বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সত্যজিৎ রায়।

 

ঘোমটা (ক্রমশঃ)

ঘরের মধ্যে অনবরত পায়চারি করতে থাকলো সে। বুবু বাবুকে ঘাড় ঘুরিয়ে দু-তিনবার দেখলো। তারপর তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জবাবদিহি শুরু হল।
—কিরে বাবু কি করছিস? কী করছিস বাবু?
—কেসটা মনে হচ্ছে সলভ করে ফেলবো রে।
—কোন কেস বাবু? কোন কেস?
—ওই যে সুষমা কর মার্ডার।
— সুষমা কর মার্ডার। সুষমা কর মার্ডার।
—চেঁচাসনি বুবু। মাথার মধ্যে চিন্তার সূত্রগুলো সব জড়িয়ে যাবে। এক মিনিট বুবু একটা ফোন করেনি
—হ্যালো! হ্যালো বাবু! শুনতে পাচ্ছো। হ্যালো…
—বুবু প্লিজ!! হ্যালো শ্রেয়া।
বুবু বকবক করা চালু করে
—হ্যালো শ্রেয়া, হ্যালো শ্রেয়া, হ্যালো শ্রেয়া।
বাবু একটু তফাতে গিয়ে ফোনে কথা বলতে থাকে।
—হ্যাঁ, একটা কথা গ্লুকোমিটারটা কী চেক করা হয়েছে? আই মিন লাস্ট ডেটাগুলো কী আছে মানে লাস্ট ব্লাড সুগারের রিডিংগুলো।
—ও আচ্ছা। আচ্ছা। ওকে।
বাবুকে আচ্ছা আচ্ছা বলতে শুনে বুবুও যেন ফোনে কথা বলে চলেছে এইভাবে বলতে শুরু করে।
—ও আচ্ছা। আচ্ছা। আচ্ছা। ওকে। আচ্ছা আচ্ছা।
—শ্রেয়া ল্যাবে বলুন গ্লুকোমিটারের ডেটা ভালো করে চেক করতে। যে এক্সট্রা টেস্ট স্ট্রিপগুলো আছে আই রিপিট যে এক্সট্রা টেস্ট স্ট্রিপগুলো আছে মানে যেগুলো আনিউসড, ভার্জিন সেগুলো চেক করতে। আর আমি খাটের তলা থেকে পাওয়া যে দুটো ইউসড স্ট্রিপ দিলাম। ওগুলো খুব ভালো করে টেস্ট করতে বলুন। আর দেরি না করে সুষমা করের ছেলে বৌমা দু’জনকেই খুব ভালো করে রি-একজামিনেশন করতে হবে। আমার মনে হচ্ছে আরও একজন ফোর্থ পার্সন এই ঘটনায় যুক্ত। যে বন্ধ বাড়িতে ঢুকেছিল।
ধৃতিমান চৌধুরী ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস করেন না। কলকাতার আরিফ রোডে তার যে ছোট্ট ভাড়ার ঘরটি সেখানে দেওয়ালে তার দুই ঈশ্বরের প্রকাণ্ড দুটি সাদাকালো ছবি আছে। একজন ঠাকুর আরেকজন সেই ঠাকুরের দীক্ষায় দীক্ষিত তাঁর ধারায় শিক্ষিত। না হল না। শ্রীরামকৃষ্ণ আর বিবেকানন্দ নন। একটি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের মাথায় টুপি পরনে আলখাল্লা। বিদেশের ছবি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অন্যটি সত্যজিৎ রায়ের। এটিও বিদেশে তোলা মাথায় আলতোভাবে হাত রেখে কিছু একটা ভাবছেন। কেউ বাড়িতে এসে এই ছবি দুটোর কথা বললেই একটা প্রশ্নের উত্তর তাকে দিতেই হবে। এই দুটো ছবির কী কী মিল আছে? হয়ত আরও থাকতে পারে, ধৃতিমান ১০টা মিল খেয়াল করেছে। তার ৫টা পারলেই হবে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু! পর্ব-৬: শ্রেয়া বসুর ফোন মানে গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২: রাসসুন্দরী দেবী—বাংলার প্রথম আত্মজীবনী রচয়িতা

পাশের বাড়ির কাকু-কাকিমাকে নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে হবে। পাশের বাড়ির বারান্দা থেকে একটু ঝুঁকি নিলে সরাসরি এ বাড়ির সিঁড়ির মাথায় আসা সম্ভব। একটু হালকা ছিপছিপে চেহারার মানুষের পক্ষে সেটা অসম্ভব নয়। পাশের বাড়ির কাকু যোগব্যায়াম করেন। জমি বাড়ি দালালির ব্যবসায় যুক্ত। কাকিমা পাড়ার রয়টার। প্রতিটি পরিবারের খুঁটিনাটি সব জানেন। তিনি জেরার মুখে বলেছিলেন ছেলে-বৌমার সঙ্গে বাড়ি লিখে দেওয়া নিয়ে প্রায়ই অশান্তি হতো। এ বাড়ি জমি প্রোমোটারকে দেবার প্ল্যান করেছিল ছেলে-বৌ। এটা তো আজকের স্বার্থপর জীবনে অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। ভগ্যক্রমে ছেলে-বৌমা এসব না চাইলেও আশপাশের পাড়া প্রতিবেশী মাঝেমধ্যে আসা আত্মীয়পরিজন ছেলেবৌমাকে সন্দেহের কাঠগড়ায় তুলে দেবেন। একমাত্র ছেলে স্বাভাবিক ভাবেই একমাত্র ওয়ারিশন তার যেচে ভিলেন হবার কোন কারণ নেই। তবু ফিকশন্যাল টেনশন না থাকলে বঙ্গসমাজের পাচনশক্তি ব্যহত হয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

এ বার ধৃতিমান নিজের পদ্ধতিতে ইনভেস্টিগেশন শুরু করে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ‘লিড’ পেল। এক পল্লবের ব্যবসা খুব একটা ভালো চলে না। দুই যে প্রোমোটার বাড়িটা নেবে সে শুধুমাত্র সূষমা করের দোতলাবাড়িটুকুই নেবে না। প্রোমোটারের নজর গোটা চত্ত্বরটার দিকে। সে একটা বড়সড় কমপ্লেক্স করতে চায়। তাতে কাকু-কাকিমার বাড়িও পড়ছে। সুষমা হয়ত না বলতেন সে ক্ষেত্রেও সুষমাকে সরিয়ে দেবার একটা মোটিফ পাওয়া যাচ্ছে। কাকু-কাকিমা বা ওই চত্বরের যে কেউ। ভাবনায় ছেদ টানতে মোবাইলে সেই ফেলুদার ক্যামেল রাইড সিনের আবহ। শ্রেয়া বাসুর ফোন। নিঃসন্দেহে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। নিছক গল্প করতে ছোট ভৈরব মানে দত্ত ছাড়া কেউ ফোন করেন না। লোকটা ভুল রাস্তার ভুলভুলাইয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে- লোকটা রাগসঙ্গীতের গুণী সমজদার সে বেচারা খুনি খুঁজে বেড়াচ্ছে।
—ডেথ কটায় বলছে একটা থেকে তিনটের মধ্যে। তার মানে সাড়ে চারটে পাঁচটা নাগাদ সুরমা কর মৃত। আই সি।
বিদ্যুতের মতো কথাগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠলো।
—অত সকালে ঘোমটা?
—হ্যাঁ, আর মা-জি এর আগে কখনো ঘুংঘট দিতেন না। আভি তো ম্যায় সুবহ যাতে হেঁ। আগে তো সারাদিন থাকতাম। তখন বাবু বেঁচে ছিলেন। ওনার জামা কুর্তা সব ইস্ত্রি হত। হামি গিয়ে কাপড়া এক দোবার দিয়ে ভি এসেছি। মা-জিকে আমি তখন থেকে চিনি। আমাকে ভি চিনতেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৩: ঠাকুর সন্নিধানে সারদার কল্যাণব্রতে দীক্ষা

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৪: মাটি তোদের ডাক দিয়েছে…

এরমধ্যে বাবু তার অনেকসূত্রের একটির থেকে ওই কাকুর বিষয়ে একটা খবর পেল। কাকু ভবানী পাল এক নামকরা বিল্ডারের ঘনিষ্ঠ যারা এই সুষমা কর এবং আশপাশের সাত-আটটি বাড়ির দখল নেবার চেষ্টা করছে। এখানে একটা বড়সড় মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং কমপ্লেক্স গড়তে চায়। এর মধ্যে কাকুর বাড়িও পড়ছে। এলাকার লোকজনের কাছে কাকু প্রতিবাদী। ভাবখানা যে বিল্ডার যাতে তাদের ঠকিয়ে না নিতে পারে সেজন্য সে সবরকম খোঁজ খবর নেবে। যেকোনও দামেই পুরনো বাড়ি ছেড়ে দেবে না। আসলে এটা ভবানী পালের ভেক। ছদ্মবেশ। বাড়ির মালিকদের মধ্যে মিশে থাকা বিল্ডারেরই এজেন্ট হল ভবানী পাল।—চলবে।
 

সুষমা কর হত্যারহস্য পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩

* হ্যালো বাবু! (Hello Babu) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ২য় খণ্ড।

Skip to content