মদনমোহন মন্দির।
কোচবিহার শহরের ঠিক মধ্যবর্তী অংশে প্রতিষ্ঠিত বৈরাগী দীঘির উত্তরপাড়ে অবস্থিত কোচবিহারের সর্বাধিক জনপ্রিয় দেবায়তন মদনমোহন মন্দির। কোচ রাজাদের কুলদেবতা হলেন মদনমোহনদেব। জনশ্রুতি, কোচ সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা নরনারায়ণের (১৫৩৩-১৫৮৭ সাল) আমলে অসমীয় বৈষ্ণববাদের প্রবক্তা শঙ্করদেবের কোচবিহারে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলে বৈষ্ণববাদের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। শঙ্করদেবের পরামর্শেই মহারাজা এক রাধাবিহীন বংশীধর মূর্তি তৎকালীন পর্বে রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন। সেটিই পরবর্তীকালে মদনমোহন নামে খ্যাতি লাভ করে।
এখন স্থাপত্যটি আধুনিক কোচবিহারের রূপকার কোচ মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের (১৮৬৩-১৯১১ সাল) সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৮৯ সালে নির্মীত হয়েছিল। মন্দিরটি চতুর্দিকে উঁচু প্রাচীরদ্বারা আবেষ্টিত এবং ডাঙ্গর আই মন্দিরের ন্যায় দক্ষিণমুখী এই দেবায়তনেরও মূল তোরণদ্বারের ঠিক উপরেই রয়েছে এর নহবতখানা অংশটি। স্থাপত্যগত দিক থেকে এই দেবায়তনটি কোচস্থাপত্যের মূল বিশেষত্ব বিমিশ্রতার এক চরম নিদর্শন প্রতিফলিত করে। কারণ এখানে একাধিক গঠনগতশৈলীর সুন্দর সংমিশ্রণ প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১১: কোচবিহারের সব থেকে জনপ্রিয় মন্দির বাণেশ্বর শিব মন্দির
শারদীয়ার গল্প-১: পুরুষোত্তম/৫
এতে বাংলার চিরাচরিত চারচালা স্থাপত্যশৈলীর শীর্ষে পেয়াঁজাকৃতির গম্বুজ দ্বারা সজ্জিত যার শীর্ষে আবার যথাক্রমে পদ্ম, আমলক ও কলস স্থাপিত যা এই অঞ্চলে ইন্দো-ইসলামীয় স্থাপত্যশৈলীর প্রভাবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। কিন্তু এর পাশাপাশি রাজমাতা মন্দিরে প্রথম আত্মপ্রকাশের পর এখন স্থাপত্যটিতে দালানশৈলীর এক সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিফলনও লক্ষিত হয়। মন্দিরের মূল আরাধ্য দেব হলেন মদনমোহন। এর দুটি মূর্তি (বড় ও ছোট মদনমোহন নামে খ্যাত) রয়েছে মন্দিরের বড় কক্ষে। মূল মন্দিরের বাকি কক্ষগুলিতে পূজিত হন কাত্যায়নী, মঙ্গলচণ্ডী, জয়তারা, অন্নপূর্ণা ও আনন্দময়ী কালীমূর্তি।
মন্দির চত্বরে মূল মন্দিরের পূর্বদিকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সৌধ রয়েছে। এই দক্ষিণমুখী সৌধটি ভবানী মন্দির নামে খ্যাত। এর উচ্চতা প্রায় ২৮ ফুট। স্থাপত্যশৈলীও প্রায় মূল মন্দিরের অনুরূপ, অর্থাৎ বাংলার চিরাচরিত চারচালা স্থাপত্যশৈলীর শীর্ষে পেয়াঁজাকৃতির গম্বুজ দ্বারা সজ্জিত। শীর্ষে আবার যথাক্রমে পদ্ম, আমলক ও কলস দ্বারা শোভিত। রক্তবর্ণা ভবানী দেবী হলেন (প্রায় ১.৬ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট)। এই দেবায়তনের প্রধান আরাধ্যা দেবী। মন্দির অভ্যন্তরে রূপোর সিংহাসনে উপবিষ্ট দশভূজা ভবানী দেবী দক্ষিণ ও বাঁদিকে প্রান্তে যথাক্রমে বাঘ ও সিংহ দ্বারা পরিবেষ্টি হয়ে অশুভশক্তির পরিচায়ক অসুর নিধন করছেন। প্রচলিত বিশ্বাস, এই ভবানী দেবী হলেন কবচরূপিণী কামতেশ্বরী দেবীর প্রতিরূপ।
আরও পড়ুন:
শারদীয়ার গল্প-৩: আঁশ/২
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৯: সুন্দরবনের জঙ্গল-জননী বিশালাক্ষী
কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের পরিচালনাধীন এই অনুপম স্থাপত্যের নয়নাভিরাম মন্দিরের বাস্তুতন্ত্র আলাদা আকর্ষণের দাবি রাখে। এখনও মদনমোহন মন্দিরের নিত্যপূজা থেকে শুরু করে সমস্ত বিশেষ রীতিনীতি রাজ আমলের নিয়ম তথা ঐতিহ্যকে মেনে পালন করা হয়। নিত্যপূজা ব্যতীত দুর্গাপুজো, রথযাত্রা, দোলপূর্ণিমা, রাসপূর্ণিমা ইত্যাদির সময় এখানে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। ধর্মপ্রাণ মানুষেরা এখনে ভিড় জমান। বিশেষত, মদনমোহনের রাসযাত্রাকে কেন্দ্র করে রাসপূর্ণিমার সময় এখানে প্রতিবছর প্রায় দু’ সপ্তাহব্যাপী বিশাল মেলা আয়োজিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ী, পর্যটক ও ভক্তরা সমবেত হন। কোচবিহারের রাসমেলার মূল আকর্ষণ, মদনমোহন মন্দির প্রাঙ্গণের মদনমোহনদেব, যাকে কেন্দ্র করেই প্রায় দুশতাব্দী প্রাচীন এই জনপ্রিয় মেলার আয়োজন করা হয়।
আমার সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মন্দিরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য রয়েছে। স্থাপত্যগত দিক থেকে যার তাৎপর্য্য সুগভীর। যেমন একদিকে রাজমাতা মন্দিরের অনুরূপ ‘পয়েন্টেড মাল্টিফয়েল ট্রিপল আর্চ’ সমন্বিত প্রবেশদ্বার এবং মন্দিরের পশ্চিমদিকস্থ বহির্দেওয়ালগাত্রে প্রায় দেড়ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট কুলুঙ্গির অস্তিত্ব দেবায়তনে মুরিশ স্থাপত্যশৈলীর প্রভাবকে নির্দেশিত করে।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৬: শ্রীমায়ের সাধনা
(বাঁ দিকে) ভবানী মন্দির। প্রবেশদ্বার এবং তার ঠিক উপরেই ফুল ও খাঁজকাটা লতাপাতার বিশেষ অলঙ্করণ (ডান দিকে)।
পাশাপাশি মন্দিরের দক্ষিণমুখী বহির্দেওয়ালের সম্মুখভাগ অংশে ফুল ও খাঁজকাটা লতাপাতার বিশেষ অলঙ্করণ ও পাশাপাশি মন্দিরের চারচালাময় বাঁকানো কর্ণিশের ঠিক নীচেই ক্ষুদ্রায়তন সারিবদ্ধ আয়তক্ষেত্রাকার ফলক যা মূলত কর্ণিশের অলঙ্করণরূপে ব্যবহৃত হয়। আত্মপ্রকাশ আশ্চর্যজনকভাবে একই সৌধে সর্বপ্রথম গ্রিক-রোমান স্থাপত্যের সফল প্রয়োগকে নির্দেশিত করে। সুতরাং মন্দিরের স্থাপত্য নিঃসন্দেহাতীতভাবে কোচ স্থাপত্যের বিমিশ্র শৈলীকেও তুলে ধরেছে।
ছবি: লেখক
ছবি: লেখক
* মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ (Temples in North Bengal): অর্ক আচার্য (Arka Acharjee), অধ্যাপক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়, কোচবিহার। লেখকের গবেষণার বিষয়: ‘Origin and Development of Unique and Composite type of Temple Architecture from 16th to 19th Century in the Northern Region of Bengal.’