শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

সারদাপ্রসন্ন দক্ষিণেশ্বরে গেলে ঠাকুর তাঁকে প্রায়ই গাড়ি ভাড়া দিতেন। একদিন বললেন, নহবতে গিয়ে চারটি পয়সা চেয়ে নিতে। সারদাপ্রসন্নকে পয়সা দেবার কথা ঠাকুর বলে পাঠাননি। তাহলেও তিনি নহবতের কাছে গিয়ে দেখেন যে, চারটি পয়সা রাখা আছে। সেই সময় শ্রীমা বাইরের লোকজনের সামনে বেরতেন না। এই ঘটনা সম্বন্ধে তিনি পরে বলেছেন, ‘আমি নবতে হাজার কাজ নিয়ে থাকলেও আমার মন সর্বদা ঠাকুরের কাছে পড়ে থাকত। অতদূর থেকে খুব আস্তে বললেও আমি সব কথা শুনতে পেতুম। ঠাকুরের মুখে ওই কথা শুনেই আমি চারটি পয়সা রেখে দিয়েছিলুম’।

অন্য একদিন ঠাকুর নরেনকে খেয়ে যেতে বলেছেন। সারদা মা নহবত থেকে শুনেই স্বামিজি যা খেতে ভালোবাসেন, সেই ছোলার ডাল চড়িয়ে ময়দা মাখতে লাগলেন। ঠাকুর নহবতে শ্রীমাকে জানাতে এসে দেখেন যে, যা বলতে এসেছিলেন, সারদা তাই করছেন। গর্ভধারিণী মায়ের দৃষ্টিতে তাঁর সন্তানকে জানার ক্ষমতা ছিল, আর ছিল তাঁর ঠাকুরের প্রতি অগাধ নিষ্ঠা। তাই তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতেন।
একবার একজন মহিলার নিকট আত্মীয়ের চরিত্র ভ্রষ্ট হওয়ায় সংসারে খুব অশান্তি হত। এই অনর্থের নিবারণ কিছুতেই করতে না পেরে প্রতিকারের আশায় ঠাকুরের কাছে আসেন। তিনি ভেবেছিলেন যে সাধুমানুষের অনেক মন্ত্র, দৈব ঔষধ জানা আছে। তাঁর এই সরল বিশ্বাস দেখে ঠাকুরের মনে দয়া হয়। তিনি নিজে কোন উপায় না বলে সেই মহিলাকে নহবতে পাঠিয়ে দেন। রামকৃষ্ণপুঁথিতে এর সুন্দর বর্ণনা আছে—
দেখিতে পাইবে তথা নারী একজনা।
মনোমত মন্ত্রৌষধি আছে তাঁর জানা।।
পূরিবে বাসনা গিয়া জানাও তাঁহারে।
আমি কিবা জানি, তিনি আমার উপরে।।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২১: শ্রীমার ঠাকুরের প্রতি যত্ন

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১: চন্দ্রাবতী—বাংলা সাহিত্যে প্রথম ছন্দের আড়ালে প্রতিবাদী কবি

সারদা মা পুজো করছিলেন, মহিলাটি তাঁকে প্রণাম করে সব জানালেন। শ্রীমা ঠাকুরের স্বভাব জানতেন। তিনি বললেন যে ঠাকুরই ঔষধজ্ঞ, তিনি কিছুই জানেন না। মহিলাটি ঠাকুরের কাছে যেতেই হাসতে হাসতে তিনি আবার বলেন যে, শ্রীমায়ের কাছেই তার ইচ্ছাপূরণ হবে। তাঁর কাছে আসা বৃথা। মহিলাটি আবার শ্রীমার কাছে ফিরে এলে সারদার দয়া হল, তিনি একটি পুজোর বেলপাতা তার হাতে দিয়ে বললেন যে তার মনোবাসনা পূর্ণ হবে।

ঠাকুর যখন কামারপুকুর যেতেন, তখনও এমন পরিহাস করতেন। শ্বশুরবাড়িতে সারদাকে লোকের ভিড়ের কারণে সংকোচে খাকতে হত না। ঠাকুর একদিন রান্নার নির্দেশ দিচ্ছেন ভাইজি লক্ষ্মীকে, ‘লক্ষ্মী, চার পয়সার পাঁচফোড়ন কিনে নিয়ে আয় তো’। তারপর সারদাকে বললেন, ‘পাঁচমিশেলি ডাল কোর, এমন সম্বুর যেন শূয়োর গোঙায়’। সেইসময়ের আরও দুদিনের কথা শ্রীমা বলেছেন, ‘কামারপুকুরে লক্ষ্মীর মা আর আমি রান্তুম। লক্ষ্মীর মা ভালো রান্তে পাত্ত। সে যেটা রেঁধেচে খেয়ে বললেন, হৃদু, এটা যে রেঁধেচে সে রামদাস বদ্যি। আমি যেটা রেঁধেচি খেয়ে বললেন, আর এই ছিনাথ সেন’। শ্রীনাথ সেন হাতুড়ে। একথা শুনে হৃদয় বলে, ‘তা বটে, তবে তোমার হাতুড়ে বদ্যি তুমি সব সময় পাবে, গা টিপতে, পা টিপতে পর্যন্ত, ডাকলেই হল; রামদাস বদ্যি, তার ষোলটাকা ভিজিট, তাকে তো আর সব সময় পাবে না!আর লোকে হাতুড়েকে ডাকে, সে তোমার সব সময় বান্ধব’।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৪: সুন্দরবনের রাজমাতা দেবী নারায়ণী

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৩: চল্ রে চল্ সবে…

ঠাকুরও বলেন, তা বটে, এ সব সময় আছে। স্বার্থ কথাটা নিয়ে এই সময় ঠাকুর ও সারদার পরিহাস হয়। রান্নাঘরে কুকুর ঢুকছে দেখে ঠাকুর হৃদয়কে বলেন, যেমন-তেমন করে খাওয়া সেরে নিতে, তাঁরা তো থাকছেন না, শিহড়ে যাবেন। শুনতে পেয়ে সারদা মা বলেন, আচ্ছা তো স্বার্থপর! ঠাকুরের আর শিহড় যাওয়া হল না। দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, স্বার্থ ছাড়া আর কি কিছু আছে? এই বলে স্বার্থ বিষয়ে নানা কথা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে লাগলেন। আসলে নিজের অজান্তেই শ্রীমা একটি মোক্ষম কথা বলে ফেলেছেন যে! স্বার্থ কথাটার প্রকৃত অর্থ হল স্ব-এর অর্থ, অর্থাৎ নিজেকে জানা, যা কিনা উপনিষদের বাণী। তাই ঠাকুরের এত উচ্ছ্বাস যে শিহড় যাওয়াও তাঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব ৪৭: শীতকালে দই খেতে নেই?

একদিন, শ্রীমা অনেক ফলমিষ্টি লোককে বিলিয়ে দিয়েছেন। তার জন্য ঠাকুর সামান্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন,’ অত খরচ কল্লে কি করে চলবে’? সারদা মা ঠাকুরের প্রতি একটু অভিমানের ভাব দেখিয়ে চলে যেতেই অতি ব্যস্ত হয়ে তিনি রামলালকে ডেকে বলেন, ‘ওরে তোর খুড়িরে গিয়ে শান্ত কর, ও রাগলে আমার সব নষ্ট হয়ে যাবে’! দেহসম্বন্ধ না রেখে অতি পবিত্র দাম্পত্য প্রণয়ের যে আদর্শ ঠাকুর ও শ্রীমার জীবনে দেখা যায় তার উপমা বিশ্ব ইতিহাসে পাওয়া যায় না।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content