শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

নৈমিষারণ্যে, মহর্ষি শৌনক আয়োজিত, দ্বাদশবর্ষব্যাপী যজ্ঞে, আগত সৌতি উগ্রশ্রবা, কথকঠাকুর। মুনিঋষিদের অনুরোধে, মহাভারতের বিচিত্র আখ্যান উপাখ্যান বর্ণনা করে চলেছেন তিনি। মুনিঋষিদের ফরমায়েশ অনুযায়ী নানা রকম পৌরাণিক তথা মহাভারতীয় আখ্যান উপাখ্যান তাঁর গল্পের বিষয়। মহর্ষি, জ্ঞানী, দৃঢ়ব্রত, শৌণক ঋষিও একজন শ্রোতা। পুরাণকথিত অলৌকিক উপাখ্যান এবং প্রজ্ঞাবান মনীষীদের আদিবংশবৃত্তান্ত সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান যাঁর আছে সেই লোমহর্ষণীর পুত্র, সৌতির কাছে, যজ্ঞের হোমগৃহে অবস্থানরত পুরোহিত, আশ্রমবাসী পরিবৃত কুলপতি ঋষি শৌনক তত্র বংশমহং পূর্বং শ্রোতুমিচ্ছামি ভার্গবম্। প্রথমেই মহর্ষি ভৃগুর বংশের বিবরণ শুনতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।

মহর্ষি ভৃগুর পুত্র চ্যবন। চ্যবনের স্ত্রী সুকন্যা। তাঁদের পুত্র প্রমতি। তেজস্বী, জ্ঞানবান প্রমতির ঔরসে, ঘৃতাচী নামে অপ্সরার গর্ভে, রুরু নামে পুত্র জন্ম নিলেন। রুরুর ঔরসে, মহিষী প্রমদ্বরার গর্ভে শুনক নামে পুত্রের জন্ম হল। সর্বজীবের কল্যাণকামী মহর্ষি স্থূলকেশের পালিতা কন্যা প্রমদ্বরার জন্মবৃত্তান্ত বিচিত্র। গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসুর ঔরসে, অপ্সরা মেনকার গর্ভে প্রমদ্বরার জন্ম। নির্মম, লজ্জাহীনা, অপ্সরা মেনকা প্রমদ্বরার জন্মমাত্রই স্থূলকেশঋষির আশ্রমস্থ নদীর তীরে তাকে পরিত্যাগ করলেন। করুণায় আপ্লুত মহাতেজস্বী শ্রেষ্ঠমুনি স্থূলকেশী, সেই উজ্জ্বলা,দেবকন্যাতুল্যা, কান্তিময়ী কন্যাটিকে গ্রহণ করলেন। কন্যাটিকে প্রতিপালন করে বড় করে তুললেন উদারমনা মহর্ষি। তিনি কন্যাটিকে সুসংস্কৃত করে তুললেন। কন্যাটি স্বভাবে, সৌন্দর্যে, শিল্পকলায়, অন্য প্রমদা অর্থাৎ নারীদের মধ্যে অনন্যা হয়ে উঠলেন। ঋষি স্থূলকেশ তার নামকরণ করলেন। নাম হল প্রমদ্বরা। প্রমদাভ্যো বরা সা তু সত্ত্বরূপগুণান্বিতা। ততঃ প্রমদ্বরেত্যস্যা নাম চক্রে মহানৃষিঃ।।
একদা প্রমতিপুত্র ধার্মিক রুরু মহর্ষি স্থুলকেশের আশ্রমে প্রমদ্বরাকে দেখে কামার্ত হয়ে পড়লেন। পিতা প্রমতি এ সম্বন্ধে অবগত হয়ে, স্থূলকেশ ঋষির কাছে কন্যাটিকে পুত্রবধূরূপে প্রার্থনা করলেন। কন্যার পিতা সম্মত হলেন। স্থির হল আগামী উত্তরফাল্গুনী নক্ষত্রে বিবাহ সম্পন্ন হবে। আসন্ন বিবাহযোগের কিছু আগে বালিকা প্রমদ্বরা সখীদের সঙ্গে ক্রীড়ারত অবস্থায়, নিজের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে একটি ঘুমন্ত সাপকে পদদলিত করল। বালিকা খেলার ছলে অসতর্ক অবস্থায় ছিল। যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুরূপী সেই সাপটির বিষদাঁত প্রবেশ করল তার দেহে। সা তস্যাঃ সম্প্রমত্তায়াশ্চোদিতঃ কালধর্ম্মণা। বিষোপলিপ্তান্ দশনান্ ভৃশমঙ্গে ন্যপাতয়ৎ।। মাটিতে ঢলে পড়ল কন্যা। বিবর্ণ হল গায়ের রং, তার উজ্জ্বল দীপ্তি উধাও হল, অলংকার খসে পড়ল, সংজ্ঞা হারাল প্রমদ্বরা। চুল খুলে পড়ল, প্রাণ হারাল সে। মাটিতে লুটিয়ে পড়া তার শীর্ণদেহ যেন আরও সুন্দররূপে দৃশ্যমান হল। পিতা স্থূলকেশ এবং অন্যান্য তপস্বীরা সেই পদ্মকোষের মতো গৌরবর্ণা, ভূমিতে শায়িতা, স্পন্দনহীনা কন্যাকে দেখলেন। সেখানে উপস্থিত হলেন বিখ্যাত ব্রাহ্মণরা।

প্রমতিপুত্র রুরু, প্রমদ্বরার ভাবি স্বামী ও এবং অন্যান্য বনবাসীরা সাপের বিষে জর্জরিত কন্যাটির প্রাণহীন দেহ দেখে করুণায় আপ্লুত হয়ে কেঁদে উঠলেন শুধু গভীর দুঃখী রুরু গেলেন আশ্রমের বাইরে। রুরুদুঃ কৃপয়াবিষ্টা রুরুস্ত্বার্তো বহির্যযৌ। তে চ সর্ব্বে দ্বিজশ্রেষ্ঠাস্তত্রৈবোপাবিশংস্তদা।। রুরু গভীর বিজন বনে, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে প্রমদ্বরাকে স্মরণ করে শোকার্ত্তমনে বললেন, শেতে সা ভুবি তন্বঙ্গী মম শোকবিবর্দ্ধনী। প্রাণাপহরন্তীব পূর্ণচন্দ্রনিভাননা।। আমার শোক বৃদ্ধি করে সেই ক্ষীণতনু মেয়ে ভূমিতলে শুয়ে আছে, তার পূর্ণচন্দ্রের মতো মুখখানি যেন আমার প্রাণ অপহরণ করছে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩৮: জনপ্রিয়তায় অনন্য, ভাবি অযোধ্যারাজের অভিষেকপর্ব নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হবে? নাকি অপেক্ষা করছে কোনও দুর্ভোগ?

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১: চন্দ্রাবতী—বাংলা সাহিত্যে প্রথম ছন্দের আড়ালে প্রতিবাদী কবি

সেই মরণাপন্না কন্যা, যেন রুরুর প্রাণটিই হরণ করে নিয়ে যাবে এখনই। মুমূর্ষুরপি মে প্রাণানাদায়াশু গমিষ্যতি পিতা-মাতা মাতুলাদি গুরুজনদের পিণ্ডদানকারী কেউ আর রইল না। এর থেকে বেশি দুঃখ আর কীই বা হতে পারে? এবার কঠোর শপথ বাক্য উচ্চারণ করলেন রুরু, আমি যদি যথাযথ দান করে থাকি, যথার্থ তপস্বী হয়ে থাকি, যদি শ্রদ্ধাস্পদ গুরুজনদের সেবাপরায়ণ হই, তবে সেই পুণ্যফলেই যেন আমার প্রিয়া পুনর্জীবন লাভ করে। যদি দত্তং তপস্তপ্তং গুরবো বা ময়া যদি। সম্যগারাধিতাস্তেন সঞ্জীবন্তু মম প্রিয়া।। আজন্ম সংযতচিত্তে আমি যদি ব্রহ্মচর্যাদি নিয়ম পালন করে থাকি, তবে এই প্রমদ্বরা আবার জীবন পেয়ে উঠে বসবেন। যথা চ জন্মপ্রভৃতি যতাত্মাহং ধৃতব্রতঃ। প্রমদ্বরা তথাদ্যৈষা সমুত্তিষ্ঠতু ভামিনী।। দেবতাদের প্রতি যদি তাঁর অচল ভক্তি অটুট থাকে তবে তার দয়িতা যেন বেঁচে ওঠেন। রুরুর করুন বিলাপে দেবতারা বিচলিত বোধ করলেন। তাঁরা তাঁকে মঙ্গলবাক্যে শান্ত করবার জন্য দেবদূতকে পাঠিয়ে দিলেন। বিষাদগ্রস্ত রুরুকে সান্ত্বনা দিয়ে দেবদূত বললেন, অভিধৎসে হ যদ্বাক্যং রুরো!দুঃখেন তন্মৃষা। না তু মর্ত্ত্যস্য ধর্মাত্মন্! আয়ুরস্তি গতায়ুধঃ।। হে রুরু, দুঃখে উদ্বেল হয়ে যে কথা বলছেন, তা সবটুকুই মিথ্যা। হে ধর্মাত্মা, মরণশীল মানুষের আয়ু একবার ফুরিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না।

তিনি জানালেন, গন্ধর্বরাজ ও অপ্সরার কন্যা, এই বালিকাটির আয়ু নিঃশেষিত হয়েছে। তুমি বৃথা শোকার্তচিত্ত হয়ো না। দেবদূত, দেবনির্দিষ্ট পথে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার উপায়ও জানালেন। তং যদীচ্ছসি কর্ত্তুং ত্বং প্রাপ্স্যসীহ প্রমদ্বরাম্। যদি চাও তবে তুমি প্রমদ্বরাকে ফিরে পাবে। ক উপায়ঃ কৃতো দেবৈর্ব্রূহি তত্ত্বেন খেচর!। হে আকাশচারী দেব, কী সেই উপায়? আপনি বলুন। আয়ুষোঽর্দ্ধং প্রযচ্ছ ত্বং কন্যায়ৈ ভৃগুনন্দন!। এবমুত্থাস্যতি রুরো!তব ভার্য্যা প্রমদ্বরা।। হে ভৃগুবংশীয় কুমার, তোমার আয়ুর অর্দ্ধাংশ দাও দেখি, হে রুরু, তোমার ভার্যা প্রমদ্বরার, নিশ্চিত জীবনে উত্তরণ ঘটবে। রুরু দৃঢ়তার সঙ্গে জানালেন, আয়ুর অর্দ্ধাংশ তিনি কন্যাকে এই মুহূর্তে দান করলেন।আমার রূপসী, প্রিয়া,প্রমদ্বরা শৃঙ্গারের উপযোগী বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে এবার উঠে বসো। শৃঙ্গাররূপাভরণা সমুত্তিষ্ঠতু মে প্রিয়া।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৪: সুন্দরবনের রাজমাতা দেবী নারায়ণী

উদারমনা দেবদূত ও প্রমদ্বরার পিতা বিশ্বাবসু যমরাজের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। রুরুর আয়ুর অর্দ্ধাংশ গ্রহণ করে, প্রমদ্বরা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। বড় জ্যোতিষীদের বিচার অনুযায়ী রুরু দীর্ঘজীবনের অধিকারী ছিলেন, তাঁর আয়ুর অর্দ্ধাংশ নষ্ট হল। যথাসময়ে প্রমতিপুত্র রুরু ও স্থূলকেশের কন্যার বিবাহ সম্পন্ন হল। পরস্পরের কল্যাণকামনায় জীবন কাটাতে লাগলেন তাঁরা দু’জন। অহিংসাব্রতপালনে একনিষ্ঠ রুরু প্রাণের বিনিময়ে লব্ধ দুর্লভ পদ্মবর্ণা প্রিয়াকে লাভ করেও সর্পকুলবিনাশই যেন তাঁর লক্ষ্য। সেটি এখন তাঁর ব্রত। যে কোন সাপ দেখামাত্র ক্রোধে জ্বলে উঠতেন তিনি। অস্ত্র ধারণ করে নিজের শক্তি অনুযায়ী সর্পনিধন তাঁর অন্যতম কাজ।

একদিন গভীর বনে একটি নির্বিষ স্থূলাকার ঢোঁড়া সাপকে শায়িত অবস্থায় দেখতে পেলেন তিনি।যমদণ্ডের মতো লাঠি তুলে সেই সাপটি মারতে গেলেন। ঢোঁড়া সাপটি প্রতিবাদ করে উঠল। হে তপোধন,আমি যে আপনার কাছে কোন অপরাধ করিনি। তাহলে এত ক্রোধান্বিত হয়ে বেগে আমাকে মারতে আসছেন কেন? রুরু তাঁর ক্রোধ প্রকাশ করে জানালেন, তাঁর প্রাণপ্রিয়াকে দংশন করেছিল একটি সাপ। সেই থেকেই তাঁর এই ভয়ানক প্রতিজ্ঞা। প্রতিজ্ঞাটি হল,যেখানে যে সাপ দেখব, তাকে সর্বদাই হত্যা করব।তাই তাই আমি তোমায় হত্যা করতে ইচ্ছুক। আজ তোমার জীবন্মুক্তি ঘটবে। ভুজঙ্গং বৈ সদা হন্যাং যং যং পশ্যেয়মিত্যুত। ততোঽহং ত্বাং জিঘাংসামি জীবিতেনাদ্য মোক্ষ্যসে।। সাপটি বুঝিয়ে বলল রুরুকে, যে সব সাপ মানুষকে দংশন করে, তাদের প্রকৃতি আলাদা।সাপের গন্ধ আছে বলেই নির্বিষ ঢোঁড়া সাপকে আপনি মারতে পারেন না। তার মতে, একানর্থান্ পৃথগ্ধর্ম্মান্ একদুঃখান্ পৃথক্সুখান্। ডুণ্ডুভান্ ধর্ম্মবিদ্ভূত্বা ন ত্বং হিংসিতুমর্হসি।।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-২: দু’ চোখ ভরে স্বপ্ন পূরণের আনন্দাশ্রু, অদূরেই যে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প!

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৫: মন বলে আমি মনের কথা জানি না!

বিপদ ও দুঃখ পরস্পর ভিন্ন কিন্তু দুঃখ এবং সুখ পরস্পর পৃথক। তাই ধার্মিক রুরু নির্বিষ ঢোঁড়া সাপগুলিকে মারতে পারেন না। রুরু হত্যা থেকে বিরত হলেন। তিনি সমীহভরে, সাপটির ক্রোধনিবৃত্তির জন্যেই যেন তার পরিচয় জানতে চাইলেন। কেন ত্বং ভুজগ! ব্রূহি কোঽসীমাং বিক্রিয়াং গতঃ। হে সর্প, আপনি কে? বলুন কী কারণে আপনার এই অদ্ভুত বিকৃতি? সাপটি জানাল, তিনি জন্মান্তরে সহস্রপাৎ নামে এক ঋষি ছিলেন। এক ব্রাহ্মণের অভিশাপের ফলে তার এই সর্পরূপপ্রাপ্তি। এরপরে রুরুর জিজ্ঞাসা—এর কারণ কী? কতদিন এই দুর্ভোগে, সাপের শরীরে থাকবেন তিনি? ডুণ্ডুভ অর্থাৎ ঢোঁড়াসাপটি জানাল, খগম নামে এক ব্রাহ্মণ জন্মান্তরে তাঁর সখা ছিলেন। সেই খগম ছিলেন তপোবলে বলী এবং অব্যর্থভাষী ছিলেন। তাঁর বাক্য কখনও ব্যর্থ হত না। অগ্নিহোত্রযাগে প্রবৃত্ত খগমকে খেলার ছলে একটি তৃণনির্মিত সাপ দিয়ে ভয় দেখিয়েছিলেন সহস্রপাৎ ঋষি। সত্যবাদী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তপস্বী, খগম ভয়ে জ্ঞান হারালেন। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে রাগে অন্ধ হয়ে তিনি বন্ধুকে অভিশাপ দিলেন—যথাবীর্য্যস্ত্বয়া সর্পঃ কৃতোঽয়ং মদ্বিভীষয়া। তথাবীর্য্যো ভুজঙ্গস্ত্বং শাপাদ্ভবিষ্যতি।। আমার ভয়োদ্রেকের কারণে তুমি, খেলাচ্ছলে, নির্বিষ শক্তিহীন সাপ নির্মাণ করেছিলে যেমন, তেমনই তুমিও আমার অভিশাপের ফলে সামর্থ্যহীন নির্বিষ সাপে পরিণত হবে। ঋষি খগমের তপস্যার শক্তিকে সমীহভরে, বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে, ঋষি সহস্রপাৎ, আনত বিনয়ে, কৃপাঞ্জলিপুটে, অনুরোধ জানালেন বন্ধুকে, সখাসুলভ লঘু হাস্যরসের তাগিদে কৌতুকচ্ছলে আমি এই কাজ করেছি। ক্ষমা কর, হে ব্রাহ্মণ, এ শাপ ফিরিয়ে নাও। সখেতি হসতেদং তে নর্ম্মার্থং বৈ কৃতং ময়া। ক্ষন্তুমর্হসি মে ব্রহ্মন্! শাপোঽয়ং বিনিবর্ত্ত্যতাম্।

বন্ধুকে অতিশঙ্কিত অবস্থায় দেখে, ভীষণ ব্যস্ততায়,তপস্বী খগম, বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন। বন্ধু সহস্রপাতকে বললেন,তাঁর কথা মিথ্যা হবার নয়। অভিশাপ অব্যর্থ,তা ফল দেবেই। তবে, ঋষি খগম, নিষ্পাপ সহস্রপাৎ ঋষিকে আস্বস্ত করলেন এই বলে যে, প্রমতিপুত্র রুরুদর্শনের ফলে অচিরেই তাঁর শাপমুক্তি ঘটবে। সেই থেকেই ঋষি সহস্রপাতের এই সাপের জীবন। এ বার রুরুদর্শনে তাঁর মুক্তি ঘটবে।সহস্রপাৎ তাঁর দীপ্ত রূপ ধারণ করলেন। রুরুর কল্যাণকামনায় তাঁকে প্রকৃত মানবধর্মের উপদেশ দান করে বললেন, অহিংসা পরমো ধর্ম্মঃ সর্ব্বপ্রাণভৃতাং স্মৃতঃ। প্রাণীমাত্রের অহিংসাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তাই ব্রাহ্মণ কোনও প্রাণীর প্রতি হিংসা ভাব পোষণ করবেন না কখনই।

বেদের নির্দেশ হল, ব্রাহ্মণ হবেন শান্তস্বভাব। ব্রাহ্মণ হবেন বেদবেদাঙ্গবিদ, সকল প্রাণীর অভয়দাতা, অহিংসা সত্যনিষ্ঠতা ক্ষমা এবং বৈদিক জ্ঞানধারণ, এইগুলিই ব্রাহ্মণের ধর্ম।ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, ব্রাহ্মণের ধর্ম থেকে পৃথক। ক্ষত্রিয় ধর্ম হল, দণ্ডের মাধ্যমে দুষ্টের দমন, স্বভাবে ভয়ংকরভাব, প্রজাদের প্রতিপালন। ক্ষত্রিয়ধর্ম অবহিত করবার উদ্দেশ্যে ঋষি সহস্রপাৎ রাজা জনমেজয়ের সর্পযাগের আখ্যানের সূচনা করলেন। জানালেন, সর্পসত্রে সাপেদের ধ্বংস থেকে মুক্তি হয়েছিল তপস্যা ও শৌর্যবলে বলী, বেদবিদ্যায় পারদর্শী দ্বিজশ্রেষ্ঠ আস্তীকমুনির তৎপরতায়। সেই বৃত্তান্তের বিশদ বিবরণ শুনতে উৎসুক রুরু।কিন্তু প্রস্থানে ব্যস্ত,সহস্রপাৎ ঋষি যোগবলে অন্তর্হিত হলেন। ব্যস্ত রুরু ঘটনাটিকে আশ্চর্য মনে করে ঋষি সহস্রপাতের অনুসন্ধানে ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। ঘটনার অভিঘাতে, বিমুগ্ধ মনে ঋষি সহস্রপাতের উপদেশ গুলি বারবার চিন্তা করলেন, সত্যোপদেশশ্রবণের প্রতিক্রিয়াতেই হয়তো তার চেতনা লুপ্ত হল। জ্ঞান ফিরে পেয়ে রুরু আশ্রমে পিতার কাছে সর্পবৃত্তান্ত জানালেন। পিতা প্রমতি তখন জিজ্ঞাসু পুত্রের কাছে জনমেজয়কৃত সর্পসত্রের কাহিনি বর্ণনা করলেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব ৪৭: শীতকালে দই খেতে নেই?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৪: চাঁদ ঢাকার কৌশল

প্রাণীদের মধ্যে সাপ, মহাভারতে সূচনাতেই এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। কুরুরাজ জনমেজয় আয়োজিত সর্পসত্রে, প্রতিহিংসার আগুনে প্রজ্জ্বলিত যজ্ঞাগ্নিতে, সাপেদের বিনাশের ইতিবৃত্ত শুরু হয়েছে। পিতা পরীক্ষিতের অকালমৃত্যুর প্রতিশোধকল্পে রাজা জনমেজয় সম্পূর্ণ সর্পকুলের নিধনে মেতে উঠেছেন। অপরাধী একজন, তিনি হলেন তক্ষক, তাঁর দংশনেই মৃত্যু হয়েছিল কুরুরাজ পরীক্ষিতের।হত্যার উন্মাদনায় মানুষের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়, বিবেচনাহীন কাজে উৎসাহিত হয় মানুষ। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুরু ও প্রমদ্বরার কাহিনিতে।রুরু বিবেকবান ঋষি কুমার। সাপের দংশনে প্রাণপ্রিয়ার মৃত্যু তাঁকে হিংস্র করে তুলেছিল। যে কোন সাপ তাঁর প্রতিহিংসার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মহাভারতে সাপেদের মধ্যে মানুষের ধর্ম আছে। তারা বাক্যালাপে অভ্যস্ত,আত্মরক্ষায় সচেতন, কিছুটা বিবেকবানও। সাপমাত্রই ক্রুর,হিংস্র নয়।আত্মরক্ষা একটি জৈবিকপ্রচেষ্টা। মানুষের ক্ষেত্রে,আত্মরক্ষার্থে হত্যাও বৈধ। যে কোনও প্রাণীই নিজের প্রাণরক্ষায় মরিয়া হয়ে ওঠে,মানুষেরতো কথাই নেই।বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী অন্যতম প্রাণী,মানুষ।জনমেজয়ের পিতা পরীক্ষিতকে দংশন করেছিল একটি সাপ, তক্ষক। সেখানেও অভিশাপের অব্যর্থ ফলের প্রতিক্রিয়া কাজ করেছিল। তবে সেখানেও মানুষের প্রতিহিংসার প্ররোচনা ছিল, ছিল উতঙ্ক মুনির প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করবার প্রবণতা। রুরুর ভাবি স্ত্রী বালিকা প্রমদ্বরা নিজের অনবধানতার কারণে সাপটিকে পদদলিত করেছিল। সরীসৃপ, সাপ নিজেকে রক্ষার তাগিদে দংশন করেছিল বালিকাকে। প্রতিহিংসাপরায়ণ রুরু হত্যা করতে শুরু করলেন সাপেদের। দৃশ্যমান, বিষধর, নির্বিষ যে কোন সাপের নিধনই তাঁর লক্ষ্য। মানবধর্ম সম্বন্ধে তাঁকে অবহিত করল একটি সাপ, মানুষের জ্ঞানদৃষ্টিতে যে নিকৃষ্ট সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী।

অহিংসা, দয়া, ক্ষমা, অনৃশংসতা, মানবধর্মের এই সুকুমারবৃত্তিগুলো আমরা ভুলে যাই। ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের প্রথম রিপু ক্রোধ এতটাই প্রবল যে তার বশবর্তী হয়ে মানুষ দুর্বল, প্রবলের ভেদাভেদ ভুলে যায়। তাঁরা হিংসার প্রশ্রয়ে যে সব কাজ করে তাতে তাদের এক একটি বিষধর সাপ বললেও বোধ হয়, অত্যুক্তি হয় না। বিদ্বেষের দংশনবিষে প্রতিপক্ষকে জর্জরিত করে মৃত বা মৃতপ্রায় করে তোলাতেই মানুষের আনন্দ।

মহাভারতে সহস্রপাৎ ঋষির উপদেশের ফলে, রুরুর চৈতন্যোদয় হয়েছে। ঢোঁড়াসাপের মতো নির্বিষ জীবনে কত গরলহীন সাধারণ, হিংসার বলি হয় এই পৃথিবীতে। প্রতিবাদী সাপটি সফল হয়েছিল। কারণ হয়তো প্রতিপক্ষ রুরুর মধ্যে বিবেকবোধ অবশিষ্ট ছিল। উদারমনা রুরু প্রেয়সীকে বাঁচিয়েছেন নিজের দুর্মূল্য আয়ুর বিনিময়ে। অকারণ প্রাণীবধ যে হিংসার ফলশ্রুতি—এটি তিনি হয়তো জীবনাভিজ্ঞতায় অনুধাবন করেছেন।
রুরুর এই মহাভারতীয় শিক্ষা এখন হয়তো ভীষণই উপযোগী। “নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস”—না, মহাকাব্যের সদর্থক উদাহরণগুলো আজও হয়তো আমাদের জীবনে চলার পথে, পাথেয় হতেই পারে।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content