সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪


মুক্তির তারিখ : ০৫/১২/১৯৫৭
প্রেক্ষাগৃহ : উত্তরা পূরবী, উজ্জ্বলা ও লাইটহাউস
পরিচালনা : অগ্রদূত।
উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম : জয়ন্ত
আবার সুচিত্রা সেন! চারিদিকে শুধু উত্তম-সুচিত্রা, সুচিত্রা-উত্তম। ‘হারানো সুর’ তখনও ব্লকবাস্টার হিট হিসাবে চলছে। ‘চন্দ্রনাথ’, শোলে ছবির জনপ্রিয়তার মতো সারা কলকাতা ভেঙে পড়ে দেখছে। এমতাবস্থায় মার্কেটে সাড়া জাগাতে চলে এল ‘পথে হল দেরী’। উত্তম সুচিত্রার গতানুগতিক সিনেমার পুনরাবৃত্তি বিষয়টা সেরকম একেবারেই দল ছিল না। ‘শিল্পী’ ছবিতে গুণী- দরিদ্র ছেলের সঙ্গে বড়লোক বাবা, নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে চাননি। কিন্তু শিল্পীর মৃত্যু দিয়ে নায়িকাকে যখন চিরকালীন করে দিলেন পরিচালক অগ্রগামী গোষ্ঠী তখনই অগ্রদূত গোষ্ঠী নড়ে চড়ে বসে ছিলেন।
নতুন কিছু করে দেখানোর তাগিদে তখন অগ্রদূতের কর্ণধাররা উথালি পাথালি করছেন এমন সময় বাজারে এল রঙিন ছবি তৈরির হাতছানি। অগ্রদূত গোষ্ঠী নূতনের পূজারী হয়ে সে সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। আমরা যে ছবির প্রিন্ট দেখি তা নষ্ট হয়ে যাওয়া কালার প্রিন্টের পরবর্তী সাদাকালো এডিশন। কিন্তু সে সময় বাংলা ছবিতে রঙিন ছবি করা হবে এ ধরনের একটা বিজ্ঞাপনী মোহ, মানুষকে দলে দলে হলমুখী করল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৭: হারায়ে খুঁজি চন্দ্রনাথ

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৫: ঠাকুরবাড়ির দখিনা বাতাস— জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

আমরা আগেই দেখেছি অগ্রদূত গোষ্ঠী, সেই ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র পর থেকে প্রতিবছর একটা করে উত্তম-সুচিত্রার ম্যাগনাম ওপাস নির্মাণ করে চলেছেন। ১৯৫৬ সালে তাদের থেকে কয়েকজন বিচ্যুত হয়ে অগ্রগামী গোষ্ঠী তৈরি করলেন। কিন্তু খোকাদা মানে বিভূতি লাহা মহাশয় অগ্রদূতের জয়যাত্রা একইভাবে বজায় রাখলেন। ১৯৫৭ সালে ‘হারানো সুর’ ছবি তৈরির সমসাময়িক যখন ‘পথে হল দেরী’ শুটিং শুরু হল তখনই এর প্রস্তুতিপর্ব বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। সেই পিক পয়েন্টে উত্তম-সুচিত্রার ডেট পাওয়াও ছিল মুশকিল। উত্তম সুচিত্রা ছাড়াও অন্যদের সঙ্গে কাজ করছিলেন। সুচিত্রাও উত্তম ছাড়া কাজ করছিলেন। কিন্তু এবছর যেন তাঁদের ছবির বন্যা বয়ে গিয়েছিল। গেভা কালারে হবে বলে সুচিত্রাকে ২৭ বার ছবিতে শাড়ি বদল করা হয়েছিল। অর্থাৎ চেষ্টার কোনও ত্রুটি, নির্মাণ সংস্থার তরফ থেকে ছিল না।
গানে রবীন চট্টোপাধ্যায় যে সাংগীতিক মূর্ছনা উপহার দিয়েছেন তা আজও কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে গেছে। উত্তমের কণ্ঠে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি গান ব্যবহার না করেও শুধুমাত্র সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান দিয়ে যে ছবি হিট করানো যায় তা দেখিয়ে দিয়েছিল এই ছবি। এর আগে ‘সবার উপরে’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র মতোই।

আসলে ছবির নির্মাণ পর্বটি এমনই আঁটোসাঁটো ছিল যে ছবিটির অন্যান্য গুণগত মান নিয়ে খুব বেশি নজর দিতে হয়নি পরিচালককে। কিন্তু যে অংশে মানুষ তাদের দ্বৈরথ পছন্দ করতেন সেই অংশটিকে তাঁরা অত্যন্ত যত্ন করে নির্মাণ করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: যে মানুষ চেয়ে চেয়ে / ফিরিতেছি পাগল হয়ে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা

এতদিন মেয়ের বাবা মাঠে নেমে মেয়ের পছন্দ করা পাত্রকে হেনস্থা করেছেন। এখন প্রতিভা বসু-র গল্প অনুযায়ী ছবিতে মেয়ের অভিজাত দাদু যিনি জমিদারি মেজাজ নিয়ে সব সময় চলেন তাকেই হাল ধরতে হয়েছিল। সে সময়ে ধনতান্ত্রিক ঝাঁজ দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ভাবনাকে পায়ের তলায় পিষে ফেলতে ছবি বিশ্বাসের কোনও জুড়ি ছিল না। ছবিতে সুচিত্রা উত্তম থাকলেও ছবি বিশ্বাস এর সেই দাপটে তাঁরা যেন খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল। ছবি বিশ্বাসের অভিনয় প্রতিভা আমরা জলসাঘর নিয়ে যতটা মাতামাতি করি, ততটা এই ধরনের মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবিতে চরিত্রাভিনেতা বিশ্বাসকে নিয়ে মাতামাতি করি না। ‘পথে হল দেরী’ নির্মাণ কর্তৃপক্ষ এমপি প্রোডাকশন ছবি বিশ্বাসের সেই অভিনয় প্রতিভাকে তুলে ধরেছেন।
যাইহোক কাহিনির বুনন দিয়ে নিতাই ভট্টাচার্য উত্তম সুচিত্রাকে যতবার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। ততবারই চোখাচোখা সংলাপের আদান-প্রদানে যেন দর্শক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ দেখেছেন এবং ছবির শেষে যখন ত্যাগ তিতিক্ষা ধৈর্য সংযম দিয়ে প্রেমকে মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে, প্রকৃত ভালোবাসার স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে সেখানে সমস্ত দর্শক একসঙ্গে ছবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন।

অমিতাভ বচ্চনের ছবিতে যেমন মৃত্যু দৃশ্য দিয়ে স্ক্রিপ্ট রাইটার সেলিম জাবেদ বেশি করে দর্শককে টেনে নিতেন। ‘শিল্পী’ ছবি নির্মাণের পর থেকে পরিচালক গোষ্ঠীরা মধুর মিলন অপেক্ষা বিচ্ছেদভিত্তিক মিলনকে তারা বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিলেন। সুচিত্রা সেনকে মৃত দেখিয়ে নায়ক উত্তম কুমারের হতাশা দর্শক মনে ছাপ ফেলার জন্য পরিচালকরা তৈরি হয়েছিলেন। কিন্তু ‘হারানো সুর’, ‘চন্দ্রনাথ’-র বাজারে এ ধরনের একটি ঝুঁকি প্রযোজক, ডিস্ট্রিবিউটর-রা নিতে চাননি। তাঁরা দিনের পর দিন চিত্রনাট্যকার পরিচালককে হাতে-পায়ে ধরি ছবির শেষ দৃশ্যে সমুদ্রে পারে তাদের জীবিত অবস্থায় মিলন দেখিয়ে পয়সা ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।

এই অংশটুকুর নিবেদনে ‘পথে হল দেরী’ ছবি মানুষকে কয়েক মাস টানা সিটের সঙ্গে বেঁধে ফেলল।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ

আমরা এখন বসে ভাবতেও পারবো না যে সময় স্বাধীনতার দশ বছর উদযাপন হচ্ছে সারা দেশে ঠিক সেই সময় উত্তম সুচিত্রার জয়যাত্রা, শহরাঞ্চলে গ্রামাঞ্চলে কিভাবে দিনের পর দিন মানুষকে সাংস্কৃতিকভাবে সজীব ও স্বাক্ষর রেখেছিল। আর কিছুদিনের মধ্যেই ‘জীবন তৃষ্ণা’ মুক্তি পাবে। একটি অন্য ঘরানার ছবি মানুষ আবার দেখতে পাবে।
‘পথে হল দেরী’-র কাহিনি শেখালেন কলকাতার অভিজাত মহল কীভাবে চলাফেরা করতো। তাদের বাস্তবিক জীবন কেমন ছিল সেই চিত্র ফোটাতে পরিচালক যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা, যে কোনও দেশের প্রথম শ্রেণির ছবির সঙ্গে তুলনা করা যায়। যোগ্য সঙ্গতে সুচিত্রা সেনের। তাঁর অতুলনীয় অভিনয় মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন পাকা করে নিয়েছেন।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content