রবিবার ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫


নেতিধোপানিতে প্রাচীন মনসা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: সংগৃহীত।

বর্তমান সুন্দরবনে লৌকিক দেবদেবীদের গুরুত্ব ক্রমশ কমলেও একমাত্র যে দেবীর গুরুত্ব একটুও কমেনি, বরং ক্রমবর্ধমান তিনি হলেন সর্পদেবী মনসা। সুন্দরবন হল সাপসঙ্কুল এলাকা। যেহেতু এখনও প্রতি বছর প্রচুর সংখ্যক সুন্দরবনবাসী বিষধর সাপের দংশনে প্রাণ হারান তাই সাপ নিয়ে এলাকার আপামর মানুষের মনে রয়েছে প্রবল সর্পভীতি। আর সেই ভীতি থেকেই মনসা দেবীর আরাধনা ক্রমবর্ধমান।
মনসা দেখতে কিন্তু খুব সুশ্রী হলেও তাঁর বাম চোখ কানা। গায়ের রং হরিদ্রাভ। চারটি হাত। উপরের দু’হাতে পদ্মফুল, আর নিচের দু’হাতে সাপ। তবে অনেক প্রতিমায় পদ্মফুল ও সাপ ভিন্ন হাতে থাকতেও দেখা যায়। আবার কখনও এক হাতে থাকে বরাভয় মুদ্রা। তাঁর বাহন হাঁস। তিনি কোথাও হাঁসের উপর বা কোথাও পদ্মফুলের উপরে আসীন। তাঁর মাথার উপরে সাধারণত সাতটি সাপকে ফণা মেলে থাকতে দেখা যায়। কোথাও থাকে পাঁচটি সাপ। কোনও কোনও মূর্তিতে তাঁর কোলে বা পাশে একটি শিশুপুত্র দেখা যায়। সে হল তাঁর পুত্র আস্তিক।

মনসা দেবীর পুজো হয় না এমন বাড়ি সুন্দরবন এলাকায় মেলা প্রায় অসম্ভব। বছরে শুধু একবার নয়, কোনও কোনও গৃহস্থবাড়িতে নিয়ম করে নির্দিষ্ট তিথিতে একাধিকবার পুজোও হয়। এ ব্যাপারে আমার শৈশব স্মৃতি খুব উজ্জ্বল। আমাদের বাড়িতে বছরে দু’বার মনসা দেবীর পুজো হত। একবার অম্বুবাচী, আর একবার দশহরা তিথিতে। অম্বুবাচী তিথি থাকে তিনদিন – আষাঢ় মাসের প্রথম শুক্লপক্ষে চতুর্থী থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত। পুজো হত পঞ্চমীতে। এই সময় আমাদের উঠোনে তুলসি মঞ্চের পাশে হত মনসা পুজো।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২০: সুন্দরবনের বসন্ত রোগ নিরাময়কারী দেবী শীতলা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৪: পানমশলা খেলে ক্যানসার হয়?

একটা মাটির তাল রেখে তাতে মনসা গাছের একটা ছোটো শাখা পুঁতে দেওয়া হত। আর নরম মাটি দিয়ে তৈরি করা হত তিনটে বা পাঁচটা সাপ। এই সাপ তৈরি করার দায়িত্ব থাকত আমার উপরে। ফণাযুক্ত সাপ তৈরি করতাম। প্রতিটি সাপের লেজ ছুঁয়ে থাকত মনসা গাছের শাখা পোঁতা কাদার তালে। প্রসাদ হত পাকা আম ও কাঁঠালি কলা চটকানো দুধ। মাটির সরায় রাখা হত প্রসাদ। ওই মাটির সাপের মাথায় একটু করে প্রসাদ ঢেলে দেওয়া হত। পুজোয় কিন্তু ধুনো বা ধূপ জ্বালানো নিষিদ্ধ। কারণ জানতে চেয়ে মা-ঠাকুমার মুখে শুনেছি যে মনসা নাকি খুব বদরাগী দেবী এবং উনি ধুনো ও ধূপের গন্ধ পছন্দ করেন না। কোনও সধবা মহিলাকেই নাকি পুজো করতে হয়। তাই আমার মা পুজো করত। আর পুজোর শেষে আম-কলা-দুধের প্রসাদ ছিল আমার কাছে অমৃতসমান। শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে দশহরা তিথিতেও একই নিয়মে করা হত মনসা পুজো। তবে তখন সাপ তৈরি করা হত দশটা। যেহেতু বর্ষাকালে সুন্দরবন অঞ্চলে সাপের উপদ্রব অনেক বেড়ে যায় তাই আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে হয় মনসা পুজো।
দশহরা ও অম্বুবাচী ছাড়া গৃহস্থ বাড়িতে ধুমধাম সহকারে মনসা পুজো করা হয় বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এই পুজো রান্না পুজো নামে বেশি পরিচিত। রান্না পুজোর বিশেষত্ব হল অরন্ধন। অর্থাৎ বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাড়িতে উনুন জ্বালানো হবে না। ফলে রান্নাও হবে না। তাই আগের রাতে রান্নার কাজ সেরে রাখতে হয়। উনুনকে মনে করা হয় মনসার প্রতীক। গ্রামাঞ্চলে ইদানিং মাটির উনুনের ব্যবহার কমে এলেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রায় সব বাড়িতেই ছিল মাটির উনুন। তাই মাটির উনুনকে পুজো করে তবেই মনসার ভোগ অর্থাৎ ভাতসহ পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করা হয়। পুজো হয় শালুক ফুল দিয়ে। উনুন গোবর দিয়ে ভালো করে নিকোনো হয়। তারপর উনুনের সামনে মনসা গাছের শাখা পোঁতা হয়। সামনে থাকে মনসার প্রতীক হিসেবে ঘট। রাত জেগে বাড়ির সদস্যরা তরিতরকারি, মাছ ইত্যাদি কেটে, মশলা বেটে রান্নার কাজে সাহায্য করে। ঘটি অর্থাৎ এপার বাংলার মানুষের মধ্যে রান্না পুজোর প্রচলন দেখা যায়।

রান্না পুজোর নানা পদ। ছবি: সংগৃহীত।

তবে এপার বাংলার সবার বাড়িতে নয়। আমাদের পরিবার এপার বাংলার হলেও রান্না পুজোর প্রচলন নেই। তবে প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে নেমন্তন্ন পেতাম। এখনও পাই। রান্না পুজো মানে পান্তা থাকবেই। আগের রাতে শাঁখ বাজিয়ে খড়ের নুড়ো জ্বালিয়ে মাটির হাঁড়িতে আতপ চালের ভাত রান্না করে তা জল দিয়ে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন বাড়ির সবাই এবং আত্মীয় ও নিমন্ত্রিত লোকজনকে পান্তা খাওয়ানোই রান্না পুজোর বিশেষত্ব। ঝুরো করে মুগডাল ভাজাসহ আলু, পটল, কাঁচকলা, কুমড়ো, বেগুন ইত্যাদি সাত রকমের ভাজা, কুমড়ো বা লাউয়ের ঘন্ট, ইলিশ মাছের মাছের মাথা দিয়ে কচুশাকের ঘন্ট, ইলিশ ও চিংড়ির পদ, চালতার চাটনি, মালপোয়া, তালের বড়া, পায়েস— অধিকাংশ পরিবারে রান্নাপুজোয় এগুলো থাকবেই। রান্না শেষ হলে কলাপাতায় এইসব পদ সুন্দর করে সাজিয়ে মনসাকে নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। উনুন ঠান্ডা হলে তাতে শালুকের মালা পরানো হয়। পরের দিন উনুনে আগুন ধরানো নিষিদ্ধ। মাছসহ রান্না করা পদ দিয়ে পুজো করার প্রথা প্রমাণ করে যে মনসা হলেন আসলে লৌকিক দেবী।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৩: টাকির ভাসানের ব্যথা

রিভিউ: ‘জানে জাঁ ‘উত্তর ফাল্গুনী’র কথা মনে করিয়ে দেয়

গৃহস্থ বাড়ি ছেড়ে আসি মন্দিরের কথায়। সুন্দরবন অঞ্চলের অধিকাংশ গ্রামে রয়েছে এক বা একাধিক মনসার থান। বিশালাক্ষী বা শীতলা দেবীর সাথে কিংবা উভয়ের সঙ্গে মনসা দেবীকে বহু মন্দিরে অধিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। আবার মন্দির না থাকলেও ইদানিং মনসার বারোয়ারী পুজোও হচ্ছে মণ্ডপ তৈরি করে। পৌরাণিক দেবদেবীর কথা বাদ দিলে একমাত্র মনসা ছাড়া আর কোনও লৌকিক দেবদেবীর বারোয়ারী পুজো কিন্তু সুন্দরবনে হয় না। মনসা পুজো উপলক্ষে হয় মেলাও। সাগরদ্বীপে নাগ সরোবর ময়দানে প্রতি বছর নভেম্বর মাসে মনসা পুজোর সঙ্গে সাত দিন ব্যাপী বসে নাগমেলা। গোসাবার কচুখালিতে মনসা পুজো উপলক্ষ্যে বিশ্বকর্মাপুজোর দিন থেকে সাত দিন ধরে মেলা চলে। গোসাবা ব্লকের জটিরামপুরের মনসা মেলাও অনেক পুরনো মেলা।
এ বার মনসাদেবীর পরিচয় জানা যাক। একথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে ভারত বহুকাল আগে থেকেই নানা প্রজাতির সাপের বাসভূমি। এইসব সাপের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি তীব্র বিষধর সাপ। ফলে সর্পাঘাতে মৃত্যুর ঘটনা আর্যোত্তর ভারতবর্ষেও হামেশাই ঘটত। স্বাভাবিকভাবেই সাপের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য অনার্য ও অবর্ণ হিন্দু ভারতবাসী সাপের দেবীর পুজা শুরু করে। একইভাবে প্রাচীন মিশরীয়রা সর্পদেবী রেনেনুটেট ও মেরেতসেগার, প্রাচীন গ্রিসের অধিবাসীরা সর্পদেবী স্থেনো, ইউরিয়েল ও মেডুসার আরাধনা করত।

মানুষের বিশ্বাস ছিল সর্পদেবীকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তিনি সাপের দংশন থেকে মানুষকে রক্ষা করবেন এবং সর্প দংশিত ব্যক্তির প্রাণ রক্ষা করবেন। আদিম টোটেম সংস্কৃতি অনুযায়ী মানব-মানবীর প্রতিরূপ নয়, গাছ-মাটির ঢেলা-পাথর খণ্ড ইত্যাদিকে দেব-দেবী জ্ঞানে পূজো করা হত। আমরা দেখি মনসার প্রতীক হিসেবে মনসা গাছ ও উনুন, এমনকি মাটির ঢেলা এখনও পূজিত হয়। ভারতে আর্যদের আগমনের পর যেভাবে বহু অনার্য দেবদেবীর আর্যীকরণ ঘটেছে ঠিক সেভাবেই মনসা পৌরাণিক দেবদেবীর পরিবারের সদস্য হয়েছেন। তবে তার জন্য মনসাকে পেরোতে হয়েছে কঠিন পথ, করতে হয়েছে কঠিন লড়াই।

(বাঁ দিকে) পাথরপ্রতিমায় দক্ষিণ শিবগঞ্জ মনসা মন্দিরে প্রতিমা। (মাঝে) পাথরপ্রতিমা অচিন্ত্যনগরে মনসা মন্দিরে প্রতিমা। (ডান দিকে) সাগরদ্বীপে মনসা মন্দিরে প্রতিমা। ছবি: সংগৃহীত।

মনসার উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা ধারণা ও কাহিনি। বৌদ্ধতন্ত্র সাধনামালায় ‘জাগুলি’ বা ‘জাঙ্গুলি’ নামে যে দেবীর কথা রয়েছে তিনি চার হাত ও সুশ্রী মুখাবয়ব বিশিষ্টা সর্পদেবী। সাপ ও বাদ্যযন্ত্র বীণা তাঁর সঙ্গী। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে জাগুলি থেকেই মনসার উদ্ভব। জাঙ্গুলি মানে হল ‘বিষের জ্ঞানসম্পন্ন’। বিপ্রদাস পিপিলাই ‘মনসাবিজয়’ কাব্যে মনসাকে ‘জাগুলি’ নামে অভিহিত করেছেন। লোকগবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, মহাযান বৌদ্ধমতে জাগুলি বা জাঙ্গুলি দেবী থেকেই মনসার উদ্ভব। নদীয়া জেলার হরিণঘাটা ব্লকে বড় জাগুলি ও উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাত মহকুমায় ছোট জাগুলিয়া গ্রামের নামের সঙ্গে বৌদ্ধদেবী জাগুলির কোনও সম্বন্ধ রয়েছে কিনা তা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২১: আমার চোখে তো সকলই শোভন

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির

পুরাণে মনসার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্ত্ পুরাণ ও ভাগবত পুরাণে যা লেখা হয়েছিল দশম শতাব্দীর পরে। দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটকে এক লৌকিক সর্পদেবী হলেন ‘মনচাম্মা’। কোথাও কোথাও মুদাম্মা বা নাগাম্মা নামেও তিনি পূজিতা হন। কর্ণাটক থেকে পূর্ব ভারতে এসে হিন্দু সেন রাজারা একাদশ-দ্বাদশ শতকে রাজত্ব বিস্তার করলে সম্ভবত তাঁদের মাধ্যমেই মনচাম্মা বঙ্গদেশ ও অসমে আসেন এবং এখানে ‘মনসা’ নামে পরিচিতিলাভ করেন। ভাগবত পুরাণ অনুসারে মনসা হলেন কাশ্যপ মুনির মানসকন্যা। সাপের উপদ্রব থেকে মর্ত্যবাসীকে রক্ষা করতে কাশ্যপ মুনিকে এক উপায় বার করার নির্দেশ দেন ব্রহ্মা। কাশ্যপ মুনি মনে মনে উপায় ভাবতে থাকেন। এভাবে মন থেকে সৃষ্টি হন দেবী মনসা। মনজাত হওয়ার জন্য তার নাম মনসা। আবার পদ্ম পুরাণ অনুসারে মনসা হলেন শিবের মানসকন্যা। শিব যখন কৈলাসে যাচ্ছিলেন তখন পথে কালীদহের পাশে বিশ্রামের জন্য বসেন। সেখানে তিনি অপুর্ব সুন্দর উদ্যানের শোভা দেখে মুগ্ধ হন ও তাঁর তখন পার্বতীর কথা মনে পড়ে। শিবের মনে কামের উদ্রেক হয় এবং তিনি পদ্মপাতার উপর তাঁর বীর্যস্খলন করেন। সেই বীর্য খেয়ে ফেলে একটি পাখি। তারপর সেই পাখি পাতালরাজ বাসুকীর প্রাসাদের উপর যে ডিম পাড়ে সেই ডিম ফুটে জন্ম হয় মনসার। পদ্মপাতা থেকে জন্ম বলে মনসার আর এক নাম তাই পদ্মাবতী। বাসুকীরাজ মনসাকে নিজের ভগ্নী হিসেবে গ্রহণ করেন।

পঞ্চদশ শতকে বিপ্রদাস পিপলাইয়ের লেখা ‘মনসাবিজয়’ (১৪৯৫) কাব্যে দেখা যায় পাতালে বাসুকীরাজের মা মাটি দিয়ে বালিকার একটি মূর্তি বানিয়েছিলেন। পদ্মপাতায় স্খলিত শিবের বীর্য পদ্মের ডাঁটি বেয়ে পাতালে নেমে এসে ওই মূর্তির উপরে পড়ে। তখন সেই মূর্তি প্রাণ পায় ও এভাবে মনসার জন্ম হয়। পরে মনসার পরিচয় পেয়ে শিব তাঁকে কৈলাসে নিয়ে এলে তাঁর সৎমা চণ্ডী তাঁকে মেনে নিতে পারেননি। চণ্ডী হাতের বালা ছুঁড়ে মনসার একটি চোখ কানা করে দেন। এজন্য মনসাকে ‘কানি’ বলা হয়। যখন শিব বিষপান করেছিলেন তখন মনসা তাঁর প্রাণরক্ষা করেন বলে মনসার আর এক নাম ‘বিষহরি’।

রান্নাপুজোর নানা উপকরণের মধ্যে প্রধান হল ইলিশ মাছ। ছবি: সংগৃহীত।

মনসার জন্মগত সমস্যার জন্য প্রথমে দেবকূলে স্থান হয়নি। ঋষি জগৎকারুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হলেও কিছুদিন পর বিয়ের শর্তভঙ্গের অপরাধে তিনি মনসাকে প্রত্যাখ্যান করেন। এইসব কারণে মনসা ছিলেন অত্যন্ত উগ্রস্বভাবা ও অসুখী দেবী। তিনি দেবকূলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন। পদ্মপুরাণের কাহিনি অনুসারে মনসা শৈব চাঁদ সওদাগরকে বার বার বলা সত্ত্বেও যখন তার পূজা পেলেন না তখন চাঁদের ছয় পুত্রসহ লক্ষীন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু ঘটালেন। লক্ষীন্দরের নববিবাহিতা স্ত্রী বেহুলা মনসার পূজা করে লক্ষীন্দর ও তাঁর ভাইদের প্রাণ ফেরালেন। আর চাঁদও অনিচ্ছা সত্ত্বেও না তাকিয়ে ও বাম হাতে মনসার পূজা করলেন। এভাবে দেবকূলে মনসার স্থানলাভ সম্পন্ন হল।

সর্পদেবী ছাড়াও চতুর্দশ শতক পর্যন্ত মনসা আমাদের দেশে বিবাহ ও প্রজননের দেবী হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। ভারতে আর্য আগমনের পূর্বে গড়ে ওঠা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতায় সর্পদেবীর উপাসনার প্রমাণ পাওয়া যায়। অনার্য দেবী হিসেবে পূজিতা মনসা কালক্রমে হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে অঙ্গীভূত হয়ে যায়। আর সুন্দরবন অঞ্চল যে একসময় প্রবলভাবে বৌদ্ধ প্রভাবিত ছিল তা প্রমাণিত সত্য। তার ওপর চিরকালই সর্পবহুল অঞ্চল। তাই মনসাদেবী সুন্দরবনবাসীর কাছে সবচেয়ে বেশি আদরণীয়া লৌকিক দেবী। তাই দশহরা, অম্বুবাচী কিংবা শ্রাবণ সংক্রান্তিতে রান্নাপুজোয় গেরস্থর মনসার আরাধনা আজও সমান গুরুত্ব দিয়ে চলে আসছে। তবে সাম্প্রতিককালে লক্ষ্যের থেকে প্রাধান্য বেশি পাচ্ছে উপলক্ষ্য। বারোয়ারি মনসা পুজোয় সুন্দরবনের বহু জায়গায় এখন আর মনসামঙ্গল পালাগান শোনা যায় না। পরিবর্তে শোনা যায় মাইকের অমায়িক কর্ণবিদারি শব্দ, আর দেখা যায় রাতভর উদ্দাম নাচ-গানের আসর। একে কী বলা যায়— সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নাকি অধঃপতন?—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content