বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


‘খুব লড়ি মর্দানি, ওহ তো ঝাঁসি ওয়ালি রানি থি’ না আজ ঝাঁসির রানির গল্প নিয়ে আসিনি। তবে ইতিহাসের পাতাতে তো ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈর মতো আরও অনেক বীরাঙ্গনা রয়েছেন। আজ তাঁদেরই একজনের কথা বলব। বরাকের মাটিতে তাঁর জন্ম না হলেও বরাকের ইতিহাসে, লোকগীতিতে তাঁর প্রাধান্য যথেষ্ট। এ গল্পের শুরু বর্তমান বাংলাদেশ থেকে। সুতরাং এ প্রশ্ন মনে আসতেই পারে যে, বরাকের ইতিহাসে তাঁর প্রসঙ্গ এল কি করে? এ বার আর ভনিতা না করে জঙ্গিয়ার গীতের গল্পটি শুরু করা যাক।

তখন ইংরেজের শাসন চলছে। মঙ্গল পাণ্ডের নেতৃত্বে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দেশের সৈন্যরা রুখে দাঁড়িয়েছে। বিদ্রোহ দমন করতে ইংরেজ সরকার মঙ্গল পাণ্ডেকে ফাঁসির সাজা দিল। কিন্তু এ অন্যায় না মেনে নিয়ে দেশের সিপাহীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল। সেই বিদ্রোহের আগুন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। তার আঁচ লেগেছিল অসমের বরাক উপত্যকায়ও। অতীতের সেই সময়ের কাহিনি লোকো মুখে গানের সুরে আজও জীবন্ত। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের তেমনি এক সম্পূর্ণ ঘটনা একটি গীতিকার মধ্য দিয়ে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ এক ঐতিহাসিক গীতিকা, যার নাম ‘জঙ্গিয়ার গীত’।
আমরা মৈমনসিংহ-গীতিকার কথা জানি। গোরক্ষবিজয়ের কথাও জানা। কিন্তু ‘জঙ্গিয়ার গীত’ সমগ্র বাংলায় বিশেষ ভাবে পরিচিত নয়। আসলে জঙ্গিয়ার গীত বরাকের সীমানা অতিক্রম করেনি। হয়তো যাঁরা জঙ্গিয়ার গীত গাইতেন, তাঁরা সেই গান অসমের বাইরে গিয়ে গাইতে পারেননি। আর জঙ্গিয়ার গীত বৃহত্তর বাংলা গীতিকার তালিকায় অন্তরভুক্ত হতে পারেনি। এই গীতিকায় কোনও চরিত্র বিশেষ ভাবে প্রাধান্য পায়নি। তাই এখানে কোনও চরিত্রের নামও আমরা পাই না। এখানে যে বীর যোদ্ধাদের কথা বলা হয়েছে, তাঁরা সবাই বাংলাদেশের চট্টগ্রামের। ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে তাঁরা এসে পৌঁছেছিলেন বরাক নদীর পাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে বরাক উপত্যকায় আসার পর তাদের সঙ্গে ঘটেছে একটির পর একটি এমন ঘটনা যা, স্থানীয় মানুষদের আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল বলেই সৃষ্টি হয়েছে এমন এক ঐতিহাসিক গীতিকার। এই গীতিকার শুরুতে দেব দেবী বন্দনা করা হয়েছে। স্বরসতী বন্দনার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর দোয়াও প্রার্থনা করেছেন গীতিকাররা।
পূর্বেতে বন্দনা করি পূর্বে উদয় ভানু।
যেই না দিকে উঠে ভানু ছয়াল হয় পসর।।
ওবা আল্লা দিন ঘিরিল রে।
উত্তরে বন্দিয়া গাইলাম উত্তর সিংহাসন।
আসর করিয়া বইছইন ঊনকোটি দেবগণ।।
ওবা আল্লা দিন ঘিরিল রে।।
পশ্চিমে বন্দনা করি মক্কা হিন্দুস্থান।
হিন্দু ছাড়া যাঁরা আছইন জানাইলাম আমার ও সালাম।।
দক্ষিণে বন্ধনা করি আল্লা নবী গণ।
এর শেষে জানাইলাম সালাম মা ও সরস্বতীর চরণ।
আসরে বসিয়া শেষে ডাকি গণে গণে।।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৪: বরাকপারের কথা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ

গীতিকাটির মূল বিষয়টি ১৮৫৭ সালে ১৮ নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ৩৪ নম্বর দেশীয় সিপাহী শাখার এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সেখান থেকে সেই আগুনের স্ফুলিং করিমগঞ্জ শহর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত লাতুতেও এসে পৌঁছেছিল। ১৯ নভেম্বর দেশীয় সিপাহীদের সঙ্গে লাতুতে ইংরেজ সরকারের যুদ্ধ হয়েছিল। এই গীতিকার গল্প ঐতিহাসিক এই ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করেই রয়েছে। আর এ কথাও সত্যি যে সেই, সময়ের বিভিন্ন সরকারি কাগজপত্রে এর বিবরণও পাওয়া যায়।

জঙ্গিয়ার গীতের মূলত দুটি পর্ব রয়েছে। প্রথম পর্বে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে দেশীয় সিপাহীরা কীভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ভারত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী করিমগঞ্জের লাতুতে পৌঁছে ছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে। আর দ্বিতীয় পর্বটিতে রয়েছে যুদ্ধ করতে করতে লাতু থেকে সিপাহীরা কীভাবে বদরপুর গিয়ে পৌঁছয়। সেই সঙ্গে নিজের দেশের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে তাদের যে করুণ অবস্থা হয়েছিল তার বর্ণনা পাওয়া যায়।

আসলে ইংরেজ সরকারের এক মুসলমান দেশীয় সিপাহীর পুত্রসন্তান হয়। জন্মের পর শিশুর মঙ্গল কামনায় হওয়া ‘আকিকা’ অনুষ্ঠানে বহু মানুষ নিমন্ত্রিত ছিলেন। সেই বিরাট আয়োজনকে ধূলিসাৎ করে দেয় ফতুদ্বীপের ইংরেজ সাহেব। সেই অনুষ্ঠানে তাঁর আমন্ত্রণ ছিল না বলে সেখানে গিয়ে সমস্ত খাবারে থুতু ফেলে, আমন্ত্রিতদের চাবুক মেরে সমস্ত কিছু লন্ডভন্ড করে দেন। সুবেদারের বীরাঙ্গনা পত্নী সেই খবর পেয়ে ঘোড়ায় চড়ে সাহেবের বাংলায় গিয়ে তাঁকে হত্যা করে শাস্তি দেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৭: তীর্থদর্শন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা

এই সুবেদার পত্নীর কোনও নাম আমরা গীতিকায় পাই না। সমগ্র গীতিকায় তাঁকে ‘মাও জননী’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তিনি মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “উঠরে দ্বীপের মুছলমান ডাকি যে সবারে / দ্বীনের লাগি প্রাণ সপিতাম যে কপালে”। গীতিকার বর্ণনায় আছে, তিনি ইংরেজদেরকে একেবারে উচিত জবাব দিয়েছিলেন। কিন্তু যে পুত্রসন্তানের জন্য এ লড়াই তাকে পিঠে বেঁধে যুদ্ধ করতে করতে কখন যে সে মারা গিয়েছে তা সুবেদার পত্নী বুঝতেই পারেননি। মনের দুঃখে নদীতে জল খেতে গিয়ে ইংরেজের বল্লমের আঘাতে প্রাণ ত্যাগ করেন।

তার পর চলতে থাকে একের পর এক ঘটনার ক্রম বিন্যাস। ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে রংতুলি ময়দানে যুদ্ধের পর চট্টগ্রাম থেকে দেশীয় সিপাহীরা জৈয়ন্তীয়া পাহাড়ের দিকে পলায়ন করে। এই ঘটনার বর্ণনা রয়েছে গীতিকায়। সেখান থেকে অনেক কষ্টে স্থানীয় মুসলমান জমিদারদের সাহায্যে তাঁরা লাতুতে এসে পৌঁছন। লাতুর জমিদার কালামিয়া তাদের আশ্রয় দেন। কিন্তু কালামিয়া ইংরেজের কাজে স্বার্থসিদ্ধির লোভে সিপাহিদের সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করে সিপাহীদের খবর ইংরেজদের কাছে পৌঁছে দেন। সেখান থেকে বেড়িয়ে সিপাহিরা বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে বদরপুরে পৌঁছয়। সেখানে জমিদার রব্বানির বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করে তারা রওয়ানা হয় জৈয়ন্তীয়ার দিকে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৭: পুরীতে বাড়ি— রবীন্দ্রনাথের, গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৬: আলাস্কায় শীতকাল মানেই ‘এই রাত তোমার আমার…শুধু দু’ জনে’

মূল গীতিকা এখানেই সমাপ্ত। তবে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে আরও অনেক গান রচিত হয়েছে, ‘জঙ্গির লড়াই গীত’ এর মধ্যে একটি। ‘জঙ্গিয়ার গীত’ গীতিকায় বর্ণিত কাহিনির ঐতিহাসিক ঘটনাগুলির সত্যতা যেমন আমরা খুঁজে পাই, সেই সময়ের সরকারি চিঠিপত্রে ঠিক তেমনি জঙ্গির লড়াই গীতে উল্লেখিত ঘটনারও প্রমাণ কিছু চিঠি পত্রেই পাওয়া যায়। জঙ্গির লড়াই গীত এ আমরা পাই, ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় লড়াই করতে করতে তাঁরা ভুবন পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। ভুবন পাহাড় থেকে মণিপুরের দিকে রওয়ানা হলে বিন্নাকান্দি নামক জায়গায় ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। এ বার দেশীয় সিপাহীরা আর পেরে উঠে না। ইংরেজ সেনা দেশীয় সিপাহীদের উপর একেবারে হামলে পড়ে। সিপাহিদের করুণ পরিণতিতেই এর পরিসমাপ্তি ঘটে। গানে আছে …
জইজ্ঞায় কান্দিলারে বিন্নাকান্দিত বইয়া
সুবেদার বাদুরে কান্দইন ঐ দ্বীনর লাগিয়া।


এই গীতিকার গানগুলি এক সময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। স্বাধীনতার প্রাককালে সমাজে তার ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অধ্যাপক সুবীর কর এই জঙ্গিয়ার গীত নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি গীতিকার গানগুলি সংগ্রহ করে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। তার আগে এই গান ছিল শ্রুতি নির্ভর।

২০০০ সালে ‘অসম বিশ্ব বিদ্যালয়, শিলচর’ থেকে ‘মহা বিদ্রোহের দ্রোহগাথা: জঙ্গিয়ার গীত’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। দেশভক্তি কিংবা সিপাহী বিদ্রোহকে নিয়ে বাংলায় এর আগে আর কোনও ঐতিহাসিক গীতিকার সন্ধান পাওয়া যায়নি। এর ভাষা বরাকের আঞ্চলিক ভাষা। গায়করাও ছিলেন বরাক উপত্যকার। গানগুলি সেই সময় যেমন স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরকে উৎসাহিত করেছে, তেমনি সাধারণ মানুষের মনে হিন্দু-মুসলমানের ভাতৃত্ববোধকেও জাগিয়ে তুলেছিল।

একজন মুসলমান নারী কীভাবে বিদ্রোহের আহ্বান আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, সেই ইতিহাস সবার জানা উচিত। বরাকের গণ্ডী অতিক্রম করা তো দূরের কথা, বরাক উপত্যকায়ই এই গীতিকার গায়েনরাও এখন সংখ্যায় বড় কম। জঙ্গিয়ার গীত কিন্তু বৃহত্তর বাংলা পাঠকের কাছে পৌঁছনোর দাবি রাখে। হয় তো এমনি আরও অনেক বাংলা গীতিকা আমাদের সংরক্ষণের অভাবে তার উপযুক্ত মর্যাদা পায়নি। আরও কোনও গীতিকা বাংলার কোনও গ্রামে অযত্নে পড়ে আছে কী না তা কেই বা বলতে পারে।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক।

Skip to content