শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


সম্পন্ন বাঙালি পরিবারের হাওয়া বদলের জায়গা মধুপুর। মানস চোখে দেখতে পাই বড় বড় বাক্স প্যাটরা নিয়ে ছেলে মেয়ে, স্ত্রী ও দাস-দাসী নিয়ে বাঙালি অভিজাত পরিবার যাচ্ছেন মধুপুর। অন্তত মাস খানেকের জন্য। সেই বাড়িগুলো এখন কেমন আছে? কী ভাবে আছে? দেখে এলাম মধুপুরে।
মধুপুর স্টেশনটি দেখেই চমৎকৃত হলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, মস্ত স্টেশন। প্রতি প্ল্যাটফর্মে ওভারব্রিজ ছাড়া ও লিফট আছে। মালপত্র নিয়ে নামাওঠার কোনও অসুবিধে নেই। স্টেশনের আশেপাশে বেশ জমজমাট। দোকান পাট, বাজার। শহরে ঢুকতে রাস্তার মাঝে ট্রাফিক পুলিশের জায়গায় এক গোল শেড। লেখা ডালমিয়া কূপ। ভালো করে দেখলাম। ওটা কূপই বটে। চারদিকে উঁচু করে বসার জায়গা। কূপের ফাঁকা গোলটি জাল দেওয়া। পরে দেখেছি ওখানকার সব কুয়োই জাল দিয়ে ঢাকা। সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর পানীয় জল।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৫: তিনচুলে ও লেপচাজগৎ এর মেঘ-আলয়ে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’

আমাদের বুকিং ছিল সেট হেরিটেজ হাউসে। স্টেশন এর বেশ কাছেই। সেখানে আশপাশটি ফাঁকা হয়ে এসেছে। মস্ত জায়গা নিয়ে বাড়ি। চারদিকে অনেকটা জায়গা। বাগান। একধারে একতলায় গোটা তিনেক ঘর। কর্মচারীদের থাকার। গেট দিয়ে ঢুকে লম্বা বাঁধানো রাস্তা। দু’পাশে বাহারি ফুল। বড় লাল টুকটুকে গোলাপ ফুটে আছে। বাড়িতে ওঠার লাল সিমেন্টের সিঁড়ি। উঠেই সুন্দর এক বারান্দা। বারান্দায় ঢোকার মুখে দু’ ধারে দুটো অর্ধ গোলাকৃতি লাল সিমেন্টের বসার জায়গা। বেতের চেয়ার, লম্বা ইজি চেয়ার, কাঠের টেবিল…সব সাবেকি আসবাব পত্রে সাজানো বারান্দা।
পুরো বাড়িটি সাদা রঙের। সবুজ বর্ডার। ছাদের কিনারায় সবুজ ঝালর এর ডিজাইন। জানালা দরজা ও সবুজ। খড়খড়ির। লম্বা টানা জানালা। নিচের চওড়া জায়গায় বসা যায়। ভিতরে ও একটি বসার ঘর। বইয়ের আলমারি। দু’ তিনটি পেইন্টিং দেওয়ালে। রবীন্দ্রনাথের, ফুলের। বই পড়ার টেবিলে বই রাখার এক খানি সেলফ। ঢুকে মনে হল আমি ২০২৩ সালে নেই।এসে গিয়েছে ১৯৪০-৫০ এর এক অভিজাত বাড়িতে। যেখানে একুশ শতকের তাড়াহুড়ো, উৎকণ্ঠা নেই। নেই প্রতিযোগিতা, নেই পাওয়ার নেশা। এখানে নিজের সাথে নিজের থাকার, নিজেকে আবিষ্কারের অনেক সময়। ওই কালো তেলচুকচুকে কাঠের টেবিলে কাগজ কলম নিয়ে বসলেই কিছু না কিছু সৃষ্টি করতে পারব।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব ৪৭: শীতকালে দই খেতে নেই?

শোবার ঘরের খাটটি ও পুরোনো দিনের। পালঙ্ক বলাই ভালো। বেশ উঁচু। ঘরের দেওয়ালে একটি ভল্ট আছে। চাবি দেওয়া। না জানি ওই সময় কত মূল্যবান জিনিস থাকত। তার চাবি খোয়া গিয়েছে। শুনেছি বাড়িটি মূল মালিকের পর দশ হাত বদল হয়ে বর্তমান মালিকের হাতে এসেছে। কোনও এক শেঠ বর্তমান মালিক। প্রথম যিনি তৈরি করেছিলেন তিনি মিত্র। বাড়ির পিছনে ও লাল মেঝের বারান্দা। এছাড়া আছে একসারি একতলা ঘর। কেয়ার টেকার এবং অন্যান্যদের থাকার ও রান্নার জন্য। বাগানের একধারে কিছু সবজির গাছ।

এছাড়া আছে পাতকুয়ো। বাঁধানো উঁচু করে। ওপরে মস্ত জাল দিয়ে ঢাকা। ওখানকার জলই পানীয় জল। যে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য সত্তর আশি বছর আগে সবাই ওখানে যেত তার চাবিকাঠি ওই জল।আমরা এখন বেড়াতে গেলে খাবার জল নিয়ে খুব সতর্ক থাকি। মিনারেল ওয়াটার ছাড়া খাই না। তাই ওখানে দু’ দিন ধরে আছেন এমন এক বৃদ্ধ পর্যটককে আগেই খাবার জলের ব্যাপার জিগ্যেস করলাম। উনি হই হই করে বললেন, জানেন এখানকার জল খেয়ে খুব মুশকিল হয়েছে। কিছুতেই খিদে মিটেছে না। মনে হচ্ছে আরো খাই। পেটই ভরছে না। নিশ্চিন্ত হলাম। পুরোনো সব ভালো জিনিস হারিয়ে যায়নি।
একদিন গেলাম গিরিডি। উসরী ঝর্ণা ও নদী দেখতে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে বড় বড় কালো পাথরের ওপর দিয়ে পরছে জলধারা। সেই ছেলেবেলা থেকে রবিঠাকুরের বই উসরীর নাম মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। খুব ভালো লাগলো। এছাড়া যাওয়া আসার পথ ঘাট খুব ভালো। মসৃণ কালো পিচের রাস্তা দু’ দিকে সাদা বর্ডার। একদিন দেওঘর গেলাম। বাবামন্দিরের ভিড় ও পান্ডার উৎপাত বলার মত। দর্শনের উপায় নেই। সর্পিল লাইন দেখে মনে হল সারাদিন লেগে যাবে। এছাড়া গেলাম বাসুকিনাথ মন্দির দেখতে।
সেখানে বাবা দর্শন হল বটে, সেটা শিবলিঙ্গ না বড় এক হলুদ প্লাস্টিকের জারিকেন বুঝলাম না। শিবলিঙ্গের মাথায় প্রচুর জল দিয়ে প্রচুর পুণ্য অর্জনের অর্থী এক পরিবারের জনা চারেক দেখলাম ভিড়ে গুঁতোগুতি করে জায়গা করে নিয়ে বাবার মাথায় উপুড় করে দিচ্ছে মস্ত এক জারিকেন। বাবার চারদিক ঘিরে ব্যূহ তৈরি করে ফেলেছে। আমি ঠ্যালা খেয়ে ঢুকে পরেছিলাম। কিন্তু সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে এলাম সেই হলুদ ক্যান দেখে। বাবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। ঠ্যালায় দাঁড়ানোর অক্ষমতার জন্য। ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা নিজের চোখেই দেখে এলাম।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-১: টি-হাউসের সামনের পাহাড়ের শৃঙ্গ-রা যেন রঙের উৎসবে মেতে উঠেছে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৩: বাড়ির কাজের লোককে নিজের সম্পত্তির অধিকার দিতে দ্বিজেন্দ্রনাথ দলিল পাল্টেছিলেন

মধুপুরে একদিন পুরোনো সব বাড়ি দেখতে গেলাম।বেশির ভাগ বাড়ি এখন জঙ্গল। দেওয়াল ছাদ দিয়ে বড় বড় গাছ উঠেছে। কিছু জায়গা ভেঙে পড়েছে। সবকটা বাড়িই মস্ত জায়গা নিয়ে। কুড়ি একর, চল্লিশ একর। একই সাবেকি ঢং-এ বানানো একটি দুটি বাড়ি কোনোমতে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। হয়তো পেছনে কোনও পরিবার থাকে। কোনও এক সময় কলকাতা থেকে মালিকরা আসেন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল। গাড়ির চালক আমাদের দেখালো। সেটি ভাঙা পড়েছে। মস্ত এক মাঠ এখন। মাঝখানে এক মন্দির। আর রয়েছে পাতকুয়োটি। ইতিহাসের সাক্ষী। রবি ঠাকুরের বাড়ির একটি অংশ রয়েছে। বাকি অংশ চোখের হাসপাতাল হয়েছে এখন।
বাড়িগুলো দেখে মনে খারাপ হয়ে উঠলো। কারা কত শখ করে এসব বানিয়েছিল। পরবর্তী প্রজন্ম যে সবই ছড়িয়ে যাবে, এসব ভোগ বা রক্ষণাবেক্ষনের জন্য থাকবে না এমন ভাবনা থাকলে হয়তো বানাতেন না। তলস্তয়-এর সেই বিখ্যাত গল্পটির কথাই মনে হতে লাগলো। ‘How much Land does a man require?’ মনকে সাবধান করতে লাগলাম। শেষের জন্য একার কথাই ভাবতে হবে।
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content