বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ সন্তান তিনি। রবীন্দ্রনাথের ‘বড়দা’। নানা দিকে ছিল তাঁর আগ্রহ, মনোযোগ। সাহিত্যে, সংগীতে, এমনকি গণিতেও অভাবনীয় পারদর্শিতা। সাহেবসুবোরাও তাঁর পারদর্শিতার প্রমাণ পেয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল। তিনি ছিলেন স্বরলিপির উদ্ভাবক, স্বরলিপির সফল রূপকার। গান কখনও কণ্ঠে ধারণ করেননি, রবীন্দ্রনাথের লেখায় আছে, ভালো বাঁশি বাজাতেন তিনি। দেশজ বাঁশি নয়, বিলিতি বাঁশি।

আত্মমগ্ন এই মানুষটি ছিলেন স্বভাব-উদাসীন। দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক কিছুই করে ফেলতেন, যা হাসির রসদ জোগাত। সরসতায় ভরপুর সেই দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে আত্মমগ্ন দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথকে মেলানো যায় না। রবীন্দ্রনাথ দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ রচনার সাক্ষী। ‘জীবনস্মৃতি’তে আছে, ‘বড়দাদা তখন দক্ষিণের বারান্দায় বিছানা পাতিয়া সামনে একটা ছোট ডেক্স লইয়া স্বপ্নপ্রয়াণ লিখিতেছিলেন। … লিখিতেছিলেন আর শুনাইতেছেন, আর তাঁহার ঘন ঘন উচ্চহাস্যে বারান্দা কাঁপিয়া উঠিতেছে।’
সন্দেহ নেই যে, এক অভাবনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ লেখার সময়। বারবার ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’-এর পাঠ শুনে কাব্যের কিছু কিছু অংশ রবীন্দ্রনাথের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ কবিকে অবশ্য প্রভাবিত করেনি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বড়দাদার আশ্চর্য ভাষা, তাঁহার বিচিত্র ছন্দ, তাঁহার ছবিতে ভরা পাকা হাতের রচনা আমার মত বালকের অনুকরণ চেষ্টারও অতীত ছিল।’

দ্বিজেন্দ্রনাথকে নিয়ে রকমারি গল্প ছড়িয়ে রয়েছে। সুপন্ডিত, দার্শনিক ও কবি, তাঁর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে রাশভারী ব্যক্তিত্বের সামান্যও ছাপ ছিল না। বরং সারল্য ছিল পরতে পরতে। শিশুর মতো সরল, মনের কোণে ছিটেফোঁটাও জটিলতা, প্যাঁচপয়জার ছিল না। বেহিসেবি, ঘোরতর খেয়ালি, আত্মমগ্ন ও আপনভোলা মানুষ। দ্বিজেন্দ্রনাথকে নিয়ে সুধাকান্ত রায়চৌধুরী একটি বই লিখেছিলেন। সুধাকান্ত ছিলেন ব্রহ্মচর্চাশ্রমের প্রথমযুগের ছাত্র। পরে আশ্রমে চাকরি করেছেন। কখনও ছাত্রাবাসের পরিদর্শক, কখনও বা রন্ধনশালার পরিদর্শক। বিভিন্ন অশিক্ষকপদের চাকরি করেও তিনি নিজেকে গড়েছিলেন। শেষ-জীবনে হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের একান্ত সচিব।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২১: সুন্দরবনের সর্পদেবী মনসা

দ্বিজেন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন সুধাকান্ত। তাঁকে নিয়ে একটি বইও লিখেছিলেন। বইটিতে আছে কত না মজাদার ঘটনা! সেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে আপনভোলা মানুষটিকে চিনে নেওয়া যায়। তেমনই একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। দ্বিজেন্দ্রনাথ একদিন মগ্ন হয়ে কাজ করছিলেন। লেখাপড়ার কাজ। কাজ করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। বিষয়ের গভীরে পৌঁছতে বে-খেয়ালে চোখের চশমা কপালে তুলে রেখে যে ভাবনায় ডুব দিয়েছেন, তা আর পরে মনে থাকেনি। খানিক পর সামনে রাখা কলম আবার হাতে তুলে নিতে গিয়ে ঘটে বিপত্তি। লেখার কাজ শুরু করবেন বলে তৈরি হয়েও লিখতে পারেননি। কোথায় চশমা, চোখে তো চশমা নেই! চশমা ছাড়া কী করে লিখবেন! বড়ো মুশকিলে পড়েছিলেন। মুশকিলে পড়লেই তিনি হইহই বাঁধিয়ে দিতেন।

সেদিনও তেমনই ঘটেছিল। ‘আমার চশমা গেল কোথায়’—এই কথা বলে দ্বিজেন্দ্রনাথ হইহই বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। কাছেই ছিল বাগানের মালি, তার নাম গোষ্ঠ। ‘কী হয়েছে, হুজুর?’ দৌড়ে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ।

দ্বিজেন্দ্রনাথ চশমার কথা বলতেই গোষ্ঠর নজরে পড়ে, তা রয়েছে তাঁরই কপালে। সে কথা জানাতে যতবার চেষ্টা করে, ততবারই ব্যর্থ হতে হয় তাকে। হইচই শুনে শেষে ছুটে আসে মুনীশ্বর। মুনীশ্বর ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথের বিশ্বস্ত ভৃত্য, সর্বক্ষণ দেখাশোনা করতেন। বলা যায়, পার্শ্বসহচর। মুনীশ্বর এসে কী করেছিল, কীভাবে দ্বিজেন্দ্রনাথকে শান্ত করেছিলেন, কেমন করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছিল, সে বিবরণ আছে সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর স্মৃতিকথায়। রবীন্দ্রনাথের ‘বড়দা’কে সুধাকান্ত বলতেন ‘বড়োবাবু’। তাঁর লেখায় আছে, ‘সৌভাগ্যক্রমে তাঁর পরিচয় শুনে মুনীশ্বর তার বাড়িতে দৌড়ে এসে বড়োবাবুর ঘরে ঢুকেই কোনও কথাবার্তা না বলে বড়োবাবুর চেয়ারের পেছনে গিয়ে চট করে দু-হাত দিয়ে আস্তে আস্তে চশমাটি বড়োবাবুর নাকে পরিয়ে দিলে। অমনি বড়োবাবু রাগের আগুনে জল পড়ল।’
গোষ্ঠকে বকা দিতে ছাড়েননি দ্বিজেন্দ্রনাথ। বলেছেন, ‘এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট না করে বলতেই পারতে চশমাটা কোথায় আছে! তুমি তো দেখতেই পাচ্ছিলে চশমা কোথায় আছে! যাও, নিজের কাজ কর গিয়ে।’ সে যে কতবার বলার চেষ্টা করেও বলতে পারেনি, তা অবশ্য জানানো হয়নি দ্বিজেন্দ্রনাথকে।

দ্বিজেন্দ্রনাথ গোষ্ঠকে শুধু বকাঝকা করতেন‌ না, মুনীশ্বরকেও বকতেন। বাদ পড়তেন না তাঁর আপ্তসহায়ক অনিল মিত্রও। মুখে বকাঝকা করলেও তাদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এ ভালোবাসা কত গভীর ছিল, বোঝা যেত নানা ঘটনায়। আপনভোলা এই মানুষটি আর যাই হোক, বিষয়সম্পত্তি, বৈষয়িক ব্যাপারস্যাপার কিছু বুঝতেন না, আপাতভাবে এমন মনে হতে পারে। এমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৪: পানমশলা খেলে ক্যানসার হয়?

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৩: টাকির ভাসানের ব্যথা

দ্বিজেন্দ্রনাথের তখন অনেক বয়েস হয়েছে। বয়সের ভারে খানিক কাবুও হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বিষয়-সম্পত্তি কে, কতখানি পাবে তা নিয়ে খসড়া-উইল তৈরি করা হয়েছিল। উইলের খসড়া তৈরির সময় সকলেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, দ্বিজেন্দ্রনাথ উইল তৈরি, সম্পত্তি-ভাগের কথা শুনলে রাগ করবেন, উত্তেজিতও হতে পারেন!

এই আপনভোলা মানুষটি ভেতরে ভেতরে কতখানি বাস্তববাদী, তা এই ভাগ-বাটোয়ারার পরিপ্রেক্ষিতেই টের পাওয়া গিয়েছিল। তিনি যখন থাকবেন না, সে সময়ের কথা ভেবে তাঁর প্রিয়জনরা হিসেবনিকেশ করতে বসেছেন। সে সব জানার পরও দ্বিজেন্দ্রনাথের মধ্যে কোনও ভাবান্তর দেখা যায়নি। তাঁর বাস্তবতাবোধ, বাড়ির কাজের লোকের প্রতি গভীর মমত্ব-ভালোবাসা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, যা আমাদের অভিভূত করে।

দ্বিজেন্দ্রনাথ : শিল্পীর তুলিতে।

সত্যেন্দ্রনাথ-জ্ঞানদানন্দিনীর সন্তান সুরেন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে একজন ব্যারিস্টারকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে এসেছিলেন। নিশ্চিত ছিলেন তিনি, বিষয়-সম্পত্তি সম্পর্কে নিরাসক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঔদাসীন্য দেখাবেন। শুধু সুরেন্দ্রনাথের নয়, দ্বিপেন্দ্রনাথেরও তেমন মনে হয়েছিল। না, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঔদাসীন্য দেখাননি। মনোযোগ দিয়ে খসড়া- কপি দেখেছিলেন। দেখে বলেছিলেন, ‘এ ঠিক হয়নি, এর মধ্যে অনেক কিছু বাদ পড়ে গেছে, এগুলো না সংশোধন করলে পরে এই উইল নিয়ে অনেকের অনেক অসুবিধা হতে পারে।’
দ্বিজেন্দ্রনাথ উইলের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখেছিলেন। দেখার পর কিছু ত্রুটিও খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই ত্রুটি কীভাবে অতিক্রম করা যায়, সে পথও বাতলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তাঁর আপ্তসহায়ক অনিল মিত্র, কাজের লোক গোষ্ঠ ও মনীশ্বরের প্রাপ্য স্পষ্ট করে বলা হয়নি। কোথাও কোথাও তা ঝাপসা রয়ে গিয়েছে। পরে এই অস্পষ্টতা থেকে তাদের নানা অসুবিধা তৈরি হবে। এই তিনজনের অধিকার ও প্রাপ্য স্পষ্ট করে দিতে হবে। দ্বিজেন্দ্রনাথের কথা মতো উইলটির সংশোধন করা হয়েছিল। সংশোধন করার পর তিনি আবারও খুঁটিয়ে দেখেছিলেন, তারপরে স্বাক্ষর করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৮: ইষ্টদর্শন

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির

দ্বিজেন্দ্রনাথকে আমরা যদি এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবল বৈষয়িক ভেবে বসি, তবে তা ভুল ভাবা হবে। আসলে যারা দ্বিজেন্দ্রনাথের পাশে থাকত সারাক্ষণ, প্রকৃতঅর্থে পার্শ্বসহচর, তাদের প্রতি কতখানি ভালোবাসা ছিল তাঁর, তা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়। একসময় তিনি শিলাইদহে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সে সময় দ্বিজেন্দ্রনাথ খাজনা আদায়ে যতখানি না তৎপর হয়েছিলেন, তার থেকে ঢের বেশি তৎপরতা দেখাতেন, প্রজারা কে, কেমন অবস্থায় আছে, তা জানার ব্যাপারে। অধিকাংশই গরিব প্রজা, তাদের অনাদায়ী খাজনা দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রায়শই মকুব করে দিতেন। এর কারণেই তাঁকে বেশিদিন এই দায়িত্বে রাখা হয়নি। গরিব প্রজাদের দান-খয়রাতি করতেই অনেক অর্থ খরচ হয়ে যেত।

দ্বিজেন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকা।

প্রজাদের মধ্যে যারা গরিব নয়, তারাও নানাভাবে চালাকি করে আর্থিক সুবিধা নিত। এর ফলে জমিদারি পরিচালনাই শক্ত হয়ে উঠেছিল। দু-চারজন কর্মচারী দ্বিজেন্দ্রনাথকে তা বোঝানোরও চেষ্টা করেছিল। অত শত বুঝতে চাননি দ্বিজেন্দ্রনাথ। তাঁর মনে হয়েছিল জমিদারের ষোলোআনা স্বার্থ-রক্ষা করা আর প্রজাদের সব অভাব- অভিযোগের প্রতিকার করা একসঙ্গে সম্ভব নয়। শেষে নিরুপায় হয়েই দ্বিজেন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে ফিরে গিয়েছিলেন।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content