Skip to content
মঙ্গলবার ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


রামকৃষ্ণদেব ও গিরিশচন্দ্র।

“আচ্ছা, মশাই এরকম কি আপনার হয়?” ডঃ মহেন্দ্র সরকারকে প্রশ্ন করেছেন গিরিশ চন্দ্র ঘোষ।
“কী রকম”?
“এখানে আসবো না আসবো না করছি, যেন কে টেনে আনে আমাকে। আমার নাকি হয়েছে, তাই বলছি।”

গিরিশচন্দ্রের এই অবস্থা নতুন কিছু নয়। তার চেয়ে যে দিন শ্রীরামকৃষ্ণ ‘চৈতন্যলীলা’ নাটক দেখতে এসেছিলেন, সেদিন তার প্রথম সাক্ষাতে পরিচয় হল। সেও এমন কিছু ঘনিষ্ঠ নয়। তার কয়েকদিন পরই গিরিশচন্দ্র পাড়ার চৌরাস্তায় রকে বসে আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ দু’ তিনটি ভক্ত নিয়ে যাচ্ছিলেন বলরাম বসুর বাড়ির দিকে। থিয়েটারে সে দিনের সেই সামান্য পরিচয় সূত্র ধরে শ্রীরামকৃষ্ণ নমস্কার করলেন উপবিষ্ট গিরিশচন্দ্রকে। গিরিশচন্দ্র প্রতি নমস্কার করলেন।
রামকৃষ্ণ এগিয়ে চলে গেলেন দক্ষিণ দিকের রাস্তায়। কিন্তু গিরিশচন্দ্রের মনে তীব্র হয়ে উঠল এক প্রবল আকর্ষণ। তিনি নিজে স্বীকার করেছেন, “তিনি যাইতেছেন, আমার বোধ হইতে লাগিল যেন কি অজানিত সূত্রের দ্বারা আমার বক্ষস্থল তাঁহার দিকে কে টানিতেছে?” থিয়েটারে বসে আছেন একটা চিরকুট কি জানি কে রেখে গিয়েছে। মধু রায়ের গলিতে শ্রীরামকৃষ্ণ আসছেন। চিরকুট পড়ামাত্র তাঁর মধ্যে জেগে উঠল সে দিনের মতো প্রবল আকর্ষণ।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৪৭: গিরিশচন্দ্র চারজন লেখককে নিয়ে একরাতেই ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসকে নাটকের আকার দেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

গিরিশচন্দ্র এ ব্যাপারে লিখেছেন, “আমি যাইতে ব্যস্ত হইলাম, কিন্তু আবার ভাবিতে লাগলাম যে অজানিত বাটিতে বিনা নিমন্ত্রণে কেন যাইবো? ওই অজানিত সূত্রের টানে সে বাধা রইলো না। চলিলাম, অনাথবাবুর বাজারের নিকটে গিয়া ভাবিলাম যাইবো না, ভাবিলে কি হয়, আমায় টানিতেছে।”
সেই তীব্র আকর্ষণে রূপটি কিন্তু ফুটে উঠেছিল গিরিশচন্দ্রের বিভিন্ন নাটকের মধ্যে। যেমন নিমাই সন্ন্যাস নাটকে তিনি লিখলেন—
“আমার সাধ হয় সদা যাই গো ভেসে
কূলে আমায় কে আনে।
প্রাণের কথা প্রাণই জানে।”
গিরিশচন্দ্র তাঁর নাটকের অজস্র গানে নিজেকে উৎসারিত করে দিয়েছেন। ব্যক্তি জীবনের সুখ দুঃখ ভালবাসা নানাভাবে তাঁর বিভিন্ন নাটকে ছায়াপাত করেছে। রামকৃষ্ণ সান্নিধ্যে আসার পর তাঁর মানসিক উদ্বোধনের স্তর গুলিও নাট্য সংগীতে আকর্ষণীয়ভাবে ধরা পড়েছে। তাঁর গানগুলি বিশ্লেষণ করলে এই কথা সহজেই চোখে পড়বে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২২: সুন্দরবনে গোয়াল পুজো আর ‘ধা রে মশা ধা’

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২০: পাঁচ ভাইয়ের বড়দিদি

শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসার পর গিরিশচন্দ্রের প্রথম নাটক ‘নিমাই সন্ন্যাস’। সেই নাটকের গানে পতিত পাবনের প্রতি যেমন বিশ্বাসের চিত্রটি উদ্ঘাটিত হয়েছে, তেমনি দোলায়য়িত চিত্তে সংবাদ টুকুও বেরিয়ে এসেছে:
“ডাকে হে পতিত তোমায়
পতিতপাবন পুরাও সাধ
দীনের ঠাকুর কোথায় গৌরচাঁদ।
আমার সংশয়ে প্রান সদাই দোলে
দাও হে প্রেম সুধার স্বাদ।”
গিরিশচন্দ্রের বিখ্যাত নাটক ‘বুদ্ধদেব চরিতে’ গিরিশচন্দ্রের এই যে রূপটি তা যেন আরো সুন্দর করে ফুটে উঠেছে। বুদ্ধদেবচরিতে দেব বালাদের চরিত্র সংগীত নির্ভর। বুদ্ধের তাৎক্ষণিক মানসিক অবস্থার পরিচয় প্রদান অথবা বুদ্ধের প্রতি অলৌকিক নির্দেশের জন্যই এই চরিত্র পরিকল্পনা করা হয়েছে। দেববালাদের সুবিখ্যাত গান” জুড়াইতে চাই কথা জুড়ায় এইখানে বুদ্ধচিত্তের উদ্বোধক। তিনটি স্তরে গানটি পরিবেশিত হয়েছে। এই জায়গাটির লক্ষ্য করার মতো—
“কি কাজে এসেছি কি কাজে গেল
কে জানে কেমন কি খেলা হলো
প্রবাহের বারি রহিতে না পারি
যাই যাই কোথা কূল কি নাই?”
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৬: বুকে ব্যথা মানেই কি গ্যাসের ব্যথা? হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ না কি গ্যাসের ব্যথা, বুঝবেন কী ভাবে?

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৪: একটু হোক-ফোক!

শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাতেই গিরিশচন্দ্র যে তাঁকে চিনেছিলেন গিরিশচন্দ্রের এই ধারণা তাঁর অন্য রচনাতেও দেখতে পাই। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কবিতায় গিরিশ চন্দ্র বলছেন—
“চিনালে চিনিতে পারে, নহে অসম্ভব পুরুষ প্রধান।”

‘শাস্তি কি শান্তি’ নাটকের একটি গান রামকৃষ্ণ সঙ্গীত হিসেবে বিশেষভাবে প্রকাশিত:
“যদি স্মরণ নিতে পারি রাঙ্গা পায়
নাম নিলে তার হৃদয় ভরে,
কলঙ্ক কোথায় পালায়
যে জন করুণা যাচে (ঠাকুর) আসেন তাঁর কাছে
অভয়চরণ তার তরে আছে:
ডাকো পতিত, পতিতপাবন, তরবেনামের মহিমায়।”


এই বিশ্বাস তো সকলের হয় না কিন্তু গিরিশচন্দ্র ঘোষের এই বিশ্বাস ছিল ঠাকুরের প্রতি এবং ঠাকুরের আশীর্বাদও ছিল এই গিরিশচন্দ্রের উপরে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।