রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

ফেসিয়াল প্যারালাইসিস বা বেলস পলসি নামে একটি ভয়ংকর সমস্যায় মাঝে মধ্যে কিছু মানুষকে ভুগতে দেখা যায়। যেখানে মুখের যে কোনও ভাগের (বাঁ দিক বা ডান দিক) অবশতা অসাড়তা লক্ষ্য করা যায়, মুখের ভাব-ভঙ্গি প্রকাশ করতে পারা যায় না, মুখের মাংসপেশি ঝুলে পড়ে, জলপান করতে গেলে ওই পাশ দিয়ে গলে পড়ে যায়, হাসি বা মুখের এক্সপ্রেশনে সমস্যা হয়, ওই এক পাশের চোখ বন্ধ করতে পারা যায় না, সঙ্গে চোয়ালের সন্ধি, মাড়ি বা কানের পিছনের দিকে ব্যথা ইত্যাদি প্রকাশ পায়। এই সমস্যাগুলি হঠাৎ করে প্রথমে অল্পপ্রকাশ পায়, কিন্তু খুব দ্রুত অর্থাৎ কয়েক ঘণ্টা বা ২-১ দিনের মধ্যে পুরো একপাশের মুখের অসাড়তা বা অবশতা চলে আসে।
সারা পৃথিবীতে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে বছরে প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন এই ফেসিয়াল প্যারালাইসিস্ বা বেলস পল্সিতে আক্রান্ত হন। ভারতে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ১০ জনের আক্রান্ত হওয়া লক্ষিত হয়েছে। মধ্যবয়সী বা বয়স্ক লোকেদের ক্ষেত্রে এই রোগ বেশি দেখা যায়। ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এই রোগের প্রাদুর্ভাব অপেক্ষাকৃত কম। সাধারণত প্রতি এক লাখ শিশুর মধ্যে তিনজনের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, এই রোগ উৎপত্তির মূল কারণ স্পষ্ট নয়। তবে আমাদের মস্তিষ্ক থেকে আগত ‘ক্রেনিয়াল নার্ভ’গুলির মধ্যে ৭ নম্বর ক্রেনিয়াল নার্ভের অসুস্থতার কারণে বা ফেসিয়াল নার্ভের সমস্যার জন্যই এই রোগ হয়। তাই এর নাম ফেসিয়াল প্যারালাইসিস। সাধারণত যাদের ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ বেশি হয়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার অসামঞ্জস্যতা থেকে, জীবাণু সংক্রমণের কারণে ৭ নং ক্রেনিয়াল নার্ভ বা ফেসিয়াল নার্ভের প্রদাহ এবং এই নার্ভের আবরণ কলা, মায়েলিন সিথ যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবেই এই রোগটি দেখা যায়।
আরও পড়ুন:

কুষ্ঠ-সহ ত্বকের যেকোনও জটিল সমস্যায় আয়ুর্বেদেই রয়েছে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা, জানতেন?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫০: স্বপ্নের ‘যাত্রা হলো শুরু’

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিরিখে এই রোগ চিকিৎসায় ব্যথা কমানোর ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়, তাতে অনেক রকমের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সুস্থতাও দূর অস্ত হয়। দেখা যাক, প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র এই রোগ সম্বন্ধে কী কী বলেছে এবং তার প্রতিকারের কী বিধান দিয়েছে।

যে সমস্ত লক্ষণগুলি ফেসিয়াল প্যারালাইসিস বা বেলস পলসিতে দেখা যায়, তা আয়ুর্বেদের ‘অর্দ্দিত’ নামক রোগের সঙ্গে পুরোটাই মিলে যায়। যেহেতু এই রোগে মুখের এক পাশ ভীষণভাবে পীড়িত হয়, তাই একে অর্দ্দিত বলে। এই রোগটি আশি প্রকারের নানাত্মজ বাতব্যাধির মধ্যে বিশেষ এক প্রকার।
 

রোগের নিদান

আয়ুর্বেদ মতে, গর্ভিণী স্ত্রী, বৃদ্ধ, ক্ষীণ ব্যক্তিদের যদি অত্যাধিক রক্ত ক্ষয় হয়, তবে এই রোগের প্রাদুর্ভাব তাদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। এছাড়া যারা অতি উচ্চস্বরে ভাষণ দেন, অতিশক্ত জিনিস চিবিয়ে খান, অত্যধিক হাসেন, বারবার হাই তোলেন, অত্যাধিক ভার বহন করেন, উঁচু-নিচু স্থানে বা ভূমিতে যদি শয়ন করেন, মুখকে বারবার বিকৃত করেন, শীতল বাতাসের সংস্পর্শে আসেন তবে তাদের এই রোগ দেখা যায়।
 

রোগ উৎপত্তি ক্রম

উপরিউক্ত নিদানগুলি থেকে বায়ু দোষের অত্যধিক প্রকোপ ঘটে। সেই বায়ু মস্তক, নাক, চোয়াল, কপাল, চোখ ইত্যাদি সন্ধির স্থানগুলোকে আক্রমণ করে এই ধরনের অসাড়তা ও ব্যথা নিয়ে আসে, যা অর্দ্দিত. বলে পরিচিত।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২০: সুন্দরবনের বসন্ত রোগ নিরাময়কারী দেবী শীতলা

পরিযায়ী মন, পর্ব-১২: নেতারহাটের নাশপাতি বাগান

 

রোগের লক্ষণ

মুখের একপাশ বেঁকে যায়, চোখ, কপাল, ঠোঁট, জিভ একদিকে বেঁকে যায়, সাড় থাকে না, কথা বলতে কষ্ট হয় বা কথা জড়িয়ে যায়, চোখ ঘোলা থেকে যায়, বন্ধ হয় না, দাঁত চালাতে কষ্ট বা একপাশের দাঁত আড়ষ্ট হয়,গলার স্বর ভেঙ্গে যায়, এক পাশের কানে কম শোনা, হাঁচি দিতে অসুবিধা, গন্ধ বোঝার সমস্যা, ঘুমোতে ভয় পাওয়া, গিলতে অসুবিধা ইত্যাদি।
 

রোগের ভেদ

যদিও এটি বাতজ ব্যাধি, তবুও রোগ উৎপত্তির পরে অন্য দোষের অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে। ফলে তাদের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাই অর্দ্দিত রোগ বাতজ, পিত্তজ ও কফজ এই তিন প্রকার লক্ষিত হয়।

 

চিকিৎসা সিদ্ধান্ত

প্রথমত: নিদান অর্থাৎ রোগ উৎপত্তির যে কারণগুলি বলা হয়েছে, তা বর্জন করতে হবে। নস্য প্রয়োগ, অর্থাৎ নাক দিয়ে ঔষধ পাঠাতে হবে। তেলের অভ্যঙ্গ বা মালিশ, মাথায় তেল লাগানো, পুষ্টিকর আহার দিতে হবে। নাড়িস্বেদ বা বাষ্পনালী দিয়ে ঔষধি ফোটানো বাষ্প প্রয়োগ করে সেঁক দিতে হবে। কান ও চোখের তর্পণ বা পোষণ করতে হবে। জলজ প্রাণীর মাংস-রস খাওয়াতে হবে। ফোলা থাকলে বমন বা উর্দ্ধ ভাগের দোষ বাইরে বের করিয়ে দিতে হবে। দাহ থাকলে শিরা ব্যধন ক্রিয়া করতে হবে।

শোধন চিকিৎসা কে অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশ মেনে ও পরিচর্য্যায় থেকে করা উচিত।
 

সংশমন চিকিৎসা

 

চূর্ণ ঔষধি

অশ্বগন্ধা চূর্ণ, দশমূল চূর্ণ, বলা চূর্ণ ৩ গ্রাম করে দু’বার গরম জল-সহ বা ঈষদুষ্ণ দুগ্ধ-সহ দেওয়া যায়।
 

গুগুলু ঔষধ

বাতারি গুগুলু, যোগরাজ গুগুলু, ত্রিফলা গুগুলু এদের যেকোনও একটি ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার গরম জল-সহ দেওয়া যায়।
 

রসৌষধি

লক্ষ্মী বিলাস রস, বাতগজাঙ্কুশ রস ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার দেওয়া যায় মধু-সহ মেড়ে। রসরাজ রস, মহালক্ষ্মী বিলাস রস ও ১২৫ মিলিগ্রাম দিনে দু,বার মধু-সহ দেওয়া যায়।
 

ক্বাথ

দশমূল ক্বাথ, মহারাস্নাদি ক্বাথ ২০ মিলিলিটার দিনে দু’বার দেয়া যায়।
 

অরিষ্ট

দশমূলারিষ্ট, বলারিষ্ঠ ২০ মিলিলিটার করে দিনে দু’বার খাবার পর সমপরিমাণ জল-সহ দেওয়া যায়।
 

পাক

এরন্ড পাক ২০ গ্রাম দুগ্ধ-সহ সকালে দেওয়া যায়।
 

মালিশ

সৈন্ধবাদ্য তৈল মালিশ ও ঈষদুষ্ণ সেঁক।
 

নস্য তৈল

অনু তৈল বা দশমূল তৈল দু’ ফোঁটা দিনে দু’বার।

আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

গল্পের ঝুলি, শারদীয়ার গল্প-৪: সীমানা ছাড়ায়ে…

 

পথ্য

ঈষদুষ্ণ দুগ্ধ, পুরনো চালের ভাত, আনুপ মাংস রস, জীবন্তি শাক, নরম খাবার, নিবাত স্থানে রোগীকে রাখা।
 

অপথ্য

শীতল পানীয়, রুক্ষ আহার, উপবাস, শীতল বাতাস, শক্ত খাবার।

প্রতি মুহূর্তে ঘটে যাওয়া খবরাখবর ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ফ্যাশন, লাইফস্টাইল, সাজগোজ, গল্প, উপন্যাস, বিনোদন, বেড়ানো, খাওয়া-দাওয়া, দেশ-বিদেশের হালহকিকত প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞের বিশেষ কলম পড়তে চোখ রাখুন সময় আপডেটস-এর পাতার বিভিন্ন বিভাগে। প্রতি ক্লিকেই মন ভালো করা প্রতিবেদন সাজানো রয়েছে। চলতে থাকুন সময়ের সঙ্গে — সময়, অসময়ে, সবসময়ে

Skip to content