সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


প্রকৃতির অকৃপণদানে আমরা সততই সমৃদ্ধ হয়ে থাকি। যতরকম প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের রয়েছে, তার মধ্যে বনজ সম্পদকে বাদ দিলে, জলজ জৈব সম্পদ, আমাদের প্রাকৃতিক খাদ্য ভান্ডার। আমাদের রাজ্যের কথাই যদি শুধু ধরি, তাহলে নদী সম্পদের দিক থেকে যে কোনও রাজ্যের তুলনায়, আমরা অনেক ভাগ্যবান।
দক্ষিণে সুন্দরবনের কথাই যদি ধরি, সেখানে যে কত নদী আছে তা বোধহয় না গেলে জানা যায় না। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল—মাতলা, ঠাকুরাণ, কালিন্দী, গোসাবা, সপ্তমুখী, রায়মঙ্গল, হাড়িয়াভাঙ্গা, ইছামতী, হোগল, দুর্গাদোয়ানী, মুড়িগঙ্গা, মণি আরও কত কি। আর এছাড়া তো রয়েছে অসংখ্য খাঁড়ি। দিনে দুবার করে এই সব নদীগুলিতে জোয়ার-ভাটা হতে দেখা যায়। আর তাই কত ধরনের যে মাছ এই সময়ে পাওয়া যায় তার আর শেষ নেই।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭৬: তেলাপিয়া মাছের বড় সুবিধা হল, একে যে কোনও জলাশয়ে যখন খুশি চাষ করা যায়

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৮: সুন্দরবনে বিচিত্র অবয়বের দেবতা জ্বরাসুর

খুব কম করে হলেও ১০০ রকমের মাছ এই সুন্দরবন থেকেই পাওয়া যায়। কত কি তাদের নামের বৈচিত্র্য। পারশে, ভাঙ্গন, গুরজালি, তোপসে, দাঁতনে, বোকো বা বক, ভেটকি, আমোদি, নোনা বেলে, পায়রাচাঁদা, মুক্তগাছা, ভোলা, গুলে, লটে, ফ্যাসা, চাপিলা, কান মাগুর, খয়রা, বাণ, কয়েক ধরণের ট্যাঙরা ছাড়াও আছে সঙ্কর মাছ, চিরুণকাটা, মৈটা, সিলভার পমফ্রেট, চিংড়ি কাঁকড়া প্রভৃতি। কত যে নাম তার শেষ নেই।
এই মাছগুলি সারাবছর জলের লবণাক্ততার তারতম্য সহ্য করে কি সুন্দর বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করেছে। সুন্দরবনের এইসব নদী থেকে, ত্রিকোণাকৃতি বাঁশের ফ্রেমের সঙ্গে নাইলন জালের সাহায্যে মীন ধরতে দেখা যায় স্থানীয় অনেক মহিলাকে। এতে হয়তো ওঁদের আয় হয় কিছু কিন্তু অনেক মাছের মীন সেই সঙ্গে নষ্ট হয়। এ ভাবে চললে আগামী দিনে এই যে বিরাট মাছের বৈচিত্র্য, সুন্দরবনে আছে, সেটা কতটা থাকবে বলা মুশকিল।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১০: চটকপুরের নিরালায়

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪৩: ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবি দেখে মুগ্ধ সত্যজিৎ রায় পরিচালক নির্মল দে’র খুব প্রশংসা করেছিলেন

ভাটার সময় নদীর পাড়ের দিকে, অল্প গভীর অংশে, জালের সাহায্যে মূলত বাগদা মীন সংগ্রহ করেন মহিলারা। সুন্দরবনের মাছ বৈচিত্র্য রক্ষায় এঁদের দ্বারা হয়তো তেমন অসুবিধে হয় না, যতটা হয় ট্রল জাল ব্যবহারে। এই জাল ব্যবহার করে বাছবিচারহীনভাবে কত শত মাছ এই ট্রলার দিয়ে ধরে নিয়ে আসা হয় এবং যার একটা বড় অংশ প্রায় কোনও কাজেই লাগে না, বাজারজাতও করা যায় না। এর ফলে আমরা অন্তত দেখছি ট্যাঙরা, ভাঙ্গন, ভেটকি, পার্শে, আরও বেশ কিছু মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে এবং আর সহজলভ্য নয়।
এই সব অসুবিধার দোসর হয়েছে দমে থাকা পলিতে নদীর ক্রমহ্রাসমান নাব্যতা। সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদ, এখানকার মানুষজনের, দৈনন্দিন পুষ্টি যোগানো ছাড়াও যথেষ্ট অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পারার কথা। এর জন্যে এই মৎস্যসম্পদের পরিমিত ব্যবহার চাই। এই দিকটাতে আলোকপাত করে স্থানীয় মানুষদের ক্রমাগত প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতন করতে পারলে, এই অবস্থার উন্নতি যে হবেই, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

ছবি: লেখক
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content