শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


বাংলা তথা বাঙালির জীবন ও ধর্মে মঙ্গলকাব্যের একটি স্বতন্ত্র স্থান আছে। ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ইত্যাদি এই রকম বহু মঙ্গলকাব্য বাংলাসাহিত্য, ধর্ম ও জীবনকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে। এই কাব্যগ্রন্থগুলি গবেষণা করে তৎকালীন সমাজ, ধর্ম ও ভৌগোলিক নানান তথ্য পাওয়া যায়। রাঢ়বঙ্গের নদী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে, ধর্মমঙ্গলখ্যাত পবিত্র নদী বল্লুকা সম্বন্ধে জানতে পারা গেল। বিভিন্ন জনের লেখা ধর্মমঙ্গলের প্রত্যেকটিতে বল্লুকা নদীর উল্লেখ আছে। ঘনরাম চক্রবর্তীর লেখা ‘শ্রীধর্মমঙ্গল’ এ পাওয়া যায়, “সন্ন্যাসী বল্লুকাবাসী বসি যে দুয়ারে”। বৈষ্ণবধর্ম প্রচারক রামাই পন্ডিতের ‘শূন্য পুরাণে’ ও স্মৃতিচারণায় বল্লুকা নদীর কথা বর্ণিত হয়। ‘বাড়ি মোর বল্লুকার। পুজি শ্রী নৈরাকার’।। এবং “বৈকুণ্ঠতে জীয়ে ধর্ম, বল্লুকাতে স্থিতি”। সেই সময় বল্লুকা নদীর তীরে কুলুকুলু ধ্বনির অবিরত প্রবাহে নির্জনতায় তিনি ‘শূন্যপুরাণ’ রচনা করেন। মেমারি থানার নিকটস্থ বড়োঞা গ্রামে বল্লুকা নদীর তীরে রামাই পণ্ডিতের জন্ম।
 

উৎস, মোহনা ও গতিপথউপায়

সহস্রাধিক বর্ষপ্রাচীন এই নদীর উৎপত্তিস্থল নিয়ে মতবিরোধ আছে। বর্ধমান নিয়ে কোনও কোনও গবেষকের মতে, এই নদীটি বর্ধমান জেলায় দামোদরের পুরাতন খাতে মোহনপুর, চাপাই, বোরহাট, কমলাকান্ত কালীবাড়ি ও বর্ধমানের রাজবাড়ি স্পর্শ করে নদীটি প্রবাহিত হয়েছে, পালসিট, ভৈটা, করন্দা, সাতগাছিয়ার নিকটস্থ কিছু গ্রাম ও মেমারি থানার আরও কয়েকটি গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শেষ পর্যন্ত অম্বিকা কালনার নিকটে ভাগীরথীতে মিলিত হয়েছে।

আবার বর্ধমান গবেষক যজ্ঞেশ্বর চৌধুরীর মতে, বল্লুকা নদী মেমারি থানার অন্তর্গত রুকুনপুরের কাছে বর্তমানের বেহুলা নদী থেকে উৎপত্তি হয়েছে। পরে নদীটি শ্রীধরপুর, বানেশ্বর, শ্রীরামপুর, মাদপুকুর গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত রাঙাপাড়া গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে খড়ি এবং বাঁকার মিলিত জলধারায় মিলিত হয়েছে। নদীটির আরেকটি শাখা (যদিও বর্তমানে শুষ্ক) ঝাপানতলা গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অম্বিকা কালনা যেতে বিখ্যাত জনপদ বাঘনাপাড়া গ্রামের পূর্বদিকে অবস্থিত বাঁকা ও খড়ি নদীর মিলিত জলধারায় পতিত হয়েছে। সার্ভে মানচিত্র থেকে জানা যায় উনবিংশ শতক পর্যন্ত বল্লুকা ছিল প্রবল।

বিজ্ঞানীদের মতে, সপ্তদশ শতাব্দীতে বেহুলা, বল্লুকা ইত্যাদি খাতের মধ্য দিয়েই দামোদর নদের উত্তর-পূর্বমুখী ধারাটি প্রবাহিত হতো। তাই বল্লুকা নদীর খাদ তখনও ছিল প্রবল ও নদীটি মিলিত হতো ভাগীরথীতে। পরে দামোদর তার গতিপথ পরিবর্তন করায় নদীটি গৌণ খাতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এর অধিকাংশ জায়গায় মজে গেছে এবং কিছু কিছু জায়গা শুষ্ক খালে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে অবশ্য বর্ষাকাল ব্যতীত এই নদীতে জল থাকে না। ভ্যালেনটিজন ও ভন ডেন ব্রুকের মতামত অনুসারে, দামোদর নদীর গতিপথের শেষ অংশটিই হলো আলোচ্য বল্লুকার গতিপথ। পূর্ব বর্ধমানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই নদীটির দুই প্রান্তে রয়েছে বিস্তীর্ণ চাষযোগ্য উর্বর জমি, যা পূর্বে নদীর চরই ছিল। একথা প্রমান করে যে নদী প্রবল রূপেই প্রবাহিত হতো।

আরও পড়ুন:

পরিবেশ চিন্তায় রামায়ণ ও মহাভারত

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৫: বরাক পাড়ে জঙ্গিয়ার গীত

 

নদীর গতিপথ পরিবর্তনউপায়

বর্ধমানের মেমারি থানার আমাদপুর নিবাসী বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘বাঙলা ও বাঙালী’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, একসময় দামোদর নদ বর্ধমান শহরের নিকট হতে বাঁক নিয়ে অম্বিকা কালনার নিকট ভাগীরথীতে মিলিত হয়েছে। পরে প্রবল ধারা দামোদর তার গতি পরিবর্তন করায় এটি শীর্ণকায়া বল্লুকায় পরিনত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তাও কিছু কিছু জায়গায় বুজে জমি, পুকুর ও খালে পরিণত হয়ে গেছে।
 

ধর্মমঙ্গল, বৈষ্ণব ধর্ম ও বল্লুকাউপায়

বল্লুকা অতি পবিত্র ও প্রাচীন নদী। এই নদীর পবিত্র তীরে ধর্মঠাকুরের আবির্ভাব বলে ভক্তমহলের ধারণা। তাই ঘনরাম চক্রবর্তী, রামাই পণ্ডিত, রূপরাম চক্রবর্তী, মানিক গাঙ্গুলী এবং অন্যান্য খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের সাহিত্যে এই নদীর নাম এসেছে ঘুরেফিরে। অম্বিকা কালনার কাছে অবস্থিত অতি প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ জনপদ বাঘনাপাড়া। সেখানে বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপক প্রভাব ছিল। শ্রীচৈতন্যের প্রধান পার্ষদ নিত্যানন্দের পত্নী জাহ্নবা দেবীর পালিত পুত্র রামচন্দ্র গোস্বামী (রামাই পন্ডিত) এখানে বৈষ্ণবধর্মের প্রচার করেন এবং গোস্বামী বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও শ্রীচৈতন্যের আর একজন পার্ষদ বংশীবদন চট্ট বাঘনাপাড়ায় তাঁর বসতি স্থাপন করেন এবং বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করেন।

পরবর্তী সময়ে এক শাপগ্রস্ত মুনি বাঘ্রপাদ, ব্যাঘ্র কলেবর ধারণ করে এখানে তপস্যা করেন এবং কঠিন তপস্যা শেষে তিনি শাপমুক্ত হন। জনশ্রুতি আছে এই মুনির স্মৃতিবিজড়িত গ্রাম হল বাঘনাপাড়া। অতি প্রাচীনকালে এই নদীর তীরে ঘন জঙ্গল ছিল এবং সেখানে বাঘ, ভাল্লুক ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী অবাধে বিচরণ করত। মানিক গাঙ্গুলীর ধর্মমঙ্গল থেকে আমরা জানতে পারি, প্রথমে ধর্মঠাকুর বল্লুকার তীরে উল্লুক বাহনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল গ্রন্থে পাওয়া যায় রাজা হরিশচন্দ্র এই নদীর তীরে ধর্মপূজা করেছিলেন। অন্য এক ধর্মমঙ্গল যা পন্ডিত রূপরাম চক্রবর্তী লিখেছিলেন, সেখানে বর্ণনা আছে:

‘বল্লুকা নদীর তটে পূজা করে পানিপুটে,
চারি পন্ডিত পূজে নিরঞ্জন।
ঘন পড়ে জয়ধ্বনি দূরে হৈতে শুনি,
জয় জয় সআল ভুবন’।

আবার, পন্ডিত যদুনাথের ধর্মমঙ্গল থেকে পাওয়া যায়, ধর্মপূজার আয়োজনের পূর্বে মহারাজা হরিশচন্দ্র মহারানী মদনাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন: ‘শুক্ল বসন লহ বল্লুকার জলে যাহ স্নান করি আসিয়া এখন’।
রামাই পন্ডিতের ‘শূন্যপুরানে’ চাষের কথা, বল্লুকা নদীর কথা ইত্যাদি খুব সুন্দরভাবে বর্ণিত আছে:
‘চাষ করিতে যায় ভোলানাথ বল্লুকা কূলে গো।
কোথায় আছো গৌরী দেবী দাওনা শঙ্খের ধ্বনি গো।।
আগে চলে দেব ভোলানাথ শেষে নারদ গো।
বল্লুকা কুলে আসি তারা উপনীত হলো গো।।
হাল জোড়ে হাল জোড়ে দেব ভোলানাথ গো।’
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: যে মানুষ চেয়ে চেয়ে / ফিরিতেছি পাগল হয়ে

 

বৌদ্ধ ধর্ম ও বল্লুকাউপায়

বৌদ্ধ গৌড়রাজ কান্তিদেব পালের রাজধানী ‘হরিকেল বর্ধমান’ আজকের মেমারি থানার ‘হরকলা-বড়োঞা’ এবং তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধবিহারের নাম পরিবর্তত হয়ে আজকের মেমারি থানার বোহার গ্রাম নামে পরিচিত। এখানে এশিয়ার অন্যতম এক বৃহৎ গ্রন্থাগার ছিল। এখান থেকে কিছু কিছু গ্রন্থ কলকাতা জাতীয় গ্রন্থাগারে রাখা হয়েছে এবং কক্ষটির নাম রাখা হয়েছে ‘বুহার’ শাখা। অতিপ্রাচীনকালে এই দুটি গ্রাম স্পর্শ করেই এই নদী প্রবাহিত হতো বলে কথিত আছে, যার প্রমাণ হল: বড়োঞা গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়া শুষ্ক হয়ে যাওয়া নদী খাদ। বড়োঞা গ্রামের পশ্চিমাংশে প্রায় ভঙ্গুর দুটি গম্বুজ বর্তমানে মহাদেব বা শিব নামে পূজিত হন। যত সময় পরিবর্তন হতে লাগল হিন্দুধর্মের দাপট বৃদ্ধি পেল, পরবর্তীকালে হরিকেল বর্ধমানের বৌদ্ধরাই হিন্দুদের সাথে আপোষ করে ধর্মঠাকুর প্রতিষ্ঠায় সম্মতি দেন। ‘অবশ্য ধর্মঠাকুরই বৌদ্ধ ধর্মের শেষ পরিণতি’-একথা বলেছেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৭: তীর্থদর্শন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা

 

নদীর বর্তমান পরিণতি ও তা থেকে মুক্তির উপায়

বহু পুরাতন নদী বল্লুকা সময়ের সাথে সাথে তার গৌরবময় ইতিহাস হারিয়েছে। নদী তখনই তার প্রবলতা হারায়, যখন দামোদর তার পুরনো গতিপথ পাল্টে নতুন গতিপথে চলতে থাকে। নদীতে জল কমে একটা সময় কেবলমাত্র বর্ষাতেই জল থাকতো, বর্তমানে এই নদীর অধিকাংশ জায়গা ভরাট হয়ে গিয়েছে, কিছু কিছু জায়গা লম্বা খালে পরিণত হয়েছে, কোনো কোনো স্থানে বৃহৎ পুকুর দেখা যায়। সবটুকুকে যদি পুরাতন ম্যাপ অনুসারে যোগ করি, তাই হবে বুল্লুকা নদী। ইতিহাসখ্যাত বড়োঞা গ্রামে এই নদীর গতিপথ ভরাট হয়ে গেছে, গড়ে উঠেছে বাজার। বাঘনাপাড়াতেও নদীর শুষ্ক গতিপথ লক্ষ্য করা যায়। নদীর হৃতগৌরব ফেরাতে গেলে, মজে যাওয়া নদীকে খনন করতে হবে, নদীর সাথে যুক্ত অন্যান্য উপনদীর খাতগুলিকে আবর্জনা মুক্ত করে গভীরতা প্রদান করতে হবে। একটি নদীর মৃত্যু মানেই একটি সভ্যতার ইতিহাস ও প্রাচীনত্বের মৃত্যু। নদীর সাথে সাথে নষ্ট হয় জীববৈচিত্রের। নদীর স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচাতে হবে, তবেই বাঁচবে এই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলা।

তথ্যসূত্র

বর্ধমান: ইতিহাস ও সংস্কৃতি (১ম খন্ড): যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী
রাঢ় গবেষণা কথা: সম্পাদনায় গদাধর কোঙার, প্রথম সংখ্যা
বাঙলা ও বাঙালী: শ্রী রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়
বর্ধমানের বড় মানুষ: সুধীরচন্দ্র দাঁ
বল্লুকা সভ্যতার কথা: গদাধর কোঙার
শ্রীধর্মমঙ্গল: ঘনরাম চক্রবর্তী
বর্ধমান জেলার নদনদী: ননীগোপাল দত্ত
বর্ধমানের ইতিহাস: সত্যকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়
ধর্মমঙ্গল: রূপরাম চক্রবর্তী
শূন্যপুরাণ: রামাই পন্ডিত
District Gazetteer of Burdwan: Peterson
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।
* সুনাম চট্টোপাধ্যায়, সহ-শিক্ষক, সাঁচরা হাই স্কুল, সাঁচরা, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content