রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ত্রয়ী: কিশোর, আশা ও আরডি। ছবি: সংগৃহীত।

‘ধুঁয়া’ ছবিতে অমিত কুমারের গাওয়া ‘হাম ভি তো হ্যায়’ গানটিকে ধামাকা বললে হয়তো ভুল বলা হবে না। গানটি শুরু হতেই, অর্থাৎ প্রেলুডের অংশ থেকেই বোঝা যায়, এ বার কিছু একটি ঘটতে চলেছে। আমরা একটু নড়েচড়ে বসি। গানটি মনখারাপ সারিয়ে তোলার মোক্ষম টনিক।

আশা ভোঁসলের গাওয়া দুটি গান ‘ফির আখ ফারকি সনম’ এবং ‘ইয়ে হ্যায় মৌকা’ তেমন ভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি ঠিকই, কিন্তু দুটি গানের ক্ষেত্রেই পঞ্চমের সেই চেনা রিদম, স্ট্রিং ইনস্ট্রুমেন্টের ব্যবহার, বাসের প্রাধান্য, ড্রাম, ট্রাম্পেট সবই আমাদের কানে ধরা দেয়। তার সঙ্গে ধরা দায় এক অতি চঞ্চল আশার কণ্ঠ। দৃশ্যের দাবি অনুযায়ী।
অথচ এই ছবিতেই পঞ্চম ‘তেরা অসর হ্যায়’ গানটি কিন্তু লতাকে দিয়ে গাইয়েছেন। তার মূল কারণ গানটির ধরন এবং প্রবাহ। কোথাও সুরকারের মনে হয়েছে যে, এই গান আলোকিত করতে পারেন একমাত্র তাঁর লতা দিদি। সত্যিই তাই। লতাকণ্ঠ গানটিকে করে তুলেছে আক্ষরিকঅর্থেই সর্বাঙ্গসুন্দর।

উল্লেখ্য, আশা ভোঁসলে এক সাক্ষাৎকারে একটি মজার গল্প শুনিয়েছিলেন। তিনি একবার পঞ্চমকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন পঞ্চম বেছে বেছে কিছু গান আশাকে গাইতে দেন, আর বাকি সব গান সচেতনভাবে লতাদিদির জন্য রেখে দিতেন। ভারী মজার উত্তর দিয়েছিলেন পঞ্চম। তিনি ক্রিকেটের প্রসঙ্গ টেনে একটি তুলনা দিয়েছিলেন। জবাবে তিনি আশাকে বলেছিলেন, লতাদিদি হলেন ‘ডন ব্র্যাডম্যান’ এবং আশা হলেন ‘স্যার গ্যারি সোবার্স’। মজার ছলে অথচ সুকৌশলে পঞ্চম কতবড় একটি বাস্তব কথা বলে দিয়েছিলেন আশাকে ভেবে দেখুন! এরপর আর কোনওদিন আশা এই প্রশ্ন দ্বিতীয়বার পঞ্চমকে করেননি। অর্থাৎ, তাঁর কাছে তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, এই তুলনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পঞ্চমের আসল বক্তব্য।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩৭: মনচলি ও মনচলি…কিশোর-আশার কণ্ঠ আর অমিতাভর নাচ, মনে আছে?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়

রাজ কাপুরের প্রযোজনায় আসে ‘বিবি ও বিবি’ ছবিটি। যেহেতু রাজ সাহেব জড়িয়ে রয়েছেন ছবিটির সঙ্গে, তাই পঞ্চমও যে এক ধাপ এগিয়ে রাখবেন নিজেকে, তাতে আর সন্দেহ কোথায়? তাঁকে তো খুশি করতেই হবে! তাই একে একে ছবির গানের সুরগুলি তৈরি করে ফেলেন তিনি।

‘ওয়াক্ত সে পহেলে’ গানটি কিশোরের জন্য তৈরি করেন পঞ্চম। রণধীর কাপুরের লিপে কিশোরের গাওয়া এই গানটি যেন শুরু থেকেই চমক দিতে প্রস্তুত। অনবদ্য একটি মেলোডির সঙ্গে এই গানটিতে আমরা পাই একটি গতিময় রিদম এবং কোরাসের জাদু। গানটির আসল রূপ আমার লেখায় ততটা প্রকাশ পাবে না আপনাদের কাছে। প্রকাশ পাবে গানটি একটিবার শোনার পর। একটি অদ্ভুত আবেদন রয়েছে গানটির।
আর একটি মজার গান ‘সদিও সে দুনিয়া মে’, এটিও কিশোরকে দিয়েই গাইয়েছেন পঞ্চম। আবারও এক অনবদ্য সৃষ্টি।
‘গরি হো কালি হো’ গানটিই বা কম কিসে? নায়ক রণধীর কাপুর তাঁর একজন জীবনসঙ্গী খুঁজে পেতে ভগবানের কাছে কাতর আবেদন জানাচ্ছেন। এই মজার আবহে এই গানটির জুড়ি মেলা ভার। কিশোর গেয়েছেনও নিজের স্বভাবসিদ্ধ ঢংয়ে।

‘এক নেহি দো নেহি’ গানটি তুলনামূলক ভাবে একটু ধীর গতির গান ঠিকই, কিন্তু কিশোর এবং লতা গানটিকে একটি অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন। গানটির মেলোডির ওপর ভড় করে গায়ক গায়িকার উপস্থাপনা এক কথায় অসামান্য।

কিশোর-লতার একটি মিষ্টি গান শুনতে চান? শুনে নিন এই ছবির ‘মেরি বুলবুল’ গানটি। যেমন সার্বিক অরেঞ্জমেন্ট, তেমন মেলোডি। কিশোর লতার অগুন্তি অনবদ্য গানের তালিকায় এই গানটি সমহিময় নিজের জায়গা করে নেয়।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৫: তিনচুলে ও লেপচাজগৎ এর মেঘ-আলয়ে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২০: পাঁচ ভাইয়ের বড়দিদি

‘মঙ্গলসূত্র’ ছবির ‘জাগো মহাদেব’ গানটির ক্ষেত্রে আমরা পাই এক অন্য পঞ্চমকে। নায়িকা তাঁর অসুস্থ নায়কের সুস্থতার কামনায় দেবাদিদেব মহাদেবের চরণে প্রার্থনা করছেন একটি গানের মাধ্যমে। যে প্রার্থনায় রয়েছে এক চরম আকুতি। সেই আকুতি সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয়েছে পঞ্চমের সুরে এবং লতার গায়কীতে। এই গানের আবেদন এতটাই যে এটি আপনার মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলবেই।

কিন্তু ঠিক তার পরেই যদি এই ছবির আশা এবং ভূপিন্দর সিংয়ের গাওয়া ‘রাত বানু মে’ গানটি শোনেন, মনে খুশির জোয়ার বইবেই। কেন বলছি? আচ্ছা, এই ধরনের একটি মেলোডির ছোঁয়া মাখানো মিষ্টি প্রেমের গান শুনলে কেই বা মুখ গোমড়া করে বসে থাকবে বলুনতো? এটাই তো পঞ্চমের সুরের বৈচিত্র্য!

‘আঙ্গুর’ ছবির গুলজারের লেখা ‘হোঠো পে বিতি বাত’ গানটি যখন সুর করেন পঞ্চম তখন তিনি সেটি করেন খুব সন্তর্পনে। তবলাকে প্রাধান্য দিয়ে সৃষ্টি হয় ছন্দ। আশা ভোঁসলের নেশাতুর কণ্ঠে গানটির প্রবাহ এবং ইন্টারলুডগুলি কানে এলে ‘মেরা কুছ সামান’ গানটির কথা কেন যেন মনে পড়ে যায়। মনে রাখবেন, লেখক হলেন গুলজার। তাই তাঁর লেখার গভীরতাকে গানে ফুটিয়ে তোলা খুব একটি সহজ কাজ নয়। সুর হতে হবে কথার উপযোগী, সব দিক থেকে। আর সেটাই করে দেখিয়েছেন পঞ্চম।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য গান হল ‘রোজ রোজ ডালি ডালি’। সেমি ক্লাসিক্যাল এই গানটির সুরের মাধুর্য এমন ভাবে গ্রাস করে রাখে আমাদের যে, আমরা গানটির প্রসংশার ভাষাও হারিয়ে ফেলি। কিছুই বলার থাকে না। গানটি এক সময় যখন মিলিয়ে যায়, তখন সেই গানের মায়াজালে আরও একবার ধরা দিতে ইচ্ছে করে। আর এর নেপথ্যে রয়েছেন তিনজন। গুলজার, পঞ্চম এবং আশা।

‘গেহরা জখম’ ছবির ‘আইসা হো তো ক্যায়সা হো’ গানটি শুনলে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যাবে যে গানটির সুরকার কে। আরডি বর্মণের সেই বহুপরিচিত সিগনেচার রিদম, মন মাতানো মেলোডি, আর কিশোর এবং স্বপন চক্রবর্ত্তীর দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া গানটি শ্রোতাদের মনে একটি দীর্ঘস্থায়ী নিশান রেখে যায়। ‘মৌসম ভিগা ভিগা’ র মতো একটি দুষ্টু-মিষ্টি গানকে কিশোর-আশা দু’জনে মিলে সাজিয়ে তুলেছেন নিজেদের সহজাত গায়কীর সাহায্যে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৩: অকালে খেয়েছ কচু, মনে রেখো কিছু কিছু

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব- ৪০: জীবন এত ছোট ক্যানে

‘জেল যাত্রা’ ছবির ‘বাচনা রাজাজি’ গানটি পঞ্চম সাজিয়েছেন সেই ছন্দে, যে ছন্দের উপর যেনো তাঁর জন্মগত অধিকার। গানটি গাওয়াবার জন্য বেছে নিয়েছেন তাঁর অগ্রজসম কিশোরকে। বস্তুত, এই একই সুর পঞ্চম ব্যবহার করেছিলেন বাংলা ছবি ‘ত্রয়ীর’ একটি গানে। গানটি ছিল ‘জানা অজানা পথে চলেছি’। সেই গান আপনারা সবাই শুনেছেন, আমি নিশ্চিত।

‘পা কে একেলি মহে’ গানটির ক্ষেত্রে অভিনবত্ব একটিই। সেটি হল দিদি এবং বোনের কণ্ঠ একই গানে শুনতে পাওয়া। বুঝলেন না তো? পঞ্চম এই গানটিতে লতা এবং আশা দু’জনকেই একসঙ্গে গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। দু’জনকে ডেকে জানিয়ে দেন এই সিদ্ধান্তের কথা। যথারীতি, রিহার্সালের পর ফাইনাল রেকর্ডিংও সম্পন্ন হয়। এমন সিদ্ধান্তের নেপথ্যে রয়েছে যে কারণটি সেটি হল গানের দৃশ্যে দুই নায়িকার উপস্থিতি। দু’জনেই নৃত্যের তালে গাইছেন গানটি। আর তাই লতা-আশা ব্যতীত আর অন্য কোন জুটির কথাই বা মনে আসবে পঞ্চমের?—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content