সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


মনচালি ও মনচালি গানে অমিতাভ। ছবি: সংগৃহীত।

মুক্তি পায় টিনু আনন্দ পরিচালিত ‘কালিয়া’ ছবিটি। এই ছবিতে গীতিকার হিসেবে কাজের দ্বায়িত্ব পান মজরু সুলতানপুরি। সুর রচনার ভার দেওয়া হয় পঞ্চমকে। নায়িকা পারভিন বাবি একটি পার্টিতে আশার গাওয়া ‘সানাম তুম যাহা’ গানটিতে লিপ দিচ্ছেন এবং নায়ক অমিতাভ বচ্চনকে প্রেম নিবেদন করছেন। এহেন একটি দৃশ্যের জন্য মজরুর লেখায় এক মুহূর্তেই সুর দিয়ে ফেলেন পঞ্চম। ক্যাবারের ছোঁয়ায় গানটি হয়ে ওঠে মায়াময়। আশা তাঁর গায়কীর মাধ্যমে আবারও সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন যে এই ধরনের গানে তিনিই পঞ্চমের একমাত্র পছন্দ।
‘যাহা তেরি ইয়ে নজর হ্যায়’ গানটিতে ছন্দের এক অদ্ভুত বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। গানটির একদম শুরুতে কানে আসে বলরুম ড্যান্সের তালে ভায়োলিন সহযোগে বেজে চলা একটি ছন্দ। কিন্তু আকস্মিক ভাবে যখনই নায়ক অমিতাভ দৃশ্যে আবির্ভূত হন, সঙ্গে সঙ্গেই পরিবর্তন হয় ছন্দের। এর পরই কানে ধরা পরে কিশোর কণ্ঠ। তারপরই আকষ্টিক গিটারের ছন্দে এগোতে শুরু করে গানটি। এবং পরবর্তীতে ট্রাম্পেট নিজের জায়গা তৈরি করে নেয়। গানটির বাকি অংশ জুড়ে রাজত্ব করে চলেন কিশোর কুমার।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩৬: দেখো ম্যায়নে দেখা হ্যায় ইয়ে এক স্বপ্না…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

এই ছবির আরও একটি কিশোর-আশার ধামাকা গান ‘তুম সাথ হো জব আপনে’। তিনটি অন্তরা বিশিষ্ট এই গানটিতে কিশোর এবং আশার অবদান তো বটেই, এমনকি বাদ্যযন্ত্রগুলির ব্যবহার, তাল, মাত্রা এবং তিনটি অন্তরার মাঝে দুটি ইন্টারলুড, প্রতিটি আমাদের একই ভাবে আকৃষ্ট করে। গানটি শোনার সময় কোনও বিঘ্ন আমরা যেন মেনে নিতে পারি না। এটি আক্ষরিক অর্থেই একটি ‘ফুট ট্যাপিং মিউজিক’। তাও আবার ১৯৮১ সালের মতো একটি সময়ে। যদিও সত্তরের দশক থেকেই বলিউড মিউজিক একটু একটু করে বদলাতে শুরু করেছিল তবু, আশির দশকের গোড়ায় এইরকম একটি চূড়ান্ত আধুনিকতায় মোড়া গানের জন্ম দিতে গেলে সাহস এবং আত্মবিশ্বাস দুয়েরই প্রয়োজন। যেটি পঞ্চম করে দেখিয়েছেন।
শক্তি সামন্ত পরিচালিত ‘বরসাত কি এক রাত’ ছবিটিতে কিশোর এবং লতার গাওয়া ‘আপনে পেয়ার কে স্বপ্নে সচ হুয়ে’ গানটি বোধহয় গায়ক গায়িকা দু’জনের জীবনেরই বহু অবিস্মরণীয় গানের মধ্যে একটি। এইরকম একটি মিষ্টি সুর এবং দৃশ্যে অমিতাভ এবং রাখিকে কণ্ঠদান করছেন যথাক্রমে কিশোর এবং লতা। পাহাড়ঘেরা একটি অঞ্চলের আবহে একটি পাহাড়ি ধুনকে আশ্রয় করে এগিয়ে চলে গানটি। আজকের দিনেও আপনি এই গানটি যতই শহুরে সভ্যতার কোলাহলের মাঝে বসে শুনুন, এটি আপনাকে এক মুহূর্তে আপনার দেখা কোনও একটি আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় পৌঁছে দেবেই।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৫: কানে তালায় কানের ড্রপ?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২২: সুন্দরবনে গোয়াল পুজো আর ‘ধা রে মশা ধা’

‘হায় ওহ পরদেশি’ গানটিতে শোনা যায় একটি অদ্ভুত ছন্দ। যেটির সিংহভাগ কৃতিত্ব দাবি করতে পারে তবলা, মাদল এবং আকস্টিক স্প্যানিশ গিটার। গানটির বিশেষ কিছু অংশে কানে আসে বাঁশি এবং অবশ্যই ভায়োলিন, অব্লিগেটোর আকারে। মাত্রাটি মন ছুঁয়ে যায়। কারণ, এটির জন্মদাতার নাম রাহুল দেব বর্মণ।

ভিলেন কলিরাম, অর্থাৎ আমজাদ খানের ঢোল ফেটে যাওয়ার আনন্দে নায়ক অমিতাভ এবং তাঁর দলবল এক সঙ্গে শুরু করেন গান সহযোগে নাচ। নেপথ্যে কিশোর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গায়কী এবং কণ্ঠাভিনয় দিয়ে মাতিয়ে রাখেন আমাদের, অর্থাৎ সমগ্র শ্রোতাদের। অমিতাভের বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দের অভিব্যক্তিকে চরম সাফল্যের সঙ্গে তুলে ধরেন কিশোর।
‘মনচালি ও মনচালি’ গানটি কিশোর-আশা জুটির চূড়ান্ত সাফল্যের আরো একটি নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয়। দৃশ্যে নায়িকা প্রেমা নারায়ণ এবং অমিতাভ বচ্চনের নাচের তালে তালে আশা এবং কিশোর এগিয়ে নিয়ে চলেন গানটিকে। গানটি শুনলে আমাদেরও একটু হলেও নাচতে ইচ্ছে হয় বইকি! উল্লেখ্য, এমন একটি ছন্দের গানেও অব্লিগেটো ব্যবহার করতে পিছপা হননি পঞ্চম। এটি যেন তার রক্তে মিশে গিয়েছিল।

‘নদীয়া কিনারে পে হামারা বাগান’ গানটির কি অসাধারণ মিষ্টি একটি সুর রচনা করা হয়েছে একবার ভাবুন। একটি পর্বতবেস্টিত অঞ্চলে চা বাগানের মধ্যে দাড়িয়ে নায়িকা রাখি লতার গাওয়া গানটিতে লিপ দিচ্ছেন। সেই চা বাগানে কর্মরতা শ্রমিকেরা করাসের আকারে গায়িকাকে সঙ্গত করছেন। সব মিলিয়ে একটি অপার্থিব সৌন্দর্য। দৃশ্য এবং গান, দুটি ক্ষেত্রেই।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৪: কুর্গের সবুজ দুর্গ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৯: ইষ্টদেবী জগদ্ধাত্রী

বস্তুত, এই ছবিটি একটি বাংলা ছবি ‘অনুসন্ধান’ এর হিন্দি সংস্করণ। প্রতিটি গানের সুর কম বেশি একই রেখে দুটি ছবিতেই ব্যবহার করেছেন আরডি। যথারীতি লতা-আশা-কিশোর, পঞ্চম এর প্রধান তিনটি তুরুপের তাস, তাঁদের স্থায়ী পদচিহ্ন রেখে গিয়েছেন স্বারক হিসেবে শুধুমাত্র আমাদের জন্য। আমরা কিশোর কুমার এবং লতা মঙ্গেশকরকে হারিয়ে ফেলেছি ঠিকই, কিন্তু আমরা যারপরনাই ভাগ্যবান এই কারনে যে আশা ভোঁসলে আজও রয়েছেন আমাদের মাঝে।

আজও তিনি নতুন প্রজন্মকে তাঁর অগাধ সঙ্গীত-জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। আজও তাঁকে আমরা যখন রিয়েলিটি শোগুলিতে তাঁর নির্দিষ্ট আসনটি আলো করে বসে থাকতে দেখি, খুব নিশ্চিন্ত মনে হয় নিজেদের। তখন একটি কথা ভেবে সত্যিই খুব ভালো লাগে যে ভারতীয় সঙ্গীতের এত বিবর্তনের মাঝেও আমাদের সঙ্গে এমন একজন আজও রয়েছেন যিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এবং আধুনিক সংগীত, দুটি ক্ষেত্রেই একই মাত্রায় পারদর্শী ছিলেন তাঁর মধ্যগগনে এবং পরবর্তী কালেও।

কেন? কারণ পঞ্চম এর সুর করা এমন বহু আধুনিকতার ছোঁয়া মাখানো গান তিনি গেয়েছেন যে গানগুলি আজকের দিনেও একই উত্তেজনার সঞ্চার করে যুবক যুবতীদের মনে। বার্ধক্যের ভার আজকের দিনে তাঁকে সংগীত পরিবেশনা থেকে বিরত রাখলেও তাঁর যে অপরিসীম জ্ঞানের ভাণ্ডার, সেটিই আমাদের কাছে মহামূল্যবান একটি সম্পদ। যেটি আমাদের সমৃদ্ধ করবে আগামীতেও। —চলবে
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content