্নে ওই মাঠে পুকুর খনন করার নির্দেশ পান। তখন হিন্দু ভক্তদের পরিবার ওই মাঠে একটি পুকুর খনন করেন। পুকুরে প্রচুর জল উঠে আসে। লোকে দেখে সেই পুকুরের জলে খেলা করছে প্রচুর শাল মাছ বা স্থানীয় নামে গজার মাছ। সৈয়দ মহিবুল্লাহ সাহেব তার অলৌকিক ক্ষমতা বলে মাছগুলিকে ওই পুকুরে বন্দি করেন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত ওই পুকুরে গজার মাছ রয়েছে। ওই পুকুরে কেউ মাছ ধরে না বা মাছ মারে না। পুকুরটি কয়েকশো বছরের পুরনো। পুকুরের পাড়ে একটি বহু প্রাচীন বকুল গাছ রয়েছে। এই পুকুরের মাছ মারা গেলে তা কবর দেওয়া হয়। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ পবিত্র এই পুকুরে গজার মাছ দেখতে আসেন। এই পুকুরের অদূরেই রয়েছে শিশু পীর অর্থাৎ ছাওয়াল পীরের সমাধি। শোনা যায় ছাওয়াল পীরের নির্দেশ ছিল—তাঁদের সমাধি যেন পাকা না করা হয়। ছাওয়াল পীরকে নিয়ে এ হল প্রচলিত লোককাহিনি।

বাংলাদেশের শায়েস্তাগঞ্জ দাউদনগরে ছাওয়াল পীরের সমাধিস্থলে যাওয়ার প্রবেশদ্বার (বাঁদিকে) ) ও গজার মাছের পুকুর (ডানদিকে) ছবি: সংগৃহীত।

সুন্দরবন অঞ্চলে ছাওয়াল পীর হলেন এক মিশ্র সংস্কৃতির দেবতা। এলাকা ভেদে তিনি কোথাও কোথাও শিশু পীর বা খোকা পীর নামে পরিচিত। মূলত হিন্দু প্রধান এলাকায় তিনি খোকা পীর নামে পরিচিত। ছাওয়ালপীর বা খোকা পীর শিশু রক্ষক দেবতা হিসেবে সুন্দরবনবাসীর কাছে পুজো-হাজোত পান। বার্ষিক পূজা-হাজোতের সময় উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ডালা ও হাজোত দিয়ে ছাওয়াল পীরকে শ্রদ্ধা জানায়। এই উপলক্ষে পুরুষরা রাত জেগে নেশা করে ও আনন্দ উচ্ছ্বাস করে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: যে মানুষ চেয়ে চেয়ে / ফিরিতেছি পাগল হয়ে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৭: তীর্থদর্শন

হিন্দুরা ছাবালপীর বা খোকা পীর কে বালক কৃষ্ণ বলে মনে করেন। সুন্দরবন এলাকায় যখন ষোড়শ সপ্তদশ শতকে পীরদের দ্বারা ইসলাম ধর্মের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছিল তখন হিন্দুদের বালক কৃষ্ণ মুসলমানদের ছাওয়াল পীরের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়। পুরাণের কাহিনি অনুসারে বালক কৃষ্ণ তাঁর মামা কংসের হাত থেকে নিজেকে যেমন রক্ষা করেন তেমনি কালিয়া নাগ দমন করে তাঁর রাখাল বন্ধুদের প্রাণ রক্ষা করেন। তাই বালক কৃষ্ণ তথা খোকা পীর বা ছাওয়াল পীর শিশুদের রক্ষাকর্তা হিসেবে সুন্দরবনের হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন।

কৌতলা বাপুলিরচকে রাখাল ঠাকুরের মন্দির। ছবি: সংগৃহীত।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল একসময় সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও এখন তা কমে গিয়ে ক্যানিং, বাসন্তী, গোসাবা, কুলতলি, পাথরপ্রতিমা, রায়দীঘি, মথুরাপুর, কাকদ্বীপ, নামখানা ও সাগরদ্বীপে সীমাবদ্ধ। তবে এখনও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপি, ক্যানিং মথুরাপুর, মন্দিরবাজার, ডায়মন্ড হারবার, মগরাহাট ইত্যাদি অঞ্চলে রাখাল ঠাকুরের মন্দির দেখা যায়। রাখাল ঠাকুর আসলে পৌরাণিক কৃষ্ণ। সুন্দরবন অঞ্চলে পৌরাণিক কৃষ্ণ লৌকিক দেবতা রাখাল ঠাকুরে পর্যবসিত হয়েছেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৬: রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন—মেয়েদের আলোর দিশারী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪০: ব্রণ হয়েছে? তার মানেই কি লিভার খারাপ?

এইসব অঞ্চলে গ্রামে গোচারণ ভূমিতে রাখাল বেশে তিনি পুজো পান। কোনও মন্দিরে তাঁর একক মূর্তি থাকে। আবার কোনও মন্দিরে তাঁর সাথে তাঁর সখা হিসেবে শ্রীদাম, সুবল ও সুদাম থাকে। আবার কোথাও তাঁর সাথে থাকে তাঁর ভাই বলরাম। অনেক সময় গোরুর মূর্তিও থাকে। রাখাল ঠাকুরের অধিকাংশ স্থান মাটির চালাঘর হলেও বর্তমানে বেশ কিছু থান পাকা হয়েছে। রাখাল ঠাকুরের উপাসকরা হলেন মূলত অবর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়।

করঞ্জলি বেলপুকুরে রাখাল ঠাকুরের মন্দির। ছবি: সংগৃহীত।

সুন্দরবন অঞ্চল কিছুদিন আগেও ছিল মূলত কৃষি প্রধান। মানুষের জীবন ও জীবিকা কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও শিক্ষার প্রসার এর ফলে কৃষির উপর মানুষের নির্ভরতা কমছে আর তাই কৃষি জমি ও গোচরণভূমি সংকুচিত হচ্ছে। স্বভাবতই রাখাল ঠাকুরের প্রভাব ও কমছে।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content