রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

ঠাকুরকে নিয়েই শ্রীমায়ের জীবনসাধনা। ঠাকুরের তিরোভাবের পর সারদার জীবন অচল হয়ে পড়ে। সবাই মত দিলেন যে, ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত উদ্যানবাটি থেকে তাঁকে স্থানান্তরিত করে শীঘ্র বলরামবাবুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। সকলে যথাসম্ভব সারদা মাকে বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে নিয়ে আসেন। শ্রীমায়ের মানসিক কষ্ট লাঘবের জন্য কয়েকজন ভক্ত মাকে নিয়ে বৈদ্যনাথধাম, কাশী, অযোধ্যা, বৃন্দাবনধাম, হরিদ্বার, প্রয়াগ, পরে নীলাচল হয়ে দক্ষিণভারতের রামেশ্বর সহ নানা তীর্থ দর্শন করাতে নিয়ে যান। ১৫ ভাদ্র স্বামী যোগানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ, লাটুমহারাজ, লক্ষ্মী, গোলাপমা, ও শ্রী’মর স্ত্রী নিকুঞ্জদেবীকে নিয়ে সারদামা বৃন্দাবনে আসেন।
বৃন্দাবনে সারদা অলৌকিকভাবে আবার ঠাকুরের দর্শন পান। ঠাকুরের হাতে যে ইষ্টকবচ ছিল, তা অসুস্থতার সময় শ্রীমাকে দিয়েছিলেন। সারদা তা সযত্নে নিজহাতে ধারণ করে পুজো করতেন। রেলে যাওয়ার সময় তিনি কবচপরা হাত জানলার পাশে রেখে শুয়েছিলেন। এমন সময় তিনি ঠাকুরকে দেখেন জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলছেন, ‘কী গো, সোনার কবচ পরে এমন ভাবে বাইরের দিকে রেখেছ কেন? ও যে চোরে অনায়াসে নিয়ে যাবে’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৫: উদ্যানবাটিতে সারদা মায়ের ঠাকুরের শুশ্রূষা

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৩: মালতীর কথা…

সারদা তাড়াতাড়ি উঠে কবচটি একটি টিনের বাক্স যাতে ঠাকুরের নিত্যপূজিত ছবি ছিল, সেখানে খুলে রাখলেন এবং তা আর কখনও ধারণ করেননি। এই ঘটনা তিনি পরে গণেন্দ্রনাথকে বলেছেন। ১৩১২ সালে মা সারদা ওই কবচ ঠাকুরঘরে রেখে নিত্যপুজো করার জন্য স্বামী প্রেমানন্দের হাতে দিয়ে তার পূজাবিধি শিখিয়ে দেন। বৃন্দাবনে এসে শ্রীমার শোক যেন আরও বেড়ে গেল। যোগীনমা কিছুদিন আগেই বৃন্দাবনে আসেন। তাঁর সঙ্গে দেখামাত্র মা তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। সে কান্না যেন আর থামে না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৭: হারায়ে খুঁজি চন্দ্রনাথ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬২: প্রথম রবীন্দ্রজীবনী

কতকাল আগে যেমন শ্রীকৃষ্ণের বিরহে রাধারানির অশ্রু এই ব্রজভূমিকে অভিষিক্ত করেছিল, যার প্রতিবিন্দু অহেতুক প্রেমের জ্যোতিতে আজও সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। তেমনি কতকাল পরে ঠাকুরের অদর্শনে কাতরা জননী সারদা নিজের বিরহাশ্রু মোচনের জন্য কলকাতা থেকে বৃন্দাবনে ছুটে এসেছেন। ঠাকুরের মুখে কোন সময় শোনা এই গানটি এখানে এসে যেন প্রভাব বিস্তার করেছে—
‘যদি কিশোরি, তোমার কালাচাঁদের—
গোকুলচাঁদের উদয় ঘুচল হৃদে।
দুঃখ কে নাশিবে আর, কৃষ্ণ বই আঁধার,
কৃষ্ণপক্ষে এখন থাকবি রাধে’।।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৮: সুন্দরবনের তিন গাজী—রক্তান গাজী, তাতাল গাজী ও শতর্ষা গাজী

রাধারানির প্রেমাশ্রু বিরহের বৃন্দাবনকে যেমন নিত্যরাসস্থলীতে পরিণত করেছিল। তেমনি এখানে এসে জননী সারদা ঠাকুরের ঘন ঘন দর্শন করতে লাগলেন। তিনি ভিতরে আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠলেন। তাঁর কথা, আচরণ কিশোরী বালিকার মতো হয়ে গেল। রোজ ঘুরে ঘরে তিনি মন্দিরে মন্দিরে ঠাকুরের দর্শন করে বেড়াতে লাগলেন। তিনি কীর্তন শুনতে ভালবাসতেন। লাটুমহারাজ ও লক্ষ্মীকে নিয়ে মাঝে ভাঝে ভগবানজীর আশ্রমে কীর্তন শুনতে যেতেন। কখনও রাধার ভাবে আবিষ্ট হয়ে সকলের অলক্ষ্যে যমুনায় চলে যেতেন। পরে সঙ্গিনীরা খুঁজে তাঁকে নিয়ে আসত। তিনি বলতেন, ‘আমিই রাধা’।

সারদা নিধুবনের কাছে রাধারমণের মন্দিরে গিয়ে দর্শন করতেন। একদিন ভাবনেত্রে দেখলেন যে ঠাকুরের ভক্ত নবগোপাল ঘোষের স্ত্রী নিস্তারিণীদেবী রাধারমণের পাশে দাঁড়িয়ে বীজন করছেন। তিনি রাধারমণের কাছে নিজের দোষদৃষ্টি পূর্ণরূপে দূর করার প্রার্থনা জানান। পরে তাঁর কাছে মন্দচরিত্রের কথা বললে তিনি বিরক্ত হতেন। বৃন্দাবনেই সারদা যোগানন্দকে ইষ্টমন্ত্র দান করেন। তখন পর্যন্ত তিনি দু’তিনজন ছাড়া ঠাকুরের সকল ভক্তের সঙ্গে কথা বলতেন না। পরে তিনদিন ঠাকুরের আদেশ পাবার পর ভাবাবিষ্ট হয়ে পুজো করার সময় মন্ত্রদান করেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৫: সে ব্যাটা চড়ছে তেরো সেমি, তো পড়ছে চোদ্দো কিমি, ভাঙবে ঠ্যাং কি?

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-২০: উত্তর কলকাতায় গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দীতে মিষ্টিমুখ

স্বামী যোগানন্দই তাঁর প্রথমশিষ্য এবং প্রিয় সেবক। বৃন্দাবনে তিনি বংশীবটে কালাবাবুর কুঞ্জে থাকতেন। সেখানে একদিন তিনি এমন সমাধিমগ্ন হলেন যে যোগীনমা নাম শুনিয়ে তাঁর সমাধি ভাঙাতে পারেননি। তখন যোগানন্দস্বামী এসে নাম শোনালে তাঁর সমাধির গভীরতা কমে আসে এবং তিনি বলেন, ‘খাব’। সমাধিভাঙার পর ঠাকুরও এমন বলতেন। কিছু খাবার ও জল আনা হলে ভাবাবেশে ঠাকুর যেরকম করতেন, সারদাও তেমনভাবে গ্রহণ করলেন। আর ঠাকুরের মতো পানের তলার দিকটা দাঁত দিয়ে কেটে ফেলে দিয়ে পান খেতে লাগলেন।

এইসময় যোগানন্দ মাকে কিছু প্রশ্ন করেন। তার উত্তরে ঠাকুর যেমন বলতেন, সারদাও তেমনই বলেন। পরে ভাব প্রশমিত হলে তিনি বলেছিলেন, তাঁর উপর ঠাকুরের আবেশ হয়েছিল। যোগীন মহারাজকেও ঠাকুর অনেকবার বলেছিলেন, তাঁর ও মার দেহে কোন ভেদ নেই। একবার তিনি পঞ্চক্রোশী পরিক্রমাও করেন। বৃন্দাবনে মা সারদা একবছর ছিলেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content