শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


কাকদ্বীপের বামানগর গ্রামের শীতলা মন্দিরে শীতলার সঙ্গে জ্বরাসুরের বহু ছলন। ছবি: লেখক।

আমার গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে রয়েছে এক বিখ্যাত থান। সেই থানের নাম হল শীতলার থান। এই থানের গরিমা আগের মতো না থাকলেও এখনও অনেক মানুষ সেখানে যান পুজো দিতে। অক্ষয় তৃতীয়ার দু’দিন পর থেকে সেখানে প্রতি বছর মেলা বসে। লোকে বলে ‘শিকারী মেলা’। আমার সতেরো-আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি বছর ওই মেলায় যেতাম। ওই থানে যাওয়ার অন্যতম রাস্তা ছিল আমার বাড়ির ঠিক সামনে দিয়ে। দেখতাম বার্ষিক পুজোর দিন সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষ চলেছে শীতলার থানে। তাদের অনেকে মাথায় করে বয়ে নিয়ে চলেছে ছলন। শীতলা দেবীর থান, কিন্তু অধিকাংশ ছলন এক অদ্ভুত দেবতার। ওই দেবতার এক বড়সড় মূর্তিও দেখেছি শীতলার থানে। সেই মূর্তি এখনও আছে। বিচিত্র তাঁর অবয়ব। গায়ের রং ঘন নীল। তিনটে মাথা, নয়টি চোখ, ছয়টি হাত আর তিনটে পা। সামনের দুটো হাত বুকের কাছে নমস্কারের ভঙ্গিতে রাখা। তাঁর তিনটে মুখেই সৌম্যভাব।
ঠাকুরমা, বাবা ও মায়ের কাছে এই দেবতার কথা শৈশবেই জেনেছিলাম। এঁর নাম জ্বরাসুর। ইনি জ্বর বিনাশক লৌকিক দেবতা। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা যখন প্রত্যন্ত সুন্দরবনের গ্রামগুলোতে ছিল আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র তখন সেই সব এলাকার মানুষ সন্তান বা প্রিয়জনের জ্বর হলে এই জ্বরাসুরের কাছে মানত করত। আর জ্বর সেরে গেলে দণ্ডী কাটতে কাটতে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে মন্দিরে পৌঁছোত ও ছলন সহযোগে পুজো দিত। তা কেন তিনি শীতলার থানে থাকেন? কেন তাঁর আলাদা থান নেই? শৈশবেই জেনেছিলাম যে তিনি নাকি শীতলা দেবীর স্বামী। তাই শীতলার পাশেই থাকেন। শৈশবে এটাই বিশ্বাস করতাম। তবে পরিণত বয়সে এসে জ্বরাসুর সম্বন্ধে আরও দুটো তথ্য পেলাম—তিনি এক অসুর আর শীতলার অনুগত সহকারী।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩২: শুধু কি গানে, আবহসঙ্গীতেও তাঁর কাজ অসামান্য

একটি কাহিনি হল, শিব যখন একবার ধ্যান করছিলেন তখন তাঁর ঘাম থেকে জন্ম হয় জ্বরাসুরের। তিনি দেবতাদের জ্বর সৃষ্টি করতেন বলে দেবতারা খুব আতঙ্কে থাকতেন। একবার বিষ্ণু যখন হয়গ্রীব অবতারে বিরাজ করছিলেন তখন জ্বরাসুর তাঁর প্রবল জ্বর সৃষ্টি করেন। এতে বিষ্ণু খুব ক্ষেপে যান এবং তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে জ্বরাসুরকে তিন টুকরো করে ফেলেন। পরে জ্বরাসুরকে ব্রহ্মা পুণরায় জীবিত করেন। কিন্তু ততদিনে জ্বরাসুরের প্রতিটি টুকরো থেকে মাথা, হাত, পা ইত্যাদি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তিনটে টুকরো জুড়ে যাওয়ায় জ্বরাসুরের তিনটে মাথা, ছ’টি হাত ও তিনটে পা হয়ে যায়। পরে ইনিই মা শীতলার স্বামী হন।

দ্বিতীয় কাহিনিটি একটু ভিন্ন। শিবের শ্বশুর দক্ষ যজ্ঞ করছেন। দক্ষ স্বর্গের সব দেবতাকে নেমন্তন্ন করেছেন কেবল শিব ছাড়া। কারণ তিনি জামাই শিবকে একদম পছন্দ করেন না। একে একে সব দেবতা আসছেন, কিন্তু সতীর স্বামী শিব আসছেন না। এতে দক্ষের মেয়ে সতী খুব দুঃখ পেয়েছেন। তাঁর দুঃখে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন শিব। তাই উদ্বিগ্ন শিবের তৃতীয় নয়ন থেকে ঝরে পড়েছে এক ফোঁটা ঘাম। আর এই ঘামের ফোঁটা থেকে জন্ম নিল এক ভয়ানক অসুর। সে যমরাজার মতো হিংস্র, আর সহস্র বজ্রগর্ভ মেঘের মতো ভয়ঙ্কর। তার প্রচন্ড শক্তিশালী চেহারা আর বীভৎস মুখমন্ডলে অসংখ্য চোখ। সেই অসুরের এতই তেজ যে কোনও দেবতা বা স্থান তার দেহ থেকে নির্গত তেজের প্রভাবে তিষ্ঠতে পারে না। বাধ্য হয়ে শিব সেই অসুরকে কয়েক টুকরো করে ফেললেন।

জরাসুর ও পঞ্চানন্দ ঠাকুরের সঙ্গে পাঁচু ঠাকুর (ডানদিকে)।

শিব এই অসুরের নাম দিয়েছিলেন জ্বরাসুর কারণ এই অসুর দেবতাদের শরীরের তাপ বাড়িয়ে দেয়। শিব জ্বরাসুরের প্রতিটি টুকরো এক এক প্রকার জীবকে দান করেন। যেহেতু শিব সব দেবতার আদি দেবতা তাই তাঁর দান কেউ অস্বীকার করতে পারল না। তখন থেকে জ্বরাসুরের এক এক টুকরো এক এক প্রকার জীবের রোগ সৃষ্টি করে। যেমন মানুষের জ্বর, হাতির শিরঃপীড়া, ঘোড়ার গলায় ক্ষত, কোকিলের চোখে ক্ষত, গোরুর ক্ষুরে ক্ষত, বাঘের অবসাদ, টিয়াপাখির হেঁচকি এবং জলে শ্যাওলার বৃদ্ধি।

অষ্টাদশ শতকে মানিকরাম গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘শীতলামঙ্গল’ কাব্যে শীতলার সহকারী হিসেবে জ্বরাসুরকে দেখানো হয়েছে। একদিন মা শীতলা তাঁর অন্যতম সহকারী জ্বরাসুরকে বললেন, “মর্ত্যে আমাদের মাহাত্ম্য প্রচার করতে হলে চলো আমরা রাম-সীতার দুই ছেলে লব ও কুশকে আক্রমণ করি।” জ্বরাসুর বললেন, “এমনিতেই তো সীতা লঙ্কায় অনেক দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছেন। তাঁকে আর দুঃখ দেওয়া কি উচত হবে?” কিন্তু শীতলা শুনলেন না। তিনি এক বুড়ির ছদ্মবেশে বাল্মীকির আশ্রমে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন একটা রঙিন ঝুড়িতে হাম ও বসন্তের গুটি।

লব ও কুশ তা দেখে ডালের দানা ভেবে খাওয়ার জন্য বায়না জুড়ল। তখন ছদ্মবেশী শীতলা তাদের খেতে দিয়ে অন্তর্হিত হলেন। তারপর জ্বরাসুরকে নির্দেশ দিলেন, “যাও, এইবার লব ও কুশকে প্রবল জ্বরে ভোগাও।” ছেলেদের প্রচণ্ড অসুস্থতায় অসহায় সীতা কান্নাকাটি শুরু করলেন। হনুমান কবিরাজ ধন্বন্তরীকে নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, “শীতলার সঙ্গে জ্বরাসুরের পুজো করলে লব ও কুশের এই রোগ সারবে।” সীতা তাই করলেন। লব ও কুশের রোগমুক্তি হল। সেই থেকে মর্ত্যে মা শীতলার সাথে জ্বরাসুরের পুজো প্রচলিত হল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪১: চোখ ঠিক রাখতে মাছের মুড়ো?

পরিযায়ী মন, পর্ব-১০: চটকপুরের নিরালায়

কেবল শীতলার সঙ্গেই নয়, কোথাও কোথাও পঞ্চানন্দ, ধর্মঠাকুর, আটেশ্বর, দক্ষিণ রায়, পাঁচুঠাকুর, বসন্ত রায় প্রভৃতি লৌকিক দেবতাদের সঙ্গেও জ্বরাসুরকে পূজিত হতে দেখা যায়। তবে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোনও কোনও জায়গায় জ্বরাসুরের একক থান রয়েছে। যখন সুন্দরবন অঞ্চল ছিল অতি দুর্গম, উন্নত চিকিৎসার সুযোগ ছিল সুন্দরবনবাসীর নাগালের বাইরে তখন এই এলাকায় জ্বরাসুরের পুজো হত অনেক বেশি। অনেক বয়স্ক মহিলা ‘জ্বরাসুরের বার’ পালন করতেন। দোল পূর্ণিমার দিন জাঁকজমকের সঙ্গে পুজো হত। কিন্তু এখন কোথাও আর জাঁকজমক করে জ্বরাসুরের পুজো হয় না।

জ্বরাসুরের অদ্ভুত চেহারার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তাঁর কোনও বাহন নেই, কিংবা তাঁর কোনও হাতে প্রহরণ নেই। মাথায় কোথাও মুকুট থাকে, কোথাও থাকে না। পরণে ধুতি। খালি গা বা কোথাও কোথাও খাটো জামা। হাতে ও গলায় থাকে অলঙ্কার। গলায় জড়ানো থাকে জরি বসানো হলদে রঙের ওড়না। তবে কোথাও কোথাও জ্বরাসুরকে শিলাখণ্ড বা ঘট বা কচ্ছপ প্রতীক হিসেবে পুজো করা হয়। বাংলার বাইরেও ভিন্ন নামে জ্বরাসুরের অনুরূপ দেব বা দেবীর পুজো হয়। ওড়িশাতে ‘জ্বর নারায়ণ’ নামে লৌকিক দেবতা এবং দক্ষিণ ভারতে ‘মারিডিয়াম্মা’ নামে লৌকিক দেবীর পুজো হয় জ্বরের প্রকোপ কমানোর জন্য। গ্রামাঞ্চলে ওঝা বা গুণিনেরা জ্বর তাড়ানোর যে মন্ত্র বলেন তাতে জ্বরাসুরের নাম থাকে। সাধারণত বর্ণ ব্রাহ্মণেরাই এখন জ্বরাসুরের পুজো করেন।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১৩: সাগর দীঘির ধারে হিরণ্যগর্ভ শিবমন্দির ও মধুপুর ধাম

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৪: সত্তরের হীরের টুকরো

এখন জ্বরাসুরের উদ্ভব কীভাবে হল দেখা যাক। ‘জ্বর’ এবং ‘অসুর’ নামে দুটি শব্দ থেকে জ্বরাসুর নামটা এসেছে। দুটি শব্দই সংস্কৃত। তবে ইন্দো-পারসিক শব্দ ‘অহুর’ থেকে অসুর শব্দের সৃষ্টি বলে অনেকের ধারণা। এই অহুর মানে কিন্তু দেবতা। সুতরাং জ্বরের দেবতা অর্থে জ্বরাসুর নাম মোটেই অসঙ্গত নয়। আবার আর্যেতর জাতিদের বৈদিক যুগে বলা হত অসুরজাতি। “বাংলার লৌকিক দেবদেবী” গ্রন্থের প্রণেতা গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর মতে—“‘জ্বর’ দেবতার উল্লেখ প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্র গ্রন্থে ও সংস্কৃত কাব্যে পাওয়া যায়। অনুমান, সেই জ্বর-দেবতা ও আর্যেতর-অসুর জাতির কোন আরোগ্য দেবতা মিশ্রণে ‘জ্বরাসুরের’ উৎপত্তি হয়েছে। …সম্ভবত এদেশে যখন আর্যরা প্রথম আসেন সে সময় আর্যেতর জাতি—যারা এ অঞ্চলে অধিবাসী ছিলেন, তাঁরা চিকিৎসা শাস্ত্রে বেশ উন্নত ছিলেন, সে জন্যে আর্যরা তাঁদের আরোগ্য দেবতাদের স্বীকার করে নেন।”

(বাঁ দিকে) কাকদ্বীপের বামানগর গ্রামের শীতলা মন্দিরে জ্বরাসুর (ছবি-লেখক)। মথুরাপুরের চিত্রগঞ্জে পঞ্চানন মন্দিরে জরাসুর (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

জ্বরাসুরের সঙ্গে বৌদ্ধদের পর্ণশবরী দেবী ও যমান্তক বা যমারী সর্বমারী প্রশমনী দেবতার মিল দেখা যায়। পর্ণশবরী দেবী প্লেগ, জ্বর ইত্যাদি রোগের দেবী এবং এঁর তিনটি মুখ ও ছ’টি হাত। অন্যদিকে যমান্তকেরও তিনটি মাথা ও রং নীল। হয়তো আর্যেতর যুগের অধিবাসীরা এই দুই দেবতার আকৃতির মিশ্রণে জ্বরাসুর দেবতার সৃষ্টি করে। গোপেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর মতে—“এ থেকে মনে হয়, জ্বরাসুরের সঙ্গে মহাযানীদের এককালে সম্পর্ক ছিল বা এই দেবতার রূপ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তাঁরা নিজ সমাজের এই দেবতাগুলির আকৃতি গঠন করেন ও আরোগ্য দেবতার বৈশিষ্ট্য দেন।” বৌদ্ধ দেবতাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও জ্বরাসুরের পুজোয় বৌদ্ধ প্রভাব অনুপস্থিত। ফাল্গুন-চৈত্র মাসের পূর্ণিমায় জ্বরাসুরের পুজো হয়। এঁর পুজোয় দিনের বেলায় বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়।

সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে সৃষ্ট লৌকিক দেবদেবীদের মধ্যে অন্যতম হলেন জ্বরাসুর। বর্তমানে একদিকে ‘আমিত্ব’ প্রদর্শনের এবং অসিহষ্ণুতার যুগে ক্রমশই কমছে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের সুযোগ, অন্যদিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি কমিয়ে দিয়েছে লৌকিক দেবদেবীদের গুরুত্ব। আর তাই আরও অনেক লৌকিক দেবদেবীর মতো জ্বরাসুরও সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতি থেকে বিলুপ্তির প্রহর গুণছে। —চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content