জহর গঙ্গোপাধ্যায় ও কানন দেবী।
বাংলা ছবির সবাক যুগের গোড়ায় এমন সব শিল্পী কলাকুশলীদের আমরা পেয়েছিলাম, তাঁরা সবাই এক একটা রত্ন বিশেষ। এঁদের নিষ্ঠা আন্তরিকতা থেকে এ প্রজন্মের শিল্পীদের অনেক অনেক কিছু শেখবার আছে। কত প্রতিকূল অবস্থাতে এঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। শুটিংয়ের ফ্লোর ছিল তাঁদের কাছে মন্দির বিশেষ। সেইসব শিল্পীদের মধ্যে একজনের নিষ্ঠার ঘটনার কথা এখন বলতে চলেছি।
ছবির নাম নববিধান। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত। এই ছবির প্রযোজিকা নায়িকা কানন দেবী তাঁর শ্রীমতি পিকচার্সের ব্যানারে এই ছবিটি নির্মিত। তাঁর সাড়া জাগানো ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে মেজদিদি, ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত ও অন্নদা দিদি, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, নববিধান প্রভৃতি। তাঁর প্রযোজিত অধিকাংশ ছবি তৈরি হয়েছে শরৎচন্দ্রের কাহিনি অবলম্বনে। প্রায় সব ছবি দর্শকধন্য হয়েছিল। কানন দেবী যখন নায়িকা ছিলেন তখন তিনি তাঁর বিপরীতে পেয়েছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, পাহাড়ি সান্যাল, ধীরাজ ভট্টাচার্য প্রমুখ নায়কদের। এ ছাড়াও ছবিতে কাজ করেছেন এক সময়ের জনপ্রিয় শিল্পী জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের নামেই তাঁর পরিচিতি। কাছের লোকেরা তাঁকে ডাকতেন সুলাল দা বলে। কানন দেবীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবিতে কাজ করেছেন জহর গঙ্গোপাধ্যায়। কখনও নায়ক হিসেবে কখনও বা পার্শ্বচরিত্রে।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪৬: শশীবাবুর সংসার-এর শুটিংয়ে রেগে গিয়ে ছবি বিশ্বাসকে কী বলেছিলেন পাহাড়ি সান্যাল?
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৬: ভয়ের না ‘অভয়ের বিয়ে’
জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের কতগুলি গুণ কানন দেবীকে মুগ্ধ করত। যার মধ্যে রয়েছে সময় মতো সেটে আসা, নিষ্ঠা ভরে চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা, প্রত্যেকের সঙ্গে মধুর ব্যবহার করা। ‘নববিধান’ ছবির শুটিং চলার সময় জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের শরীর বেশ খারাপ হয়। ঠান্ডায় ইনফ্লুয়েঞ্জয় আক্রান্ত হলেন। তিন চারদিন ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভোগার পর খানিকটা সুস্থ সবল হয়ে স্টুডিয়োতে এলেন শুটিং করতে। তাঁকে শুটিংয়ে আসতে দেখে রাগ করলেন প্রযোজিকা কানন দেবী। বললেন, “শরীর খারাপ নিয়ে সেটে আসার কী দরকার ছিল? সবকিছুতেই আপনার বাড়াবাড়ি “জহর গঙ্গোপাধ্যায় কানন দেবীকে আশ্বস্ত করে বললেন” সে কী হয়? এ তো শুধু তোমার আমার ব্যাপার নয়। অনেককে নিয়ে কাজ করতে হয়। শুটিংয়ের মধ্যে একজন টানা না এলে টিম সাফার করে। শিল্পী হয়ে সেটা কি করে বরদাস্ত করি বল?”
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৫: উদ্যানবাটিতে সারদা মায়ের ঠাকুরের শুশ্রূষা
এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৩: ইতিহাসের পাতায় লাচিত বরফুকোন
জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের এ সব কথার কী জবাব দেবেন কানন দেবী। স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে রিজেন্ট পার্কে তাঁর নিজের বাড়িতে চলে গেলেন। স্টুডিয়ো পাড়া থেকে তাঁর বাড়ি খুব দূরে নয়। তিনি নিজে গিয়ে জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের লাঞ্চের জন্য স্ট্যু করে নিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। স্টুডিয়োর ক্যান্টিনের খাবার না দিয়ে নিজের বাড়ির খাবার দিতে চাইলেন কানন দেবী। এক প্লেটের মধ্যে স্ট্যু ঢেলে একটা চামচ দিয়ে জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের সামনে তুলে ধরলেন কানন দেবী। স্ট্যু দেখে অবাক হয়ে বললেন, “এটা কী? ওরে বাবা আমি বাঙালি মানুষ। এসব কী আমার পোষায়? যাক কষ্ট করে এনেছে যখন তখন খাচ্ছি।”
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন
দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৩: মালতীর কথা…
এই সব বলে চামচটা ফেলে দিয়ে এক চুমুকে যাকে বলে একরকম গলায় ঢেলে দিলেন। এখানেই শেষ নয়। তখনও কানন দেবীর অবাক হওয়ার বাকি ছিল। বেয়ারাকে হাঁক পাড়লেন তিনি “ওরে এ বার একটা কলা পাতা পেতে যা রান্না হয়েছে ভাত, ডাল, ছ্যাচরা মাছ, মাংস, চাটনি সব এনে দাও। হাটু অবধি কাপড় তুলে বাবু হয়ে বসে হাপুস-হুপুস করে কলাপাতা গড়ানো ঝোল দিয়ে ভাত না খেলে কি আমার পেট ভরে?” সেই মতো কানন দেবীর সামনে জহর গঙ্গোপাধ্যায় খেলেনও। মজার মানুষটির নির্ভেজাল বাঙালিত্ব দেখে কানন দেবী মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
* পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।