প্রত্যাশা কম থাকার জন্যই হোক বা ‘শরীরের নাম মহাশয়। যা সওয়াবে, তাই সয়।’, সেই প্রবাদের জন্যই হোক, বা আমার স্ত্রী অঙ্কনার খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতার জন্যই হোক, বিমানবন্দর থেকে বাইরে বেরিয়েই সে বলল ‘কই, আমার তো ঠান্ডা লাগছে না। তোমরা যে এত ঠান্ডা বলো, সেরকম তো কিছুই মনে হচ্ছে না।’ আমি মুখে বললাম ভালো, তবে আমি জানি কি হতে চলেছে। দু’ মিনিট হয়েছে কি হয়নি, আমরা মালপত্তর বাইরে নিয়ে এসে রেখেছি; আর তার মধ্যেই সে ঠান্ডায় কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। সেই ঠান্ডার মধ্যেই কোনওরকমে একটি নিজস্বী তুলে তাকে আবার বিমানবন্দরে ঢুকিয়ে দিলাম গরমে খানিক্ষণ থাকার জন্য।
আসলে প্রথমে গরম থেকে ঠান্ডায় বেরিয়েই বোঝা যায় না ঠান্ডাটা ঠিক কতটা। তার কারণ, বাইরের ঠান্ডার সংস্পর্শে এসে তাপীয় সাম্যে এসে পৌঁছতে শরীরের সময় লাগে কিছুটা। ঠিক যেমন খাবার গরম করে বাইরে রেখে দিলে ঠান্ডা হতে সময় নেয় খানিক্ষণ, সেই রকমই। এ বার মিনিট দুই-তিন পরেই যখন বাইরের প্রচণ্ড কম তাপমাত্রার সঙ্গে সাম্যাবস্থায় আসতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমতে থাকে তখনই শুরু হয় ঠান্ডা লাগা। আমাদের শরীর যদিও নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভিতর থেকে রক্তচলাচল বাড়িয়ে নিজেকে গরম রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু বেশিক্ষণ সেটা সম্ভব হয় না।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৪: অন্ধকারের উৎস হতে—শীতকালের প্রতিরাত
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা
আমাদের দেহে প্রথমেই রক্ত চলাচল ব্যাহত হয় একদম প্রান্তিক অংশগুলোতে, যেখানে শিরা বা ধমনীর কিনারাগুলো অবস্থিত। যেমন হাতের বা পায়ের আঙুলের মাথা, নাকের ডগা, কান এবং তার আশপাশের জায়গা গুলো। একদম কিনারায় হওয়ার কারণে এখানে রক্তের গতি কিছুটা হলেও কম থাকে আর সেখানেই ঠান্ডার অনুভূতি সবচেয়ে বেশি হয়। তাছাড়া ওই ঠান্ডায়, ওই সমস্ত প্রান্তিক অংশের পেশী সংকুচিত হয়ে যায়, যে কারণে সেখানে প্রচণ্ড ব্যথা লাগার মতো অনুভূতি শুরু হয়। আসলে আমাদের শরীর এই ভাবেই তৈরি। পেশী সংকুচিত হয়ে প্রান্তিক অংশের প্রচণ্ড ঠান্ডা রক্তকে শরীরের ভিতরে যেতে বাধা দেয় যাতে বাকি অংশ ঠিক থাকে।
আরও পড়ুন:
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-২০: উত্তর কলকাতায় গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দীতে মিষ্টিমুখ
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৮: সুন্দরবনের তিন গাজী—রক্তান গাজী, তাতাল গাজী ও শতর্ষা গাজী
দু-তিন মিনিট যেতে না যেতেই আমার স্ত্রীয়েরও আঙুলের আশপাশ টনটন করতে শুরু করল, সঙ্গে কানের পাশে ছ্যাঁকা লেগে পুড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি। একবার এরকম অনুভূতি শুরু হলে আর কিছু করার থাকে না, তখন শরীর খুব তাড়াতাড়ি জমে যেতে থাকে। তখন সঙ্গে সঙ্গে গরম কোথাও ঢুকে পড়তে হয়।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৬: কবির অসুখ-বিসুখ
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৫: সে ব্যাটা চড়ছে তেরো সেমি, তো পড়ছে চোদ্দো কিমি, ভাঙবে ঠ্যাং কি?
তো এই ছিল অঙ্কনার প্রথম অভিজ্ঞতা এবং ঠান্ডার দেশে প্রথম হাতেকলমে শিক্ষা যে, শরীর জমে যেতে দেওয়া যাবে না। যে মুহূর্তে মনে হবে যে হাত-পা-কান জমে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে কোনও গরম জায়গায় ঢুকে গিয়ে একটু শরীর গরম করে নিতে হয়। অনেক স্তরে জামা কাপড় পড়লে এই অবস্থায় এসে পৌঁছতে একটু সময় লাগে। তবে একবার এরকম অবস্থায় এসে পৌঁছলে সঙ্গে সঙ্গে গরমে ঢুকে যেতে হয়। তা না হলে খুব তাড়াতাড়ি শরীর বসে যেতে পারে, এবং শৈত্যদংশন বা ফ্রস্টবাইট-এর কারণে হাইপোথার্মিয়ার মতো বেশ সাংঘাতিক কিছুও হতে পারে।
যাই হোক, আমার স্ত্রীর আলাস্কায় প্রথম দিন অবশ্য আমার মত অতটা খারাপ নয়, তবে সমস্যা কিছু কমও নয়। আশৈশব কলকাতার জনাকীর্ণ মেট্রো-শহরে বেড়ে ওঠার পরে দিগন্ত প্রসারিত জনশূন্য তুষারক্ষেত্রে এসে পড়ার মাঝে সাংস্কৃতিক ধাক্কাও বড় কম নয়। পোশাকী ভাষায় যাকে বলে ‘কালচারাল শক’। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের কম জনঘনত্বের জন্য দেশ থেকে এসে লোকের খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধা হয়। কথা বলার লোক নেই, চাইলেই পাশের বাড়ি গিয়ে আড্ডা মেরে আসা যায় না, এসব তো স্বাভাবিক ব্যাপার। আর পৃথিবীর এই প্রান্তে অবস্থা আরও সঙ্গীন, চরমতম। গোটা ফেয়ারব্যাঙ্কস শহরের জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র তিনশকুড়ি যেখানে কলকাতায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে চব্বিশহাজারেরও বেশি লোক বসবাস করে। অর্থাৎ ফেয়ারব্যাঙ্কসের তুলনাল কলকাতার জনঘনত্ব প্রায় ৮০ গুণ বেশি।
ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী
ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।