ঠাকুরঘর। ছবি: প্রতীকী। সৌজন্য সত্রাগ্নি।
বিধি
সেদিন বাবার কথা শেষ হওয়া মাত্রই ঘরের কেউ কথা বলবার আগে সানন্দা বলে উঠলো—
—এটাতো ডিজাস্টার ঘটে গেল। কিন্তু ঋতুর কথা ভেবে বাড়ি থেকে বেশ কয়েকজনের এখনই ওর কাছে যাওয়া উচিত। ওকে এসব কিচ্ছু বলার দরকার নেই। এখন একটা বড় সাইকোলজিক্যাল সেটব্যাক হলে সেটা সামলানো যাবে না।
সবাই চুপ করেছিল। কারও কাছে কোন শব্দ নেই। ধীর গলায় বাবু বলে উঠলেন—
—একজন ডাক্তার হিসেবে তুমি যে মতামতটা দিচ্ছ সেটা তো মানতেই হবে। কিন্তু নন্দা-মা ঋতুকে তো খবরটা দিতে হবে। সেটা কবে দেবে? কিভাবে দেবে? কে দেবে সেই খবর?
এই তিনটে প্রশ্নের একটারও উত্তর কারও কাছে ছিল না। কিন্তু সকলকে অবাক করে স্বল্পভাষী মুমু মানে মৃন্ময়কান্তি বলে উঠল—
—তোমাদের আপত্তি না থাকলে আমি ঋতুকে বলবো । কখন জানানো উচিত হবে সে ব্যাপারে আমি নন্দার সঙ্গে কথা বলে নেব।
সমস্যা হল অন্যত্র। দুর্ঘটনায় মৃত্যু। শ্রাদ্ধাদি চতুর্থ দিনে সারতে হবে। কিন্তু সানন্দা, ঋতুর ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে জানালো, বেবির অ্যাডভান্স ডেলিভারি হয়েছে। ওকে দিন চার-পাঁচ অবসার্ভ না করে হসপিটাল থেকে রিলিজ করা যাবে না। তাহলে শ্রাদ্ধ কিভাবে হবে?
নাতির আচমকা মৃত্যু বড় জ্যাঠামনি-জেঠিমার মতই দাদু ঠাম্মিকেও মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। তারকবাবু এ বিষয়ে সব আলোচনা আমার মা আর বাবার সঙ্গে করতেন। তিনিই বললেন—
—জানেন অমলবাবু! আজ এরকম অবস্থায় মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে। জানি তাঁর নাতির ছেলে।প্রপৌত্রের শোক ভয়ংকর। তবু মনে হয় এখন মায়ের সামনে গিয়েই বোধহয় জিজ্ঞেস করতে পারতুম— “এখন কি করব আপনি বলুন মা।”
দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৪২: বসুন্ধরা ভিলায় এত নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে যা বলে বোঝানো যাবে না
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২২: সুন্দরবনে গোয়াল পুজো আর ‘ধা রে মশা ধা’
—শ্রাদ্ধ মুমু করবে। ঋতু আজ হাসপাতালে না থাকলেও মুমুই কাজ করত। ঋতু হয়তো একটা ভুজ্জি দিত। আমি ঠাকুরমশায়ের সঙ্গে কথা বলব। অসুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কোন উপায় আছে। ঋতু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে একটা পুজোর ব্যবস্থা করা যাবে। বড়ঠাম্মি কোনদিন গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেননি। মা-ও দেন না।
ঠাম্মি নিঃশব্দে মাথা ঝোঁকালেন। বেলা বাড়লে বসুন্ধরা ভিলা থেকে মা মেজ-জেঠিমা সুপ্রিয়া বৌদি – সকলে গিয়ে বেবিকে দেখে এসেছিল। সকলে যথাসম্ভব স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করেছিল। ঋতু এক দুবার জানতে চেয়েছিল তার স্বামী মানে তন্ময়কান্তিকে খবরটা দেওয়া হয়েছে কিনা। কারোও মুখে কোন জবাব নেই। এসব পরিস্থিতিতে যার ওপর আমরা সকলে নির্ভর করে সেই মায়ের মুখেও কোনও শব্দ উচ্চারণ হতে না দেখে সানন্দা সামাল দিয়েছিল—
—তোর বরকে জানিস তো সে ম্যাঞ্চেস্টার থেকে গ্রিস ঘুরে আসতে গিয়েছে।
মেজজেঠিমা কান্না চাপতে না পেরে কেবিন থেকে করিডরে পালিয়ে বেঁচেছিল। আর মা ফেরার পথে গাড়িতে আর নিজেকে সামলাতে পারেননি।
নিয়তির কি অদ্ভুত পরিহাস!
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৫: কানে তালায় কানের ড্রপ?
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
—এ জন্যেই মাকে বলতুম এত পুজোপাঠকোরো না। ভালোলোকের কথা ঈশ্বর শোনেন না। না হলে তনুর কি এটা চলে যাবার সময়? আমার মত একটা অকেজো অক্ষম লোক পড়ে থাকতে – একটা শক্ত সামর্থ্য সুস্থ সবল ছেলে এ ভাবে… বড়বৌদি তো সারাক্ষণ পুজোপাট নিয়ে পড়ে থাকে। কি প্রতিদান দিল তোমাদের ঈশ্বর।
অথচ সেই ন’কাকাই ঠাকুরঘরের চৌকাঠের ওপার থেকে একদৃষ্টে ঠাকুরঘরে প্রতিষ্ঠিত দেবদেবীর ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন। আস্তিক ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষের অভিমান হয়। ঈশ্বরের প্রতি মনে মনে অক্ষম ক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। তবুও ঈশ্বরই যে শেষ-আশ্রয়। তাঁকে অস্বীকার করার ক্ষমতা যে মানুষের নেই।
দাদুর অন্নপ্রাশনের দিন বাড়িতে অঘটন ঘটেছিল। দাদুর কাকা কৃষ্ণসুন্দরের নৌকাডুবিতে আচমকা মৃত্যু। তাঁর চতুর্থীর কাজ মিটিয়ে সেই রাতেই বসুন্ধরার স্বামী দেশান্তরি হষেছিলেন। তাই বড়ঠাম্মির অন্নপ্রাশনে মানা ছিল। তবে সনাতনী পুজোপার্বণ এ বাড়িতে মানা হয়। শিশুজন্মের পর ছয়দিনের দিন সন্ধ্যেবেলায় ঠাকুরঘরে ষষ্ঠী পুজো হয়। একে নাকি সূতিকাষষ্ঠী বলা হয়। পুরনোকালে আঁতুড়ঘরের বিধি। আসলে সংক্রমণরোধক একটা ব্যবস্থা। এই সময়টাকে শুভ-অশৌচ বলে। পাঁচদিন বাদে তবে নখকাটা হয়। মানে নখকাটার আগে স্নান করানোর জন্য মা বাদ দিয়ে বাইরের লোকের বাচ্চাকে স্পর্শ করা মানা। স্থিতাবস্থা বা “স্ট্যাটাস ক্যো” বজায় রাখা। ওপারবাংলার কোথাও কোথাও একে ‘পাঁচ উঠানি’ বলা হতো।
পরিযায়ী মন, পর্ব-১৪: কুর্গের সবুজ দুর্গ
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৯: ইষ্টদেবী জগদ্ধাত্রী
এ সব খুঁটিনাটি আমি মায়ের থেকে জেনেছি। খাস দেশপ্রিয়পার্কে বড় হয়ে ওঠা সুরঙ্গমা সেনগুপ্তের পক্ষে এ সব জানার সম্ভব ছিল না। তিনি কিছুটা জেনেছিলেন সিনেমা করার সুবাদে।আমার মায়ের অভিনীত ছবি শুভা’তে এসব রেফারেন্সেস ছিল। বাকিটা বড়ঠাম্মির কাছ থেকে।
আটদিনের দিন আমার মা সুরঙ্গমা আর নন্দার উপস্থিতিতে মুমু মানে মৃন্ময়কান্তি ঋতুকে সেই নিদারুণ সত্যিটা জানাবে ঠিক করেছিল। —চলবে