রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


সত্যপীরের পটচিত্র।

“কোথায় বাবা সত্যপীর লইলাম স্মরণ।
তোমা বিনে কেবা করে লজ্জা নিবারণ।।
(বলে) হিন্দুকুলের হও নারায়ণ মোমিনকুলের পীর।
বাবা দুই কুলের সিরনি খেয়ে হয়েছো জাহির।।”


আমার শৈশব স্মৃতির এ গান পাঁচ দশক পরেও এখনও বেশ মনে পড়ে। গত শতকের সত্তরের দশকে পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে পটগায়ক-গায়িকার দল প্রতি বছর সুন্দরবন অঞ্চলে আসত। তারা গৃহস্থের বাড়ির উঠোনে বসে রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক নানা উপাখ্যানের সাথে পীরের উপাখ্যান পটের ছবি দেখাতে দেখাতে গাইত। রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি জানতাম বলে আমি পীরের কাহিনি প্রায়শই শুনতে চাইতাম। আর তখন ওঁরা প্রায়শই শোনাতেন সত্যপীরের কাহিনি। সেই কাহিনি আজও স্পষ্ট মনে আছে।

এক নিঃসন্তান রাজা অনেক চেষ্টা করেও সন্তানলাভে ব্যর্থ হলে শেষে তিনি সত্যপীরের আশীর্বাদে সন্তানলাভ করেন, কিন্তু শর্ত ছিল যে রাজা সত্যপীরকে সিরনি দিয়ে পুজো দেবেন। কিন্তু সন্তান পেয়ে রাজা আনন্দে সত্যপীরকে দেওয়া কথা ভুলে গেলেন। ফলে ক্রুদ্ধ সত্যপীর রাজার সন্তানের প্রাণ কেড়ে নিলেন। তারপর রাজা যখন বানিজ্যের জন্য সমুদ্রযাত্রা করলেন তাঁর নৌবহর ডুবিয়ে দিলেন। রাজা তাঁর অপরাধ বুঝতে পেরে সত্যপীরের কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং তাঁর পুজো করার প্রতিজ্ঞা করলেন। তখন সত্যপীর রাজার সন্তানের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন এবং ডুবে যাওয়া নৌবহরও তীরে লাগিয়ে দিলেন। তারপর সত্যপীর ঘটা করে সত্যপীরের পুজো করে তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন।
সুন্দরবন অঞ্চলে সত্যনারায়ণ আর সত্যপীরের পুজো দুটোই দেখে আসছি আশৈশব। হিন্দুর বাড়ি সত্যনারায়ণ, আর মুসলমানের সত্যপীর। তবে হিন্দুদেরও দেখেছি সত্যপীরের পুজো দিতে। আবার হিন্দুদের যেমন সত্যপীরের প্রসাদ গ্রহণ করতে দেখেছি, তেমনি মুসলমানকেও সত্যনারায়ণের প্রসাদ খেতে দেখেছি। প্রসাদ মানে সিরনি। হিন্দুর সত্যনারায়ণ আর মুসলমানের সত্যপীরের প্রসাদ একই—সিরনি। আবার ইসলামি ধর্ম অনুসারে যেমন আরাধ্য নিরাকার হয়, কোনও প্রতীক থাকে না, হিন্দুদের ক্ষেত্রে তা নয়, অবশ্যই প্রতীক বা মূর্তি থাকে।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-২: ইতিহাসে অসম

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৬: সুন্দরবনের গবাদি-পশুরক্ষক মানিক পীর

কিন্তু সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর উভয়ের আরাধনায় একটা কাঠের পিঁড়ি বা কাঠের তক্তাকে পুজো করা হয়। তাছাড়া সত্যনারায়ণের পুজোয় আসনের উপর রাখা হয় লোহার একটি অস্ত্র। কোনও পৌরাণিক বা লৌকিক দেবতার পুজোয় কিন্তু সিরনি উৎসর্গ করা বা অস্ত্র রেখে পুজো করার নিয়ম নেই। এগুলো রয়েছে ইসলামি প্রথায়। আবার মুসলমানেরা কোথাও কোথাও সত্যপীরের আরাধনার সময় সামনে একটি মাটির ঢেলা অর্থাৎ প্রতীক রাখে। সত্যনারায়ণ ও সত্যপীরের এই সাদৃশ্য দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে এঁরা আদতে একই উপাস্য। আবার হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধানে সত্যনারায়ণ পুজোর শেষে যে পাঁচালি পাঠ করা হয় তাতে সত্যনারায়ণ পীরের রূপ ধারণ করেছিলেন, সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর অভিন্ন ইত্যাদি উল্লেখ রয়েছে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

এখন প্রশ্ন, কে আগে এসেছেন—সত্যনারায়ণ নাকি সত্যপীর। আর কেনই বা এই সমণ্বয় বা রূপান্তর? বিষ্ণুর অপর নাম নারায়ণ। আর ঈশ্বরকে হিন্দুরা যেহেতু ‘সত্য’ বলে মনে করেন তাই হিন্দু দেবতার নাম সত্যনারায়ণ নাম হয়া আশ্চর্যের নয়। সত্যনারায়ণের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় স্কন্দপুরাণের ‘রেবা খণ্ডে’ এবং বৃহদ্ধর্ধ্ব পুরাণের ‘উত্তর খণ্ডে’। আবার এই স্কন্দ পুরাণেই দ্বিজ সদানন্দ, কাঠুরিয়া ও লীলাবতী-কলাবতীর মাধ্যমে সত্যপীরের মাহাত্ম্য প্রচারের কথা উল্লেখ আছে। মহাভারতে সত্যবিনায়ক নামে এক দেবতার উল্লেখ রয়েছে। আর মহারাষ্ট্রে প্রায় প্রতি হিন্দু ঘরে এই সত্যবিনায়কের পুজো হয়।

যদিও এই পূজাপদ্ধতি পুরাণ-বর্ণিত সত্যনারায়ণের পুজো-পদ্ধতির থেকে আলাদা। আবার বাংলায় নাথ-যোগীদের এক উপাস্য দেবতা হল সত্যদেব। এসব থেকে বিশেষজ্ঞদের ধারণা যে সত্যনারায়ণ পুরোপুরি পৌরাণিক বা শাস্ত্রীয় দেবতা নন। ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রণেতা আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, সত্যনারায়ণ ও সত্যপীরের কাহিনি নির্মাণে রয়েছে লৌকিক প্রভাব, বাংলায় পীর-দরবেশদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি এবং হিন্দু-মুসলিম ধর্মের সমন্বয়।

সত্যপীরের পাঁচালির পটচিত্র।

বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মতে সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর একই উপাস্য। অনেক ঐতিহাসিকের মতে গৌড়েশ্বর হুসেন শাহ তাঁর রাজ্যে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সমণ্বয়ের জন্য হিন্দুদের সংস্কৃত শব্দ ‘সত্য’ ও মুসলমানদের আরবি শব্দ ‘পীর’ জুড়ে সত্যপীর উপাসনা প্রবর্তন করেন। আর এক মত হল, নব্য ব্রাহ্মণযুগে বা তারও কিছু পরে নিম্ন বর্ণের হিন্দুরে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের কাছ থেকে চরম অবহেলা পেতে থাকে। তারা পৌরাণিক দেবদেবতাদের উপাসনা করার অধিকার হারায়। তাদের কাছে উপাস্য বলতে থাকে একমাত্র লৌকিক দেবদেবীরা।

এই সময় বাংলায় পীর-দরবেশদের উদার ধর্মীয় মতবাদের প্রতি এই নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা আকৃষ্ট হন। আবার এই সময় বৌদ্ধ ধর্ম লুপ্তপ্রায় হয়ে যাওয়ায় অনেক বৌদ্ধ হিন্দু হতে চাইলেও উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের কাছে তারা ব্রাত্য থেকে যায়। এদের অনেকেই তাই পীর-দরবেশদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু আগের অনেক ধর্মীয় রীতি স্বভাবগত কারণে ত্যাগ করতে পারেনি। ফলে হিন্দুর সত্যনারায়ণ নব্য মুসলমানদের কাছে হয়ে যান সত্যপীর। সুন্দরবন বরাবরই নিম্নবর্ণের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা ছিল। এখানে বৌদ্ধ ধর্মেরও যথেষ্ট প্রভাব ছিল একসময়। সুতরাং এই অঞ্চলে সত্যপীরের প্রচার ও প্রভাব হয়েছে অনেক বেশি।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-২: একলা চলো রে…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৬: রবীন্দ্রনাথ চা নয়, প্রতিদিন সকালে কফি খেতেন

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বাংলার ব্রত’ গ্রন্থে লিখেছেন— “মুসলমানের পীরকে লোকে যেমনি পুজো দিতে আরম্ভ করেছে অমনি তাকে সত্যনারায়ণ বলে প্রচার করে ব্রতটির উপর হিন্দুধর্ম দখল বসালেন। কিন্তু বাংলায় সত্যনারায়ণের যে পাঁচালী তাতে পীরকে মুসলমানী পোষাকই দেওয়া হয়েছে। কথা পর্যন্ত উর্দু যেমন— জয় জয় সত্যপীর, সনাতন দস্তগীর ইত্যাদি। এই মুসলমান পীরের উপাসনা ও শিরনি ভট্টাচার্যদেরও ঘরে চলে এসেছে ও চলছে। পীরের শিরনি বা ভোগটা হচ্ছে সুজি, বাতাসা, হিন্দুয়ানিতে বাধে না এমন সব জিনিস এবং পায়েসের দলে সেটা প্রায় চলে গিয়েছে।”

সত্যপীরের ভিটা, পাহাড়পুর নওগাঁ।

‘সত্যপীরের পাঁচালি’ হল মধ্যযুগে পীর সাহিত্যের অসামান্য গ্রন্থ। মধ্যযুগের বিভিন্ন কবি এই পাঁচালি তৈরি করেছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি কঙ্ক, শেখ ফয়জুল্লাহ, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, রামানন্দ, শাহ গরীবুল্লাহ, ভারতচন্দ্র প্রমুখ। কবি কঙ্ক ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যে সত্যপীরের মহিমাকীর্তন করেছেন। এই কাব্যে সুন্দর সত্যপীরের কৃপাতে বিদ্যাকে অর্জন করেছেন—এই কাহিনিই বর্ণিত হয়েছে। সত্যপীরের সমস্ত পাঁচালিকারই হিন্দু-মুসলিম সমণ্বয়ের দিকটি তাঁদের লেখায় তুলে ধরেছেন। দীনেশচন্দ্র সেনের মতটা তাই খুবই প্রণিধানযোগ্য—“বহুদিন একত্রে বাস হেতু হিন্দু ও মুসলমানগণ পরষ্পরের ধর্ম সম্বন্ধে কতকটা উদারতা অবলম্বন করেছিলেন। সত্যপীর নামক মিশ্র দেবতার আবির্ভাব সেই উদারতার ফল।” সুন্দরবন অঞ্চলে আজও সত্যপীর ও সত্যনারায়ণের সহাবস্থান ও প্রভাব এবং হিন্দু-মুসলমানের সৌহার্দতা এ কথার যৌক্তিকতাকে প্রমাণ করে।—চলবে।

ছবি: লেখক।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content