অলঙ্করণ: লেখক।
নারদ মুচকি মুচকি হাসছিলেন। সামনে পর্বতরাজ হিমাদ্রি। পার্বতীর বিবাহপ্রস্তাব নিয়ে এসেছেন নারদ। দেবাদিদেব যে বার মহাক্রোধে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিলেন চারপাশ, সতীর দেহ ছিটকে ছিটকে পড়েছিল ভূতলের কোণে কোণে, এ তার অনেক পরের কথা। আশুতোষ শিবের মতো বর, বিবাহের প্রস্তাব এল, গৃহীত হল, কালিদাস মানসচক্ষে দেখলেন পার্বতী লজ্জায় আনত হচ্ছেন, লীলাকমলদল গুনছেন যেন আনমনে, অভিভাবকদের সামনে সেই ছোট্ট উমা এর বেশি আর কীই বা করতে পারে! কিন্তু ওই পদ্মফুলের পাপড়ি গণনা করে করে সামনের অনতিক্রমণীয় বিরহকাতর দিনগুলির কথাই ভাবছিলেন কি তিনি? কিন্তু বিধি বাম বুঝি। নাহলে রূপে তাকে ভোলানোর মতো চিরকালের নীতি কেন অলকনন্দার জলে ভেসে যাবে? ভালোবাসা নাকি তপস্যা কীসে জিতে নিতে হবে প্রেমাস্পদকে? নাকি ওই ভালোবাসাই হয়ে উঠবে তপস্যা, তপস্যাই অনুরাগ! পার্বতী বুঝেছিলেন, “হৃদয় আপনি উদাস, মরমে কিসের হুতাশ/ জানি না কী বাসনা, কী বেদনা গো—কেমনে আপনা নিবারি, হৃদয়ের এ কূল, ও কূল, দু কূল ভেসে যায়”…
কালিদাস বলবেন, পার্বতী নিজের অনুপম রূপকে নিন্দা করবেন, কেন না, “প্রিয়েণ সৌভাগ্যফলা হি চারুতা”… বঙ্কিমের ভাষায়, ফুল নিজের জন্য ফোটে না। অতয়েব, মহেশ্বর যদি রূপাকুল না হন, তবে তাঁকে অনুকূল করার উপায়?
উপায় তো একটাই। উপনিষদোক্ত সেই ক্ষুরধার দুরত্যয় পিচ্ছিল পথে চলা, যা দুর্গম, যা অজ্ঞেয়, যা দুরতিক্রমণীয়। অরূপের পথে রূপের সন্ধান।
কিন্তু ওই যে কৈলাশবাসী মনোহর হর, ওই গিরিশ কি দেবতা নন? যুগে যুগে দেবতারা কি ইন্দ্রিয়পরবশ হন না? তবে কেন রূপ-রসের চেনা পথ ছেড়ে দুর্জ্ঞেয়ের
যাত্রা? এ কি নিছক ক্যাবলামি নয়?
উপায় তো একটাই। উপনিষদোক্ত সেই ক্ষুরধার দুরত্যয় পিচ্ছিল পথে চলা, যা দুর্গম, যা অজ্ঞেয়, যা দুরতিক্রমণীয়। অরূপের পথে রূপের সন্ধান।
কিন্তু ওই যে কৈলাশবাসী মনোহর হর, ওই গিরিশ কি দেবতা নন? যুগে যুগে দেবতারা কি ইন্দ্রিয়পরবশ হন না? তবে কেন রূপ-রসের চেনা পথ ছেড়ে দুর্জ্ঞেয়ের
যাত্রা? এ কি নিছক ক্যাবলামি নয়?
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৫: মন বলে আমি মনের কথা জানি না!
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ
কামদেব বসন্তের ডালি আর কোকিলের কুহুরব নিয়ে প্রকৃতি, চৈতন্য ও হৃদয়ের অচিনপুরে আলোড়ন তুলতে এসে নিঃশেষে দগ্ধ হলেন। প্রজ্জ্বলিত হল তৃতীয় নেত্রাগ্নি। কামাগ্নি স্বয়ং যেন ভস্মীভূত হল, মর্ত্য প্রেম অমর্ত্যলোকের চন্দনবনের দিকে চলল ভেসে। এ ভাবেই বুঝি মনোভব হলেন অতনু। পঞ্চশর কাম অদৃশ্য হল, কিন্তু বিশ্বময় তা-ই ছড়িয়ে গেল প্রেম হয়ে, রয়ে গেল রতি, আর সেই অজেয় ত্রিগুণাতীত পুরুষ, সেই মহাসন্ন্যাসী।
কামদেবের এমন জিতে নেওয়ার দুর্বার আত্মপীড়ন কি নিছক ক্যাবলামি নয়?
সেদিন কি পার্বতীর মনে হয়নি, “আপন আমার আপনি মরে লাজে?”
এ বার তিনি অপর্ণা হবেন। নিরাহার, জলশূন্য, নিষ্পত্র তপঃসাধন। মেনকা বারণ করলেন। ছোট্ট উমার কোমল বরতনু পারবে নাকি ওই কৃচ্ছ্রসাধনের দুস্তর বাধা পেরোতে? এই ক্যাবলামির ভার বহনের ক্ষমতা আছে তো তার?
বাধা তো তিনি পেরিয়েছিলেন। অমর্ত্যলোকের জ্যোতির্ময় প্রেম মহাচৈতন্য হয়ে বুঝি নেমে এসেছিল সেদিন।
“পরানে পড়িয়াছে টান ভরা নদীতে আসে বান/ আজিকে কী ঘোর তুফান সজনি গো,বাঁধ আর বাঁধিতে নারি…”
কামদেবের এমন জিতে নেওয়ার দুর্বার আত্মপীড়ন কি নিছক ক্যাবলামি নয়?
সেদিন কি পার্বতীর মনে হয়নি, “আপন আমার আপনি মরে লাজে?”
এ বার তিনি অপর্ণা হবেন। নিরাহার, জলশূন্য, নিষ্পত্র তপঃসাধন। মেনকা বারণ করলেন। ছোট্ট উমার কোমল বরতনু পারবে নাকি ওই কৃচ্ছ্রসাধনের দুস্তর বাধা পেরোতে? এই ক্যাবলামির ভার বহনের ক্ষমতা আছে তো তার?
বাধা তো তিনি পেরিয়েছিলেন। অমর্ত্যলোকের জ্যোতির্ময় প্রেম মহাচৈতন্য হয়ে বুঝি নেমে এসেছিল সেদিন।
“পরানে পড়িয়াছে টান ভরা নদীতে আসে বান/ আজিকে কী ঘোর তুফান সজনি গো,বাঁধ আর বাঁধিতে নারি…”
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৯: খাবারে একদম মশলা নয়?
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪৪: তু তু হ্যায় ওহি, দিল নে জিসে আপনা কহাঁ…
অনেক, অনেকদিন পরে, ভারতচন্দ্রের লেখনীতে কাশীশ্বরী অন্নপূর্ণা যখন এক ভক্তের গৃহ পরিত্যাগ করে অপর কোনও ভাগ্যবান ভক্তের গৃহমন্দিরে চলেছেন, ভক্তের গৃহে নিতান্ত কোন্দলের উত্পাতে অশান্ত ভবানী তারিণী নদীর তীর থেকে ডাকছেন ঈশ্বরী পাটনী নামের এক কাণ্ডারীকে, চড়ে বসেছেন তার তরণীতে, যাঁর নামে ভবসাগর উত্তীর্ণ হতে চায় জীব, তিনিই স্বয়ং যখন চেপে বসেন কোনও নৌকায় তখন অদ্বৈতের তত্ত্ব দ্বিধাগ্রস্ত হয়, জানা যায় ত্রিগুণাতীত সিদ্ধিদাতা সেই সত্য-শিব-সুন্দর, যাঁর অরূপের স্পর্শে একদা পার্বতী নামের এক মুগ্ধা কিশোরী শক্তি, শিবানী কিংবা ভবের ভবানী হয়ে জগত্ আলো করেছিল, তিনিই যেন জীবধর্মে “অতি বড় বৃদ্ধ পতি” হয়ে “সিদ্ধিতে নিপুণ”, তাঁর কোনও গুণ নেই, কপালে প্রোজ্জ্বল তৃতীয় নেত্র তখন যেন কোনও আদি-মধ্যযুগের কুলীন গৃহবধূর সংসারজীবনের অপ্রেমগাথা, কপালে আগুন জ্বেলে মন পোড়ানোই যার নিত্যকর্ম।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৫: ঠাকুরবাড়ির দখিনা বাতাস— জ্ঞানদানন্দিনী দেবী
ভবানী যে এমনটাই বলেছিলেন এমন নয়, তবে ঈশ্বরী পাটনী জগতের ত্রাতা স্বয়ং ঈশ্বরকে চিনতে পারলেন না! এ ভুল অস্বাভাবিক নয়, তবে কেউ কেউ এটা ক্যাবলামি বলে দাগিয়ে দিতেই পারে।
টেনিদা একবার রকের আড্ডায় ক্যাবলাদের জানিয়েছিল, কোনও এক ইংলিশ চ্যানেল পার করা সাঁতারু চৌবাচ্চায় ডুবে মরেছিল। ভুবনবিদিত ভব, শান্তি আর কল্যাণপ্রদ শঙ্কর কখন যেন ঈশ্বরী পাটনীর চোখে কোনও এক নিপীড়িতা গ্রামের বধূর সংসারবিমুখ বৃদ্ধপতি হয়ে চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেন! তখন কোনটা আসল আর কোনটা নকল বুঝে উঠতে পারে না আজন্ম ক্যাবলাদের দল! এভাবেই বুঝি সাঙ্গ হয় একটা পালার।
কিন্তু জীবনের ফুল কখন ফল হয়ে ওঠে তা বুঝি সাদা চোখে ধরা পড়ে না। তাই ক্যাবলামিটা থাকেই, যা ফুরায়, তার বাইরেও একটা অনিঃশেষ সত্য থাকে।
ঋণ স্বীকার
● কুমারসম্ভব, অন্নদামঙ্গল, রবীন্দ্রগান
টেনিদা একবার রকের আড্ডায় ক্যাবলাদের জানিয়েছিল, কোনও এক ইংলিশ চ্যানেল পার করা সাঁতারু চৌবাচ্চায় ডুবে মরেছিল। ভুবনবিদিত ভব, শান্তি আর কল্যাণপ্রদ শঙ্কর কখন যেন ঈশ্বরী পাটনীর চোখে কোনও এক নিপীড়িতা গ্রামের বধূর সংসারবিমুখ বৃদ্ধপতি হয়ে চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেন! তখন কোনটা আসল আর কোনটা নকল বুঝে উঠতে পারে না আজন্ম ক্যাবলাদের দল! এভাবেই বুঝি সাঙ্গ হয় একটা পালার।
কিন্তু জীবনের ফুল কখন ফল হয়ে ওঠে তা বুঝি সাদা চোখে ধরা পড়ে না। তাই ক্যাবলামিটা থাকেই, যা ফুরায়, তার বাইরেও একটা অনিঃশেষ সত্য থাকে।
ঋণ স্বীকার
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।