শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

নিজেকে জানতে চাওয়া নাকি জানানো? জানার নাকি কোনও শেষ নেই, জানানোর-ও। জ্ঞাপন মানে জানানো। কী জানাতে চান? বিজ্ঞাপন দিন।

বিড়াল হারানো-প্রাপ্তি থেকে পাত্র-পাত্রী, বিদেশযাত্রা, পড়তে চাই থেকে পড়াতে চাই, বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের ব্যাপার স্যাপার, খাবার থেকে ওষুধ, বাড়ি থেকে শাড়ি, চাওয়া-পাওয়ার নাড়িনক্ষত্র বিজ্ঞাপনে ধরা থাকে। কোন তেলটা কখন দরকার, কিংবা জলের রকমফের কিংবা ছুঁচোর বিষ থেকে সুরভিত ধূপকাঠি আপনার চারপাশে নিজেকে মেলে ধরেছে। আপনি শুধু দেখুন। এ-ও নিজেকে চেনার একটা পদ্ধতি। দর্শনে চারপাশের দ্রব্য-পদার্থের স্বরূপ জেনে জেনে বহু থেকে অখণ্ডে যাওয়ার পথ বাতলে দেয়। আমি, আমরা, তুমি, সে, তাহারা কেমন তা এভাবেই বুঝি জানতে হয়। অন্যের জানা ও জানানোর সাপেক্ষে নিজেকে বুঝে নেওয়াই এর মোক্ষম ধর্ম। বিজ্ঞাপন যখন নিজের কথা বলে, তখন জানতে হয়, সেটি পেলে আপনি বিচক্ষণ, না পেলে, না মানলে, না জানলে… ক্যাবলা।
বিজ্ঞাপনে কাজ দেয়? টাকা হয় নাকি টাকে চুল গজায়?

এই তো, টুসি ঘনশ্যামবাবুর ট্রামের মান্থলি হারিয়ে এল। ঘনশ্যাম ঘাই, জিএইচজিএইচ মার্কা টিকিটের খাপে কিছু খুচরো আর দুশো টাকাও ছিল। নাতি টুসি জানায় সিনেমা দেখতে গিয়ে সাত টাকা খুচরো বন্ধুকৃত্যে ব্যয় হয়েছে, যদিও দাদুর মান্থলি নেওয়া বে আইনি তবুও, দাদুর পকেট মেরেই সে সিনেমা দেখেছে। এখন অবশ্য তার পকেট মার গিয়েছে।

দাদু অতিশয় খাপ্পা হয়ে ঘোষণা করেন, টুসিকে তিনি ত্যজ্য করবেন। নাতি হলেও ত্যাগ করবেন, তার জন্য খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে লোককে জানিয়ে দেবেন।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৩: বাড়ির কাজের লোককে নিজের সম্পত্তির অধিকার দিতে দ্বিজেন্দ্রনাথ দলিল পাল্টেছিলেন

দাদুর বিষয় আশয় থেকে একেবারে বঞ্চিত হবে টুসি, তাতে অবশ্য তার কিছু এসে যায় না। বিষয়ের বিষ নয়, দাদুর পকেট ছাড়া আর কিছুতেই তার লক্ষ্য নেই। ঘনশ্যামবাবু নাতিকে জব্দ করতে চান। পুঁচকে নাতি হলেও তাকে সত্সঙ্গ দিতে এই ব্যবস্থা বলবত্ হলে, ছেলেটি শুধরে যাবে নিশ্চয়ই। নাতিবৃহত্ ব্যাপার হলেও, এজন্য বিজ্ঞাপন একটা দিতেই হয়।

সুতরাং ব্যাপার দাঁড়ায় “To see or not to see?”

টুসি জানায়, এর সঙ্গে টিকিট হারানোর বিজ্ঞাপনটা দিলেও কাজ হতে পারে, কারণ, দাদুর ব্যথার ওষুধ আনতে গিয়ে সে যেবার হারিয়ে গিয়েছিল, সেবার বিজ্ঞাপনে কাজ দিয়েছিল।
বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসবে চয়েস, স্বাচ্ছন্দ্য আর লাভের প্রশ্ন। ন্যায্যমূল্যে কিংবা বিনামূল্যে কোনটা পাবেন, কতো লাভ করে আপনি ক্রেতা হিসেবে কতোটা উপকৃত হচ্ছেন, কতোটা বেছে নিতে পারছেন চটকদার অথচ টেকসই অভীষ্ট বিষয়, বিজ্ঞাপন আপনাকে সেটা বুঝিয়ে দেবে। এই খাবার বা তেল কিংবা ওষুধটা আপনার কেন চাই, অথবা ওই টিভি, গাড়ি কিংবা পেনসিলটা কেন আপনার লাগবেই, কেন জীবন বিপন্ন করে হলেও, আপনাকে তা পেতেই হবে, জীবন বিপন্ন হলে আপনার জন্য পরিষেবা নিয়ে কী কী অপেক্ষা করছে, এসব আপনাকে বিজ্ঞাপন বলে দেবে। আপনার ব্যয় কীভাবে লাঘব হবে তার খোঁজ বিজ্ঞাপনে, সেই বেঁচে যাওয়া অর্থে আপনি কী করবেন তাও বিজ্ঞাপন বলে দেবে। কে বলেছে বিজ্ঞাপনে কাজ হয় না?
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৮: ইষ্টদর্শন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২১: সুন্দরবনের সর্পদেবী মনসা

আপনার ওঠা-বসা, খাওয়া-শোওয়া, চলা-বলা, দেখা ও শোনা কেমন হবে, কোন্ সানগ্লাস আপনার চোখে থাকবে, কোন্ জলে আপনার তৃপ্তি, কোন্ পাখার বাতাসে, কোন্ শীতাতপ যন্ত্রে আপনার সর্বোত্কৃষ্ট সাফল্য তা একমাত্র বিজ্ঞাপন ঠিক করে দেয়। আপনার ত্বকের যত্ন, চুলের পরিচর্যা, দাঁতের ঔজ্জ্বল্য বাড়বে… বিজ্ঞাপন আছে। আপনিও বাড়বেন দরকার মতো… বিজ্ঞাপন আছে যে। আপনার জীবনের ভালো মন্দ বিজ্ঞাপন ঠিক করে দেবে মেপে মেপে… মশা মাছি আরশোলা থাকবে না, আপনি পাবেন সেরাটা, সেরা হাওয়া, জল, পরিবেশ, স্বপ্ন নইলে আপনি জানবেন কী করে? শুধু তাকিয়ে দেখো, পাশের বাড়ির এক্স ওয়াই থেকে ফিল্মের পর্দার জেড সকলকে শুধু অনুসরণ করো, প্রাপ্য বরান্ নিবোধত…
বিজ্ঞাপন, নিজেকে বিশেষভাবে জানানো। তার দরকার আছে বৈকি! বিজ্ঞাপন ছিল বলেই হারানো-প্রাপ্তি, বিজ্ঞাপিত হয় বলেই অন্যের কাছে যেটা তেমন কিছু নয়, সেটাই আপনার অন্ধের যষ্টি হতে পারে, বিজ্ঞাপন ছিল বলেই কতো অজানাকে জানা, কতো জানাকে বিশেষ করে জানা-চেনা-বোঝা, বিজ্ঞাপনে যেটা ঝকঝকে সেটা হয়তো আরও বেশি মনের মতো, বিজ্ঞাপন ছিল-আছে-থাকবে বলেই অনেক ভুলকে চেনা, ভুলতে পারা যায়, অনেক আধাকে পুরোপুরি, আর, সাদাকে “ততটাও সাদা নয়” বলে জানতে পারা যায় বৈকি!
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৪: পানমশলা খেলে ক্যানসার হয়?

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৩: টাকির ভাসানের ব্যথা

তাই বিজ্ঞাপন দিতে সংবাদপত্রের অফিসে চলে আসেন টুসির দাদু। সেখানে দেখা পেয়ে যান বন্ধু বটকেষ্টর। তাঁর সমস্যা নাতিবৃহত্ না হলেও কম গুরুতর নয়। তিনি এসেছেন কুকুর হারানোর জন্য দেওয়া বিজ্ঞাপন ফিরিয়ে নিতে। কারণ কুকুর ফেরত এসেছে, নিজে থেকেই। কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনে বড় অঙ্কের আর্থিক পুরস্কার থাকায় অফিসের সকলেই চলে গিয়েছে কুকুর খুঁজতে, খুঁজে পাওয়াও গিয়েছে কুকুর, তাঁরা প্রত্যেকেই খুঁজে পেয়েছেন একটি করে কুকুর, ফিরে এসেছেন কুকুর নিয়ে এবং, বিজ্ঞাপনদাতাকে পেয়ে পুরস্কার দাবি করছেন। এই ঝামেলা মিটতে না মিটতেই আরেক আগন্তুক এসে বিজ্ঞাপন দিতে চান। সমস্বরে সকলে জানায়, কুকুর হারানোর বিজ্ঞাপন নেওয়া হয় না। কিন্তু তিনি এসেছেন ট্রামে পাওয়া হারানো টিকিটের মালিকের খোঁজে বিজ্ঞাপন দিতে। সেই খরচ আর করতে হয় না, মালিক স্বয়ং হাজির, জি এইচ জি এইচ। দুয়ে দুয়ে চার হয়, দাদুও বেঁচে গেলেন বিজ্ঞাপন দেওয়ার থেকে। বিজ্ঞাপন না দিলে, কেবল দিতে চাইলেই কাজ হয়! নাতি বলেছিল বটে। ভারি বুদ্ধিমান সে, অমন ছেলে আর হয় না যে! একেই বলে মধুরেণ সমাপয়েত্…
বিজ্ঞাপনে কাজ হয় বৈকি! এটা মানলেই আপনি যথার্থ বিচক্ষণ, নাহলে, নেহাত্ ক্যাবলা!!

ঋণ স্বীকার:
শিব্রাম চকরবরতির ‘বিজ্ঞাপনে কাজ দেয়’ অবলম্বনে
শিরোনাম: সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান থেকে
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content