জল্পেশ্বর মন্দিরের একটি প্রবেশদ্বার।
জটিলেশ্বর মন্দিরের পুনর্গঠিত ‘শিখর’ ও ‘মস্তক’ অংশটি ‘মান্দোভারা’-র তুলনায় অপেক্ষাকৃত নবীন হলেও গঠনগত দিক থেকে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যদিও ‘মান্দোভারা’ অংশটির মতো একে নিয়েও গবেষকদের মধ্যে আগ্রহপূর্ণ আলোচনার অভাব স্পষ্ট। ‘মস্তক’ অংশটি মূলত দুটিভাগে বিভক্ত—এক, নিম্নাংশ তথা গর্ভগৃহের উপরের অংশটি বর্গাকার। যদিও এর মূল অভিনব তথা অনন্য বৈশিষ্ট্যেটি হল চতু্র্পাশ্বের ‘Jali pattern window with pointed multifoil arch’, যা সুস্পষ্টভাবে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর প্রভাবকে সুনিশ্চিত করে। দুই, অন্যদিকে উর্ধ্বাংশটি গঠনগতদিক থেকে উত্তর ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর অন্তর্ভুক্ত ‘Śēkharī’ রীতি অনুযায়ী নির্মীত হয়েছে বলেই আমার অনুমান। কারণ, ‘Śēkharī’ স্থাপত্যকৌশল অনুসারে এখানেও মূল শিখরের পাশাপাশি সংলগ্ন চতুর্দিকেই মূল শিখরের ‘Madhyalata, Pratiratha & Karnaratha’ অংশে বেশ কিছু ক্ষুদ্র শিখর পরিলক্ষিত হয়।
‘Madhyalata’ অংশে যে সব Latina Aedicule রয়েছে সেগুলির প্রতিটির কেন্দ্রে (সর্বমোট ৪টি) এক বিশেষ স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যা এই অঞ্চলে পরিলক্ষিত হওয়া একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। Latina Aedicule কেন্দ্রে এই ৪টি বিশেষ ‘component’ ‘ঝরোখা’ বা ঝুলন্ত ঘেরা অলিন্দ-এর একটি আঞ্চলিক রূপায়ন বলেই বলেই আমার মত। ‘ঝরোখা’ মূলত ‘Rajput Architecture’ & ‘Indo-Islamic Architecture’ বেশি পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। কিন্ত সেই বৈশিষ্ট্যের জটিলেশ্বর মন্দিরের পুনর্গঠিত ‘শিখর’ অংশে রূপায়ন তাও এই অঞ্চলে একমাত্র একক উপস্থাপনারূপে খুবই বিস্ময় উদ্রেককারী। ‘ঝরোখা’ ও ‘Latina Aedicule’গুলি আবার শীর্ষদেশে এক একটি করে অর্ধবৃত্তাকার নাতিবৃহৎ ‘ভূমি আমলকশিলা’ দ্বারা সজ্জিত।
আরও পড়ুন:
মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৯: মৌলিকত্ব ও অনন্যতায় সমৃদ্ধ এক স্থাপত্যকীর্তি জটিলেশ্বর শিবমন্দির/১
পরিযায়ী মন, পর্ব-৯: সাসারামের ঝর্ণাধারা
‘শিখর’ অংশটির উর্ধ্বাংশ ও নিম্নাংশটি একটি সুস্পষ্ট সীমারেখা দ্বারা বিভক্ত যেটিকে স্থাপত্যশব্দকোষ অনুযায়ী ‘Dentil’ বলা যেতে পারে এর আকার অনেকটাই ভিন্ন। আয়তাকারের পরিবর্তে ওল্টানো পিরামিড সদৃশ আকৃতি। সবমিলিয়ে পুনর্গঠিত ‘শিখর’ অংশটি যে স্থাপত্যবৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে অনন্যসাধারণ তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। মন্দিরের ‘শিখর’ অংশের পাশাপাশি পুনর্গঠিত ‘মস্তক’ অংশটিও যথেষ্টই উল্লেখের দাবি রাখে।
‘মস্তক’ অংশটির সর্বনিম্নে পরপর দুটি ক্রমহ্রাসমান আয়তাকার অংশ যার মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম পরিসরযুক্ত ছোট অংশটির উপরে পুস্পের পাপড়ি সদৃশ একটি দণ্ড, যা ধারণ করে রয়েছে কলসসদৃশ একটি মসৃণ গোলাকার তথা অলঙ্কৃত একটি অংশকে। ‘মস্তক’-এর একদম উপরে সুবিন্যস্তভাবে সজ্জিত হয়ে রয়েছে আমলকশিলা ও ধ্বজাস্তম্ভ। ‘মস্তক’ অংশটির মূল বিশেষত্ব তথা অনন্যতা হল এর অলঙ্করণ ও বিন্যাস। যদিও এই অঞ্চলের অন্যান্য শিবমন্দিরগুলির ঠিক বিপরীত আলোচ্য অংশে ত্রিশূলের অনুপস্থিতি বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
‘মস্তক’ অংশটির সর্বনিম্নে পরপর দুটি ক্রমহ্রাসমান আয়তাকার অংশ যার মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম পরিসরযুক্ত ছোট অংশটির উপরে পুস্পের পাপড়ি সদৃশ একটি দণ্ড, যা ধারণ করে রয়েছে কলসসদৃশ একটি মসৃণ গোলাকার তথা অলঙ্কৃত একটি অংশকে। ‘মস্তক’-এর একদম উপরে সুবিন্যস্তভাবে সজ্জিত হয়ে রয়েছে আমলকশিলা ও ধ্বজাস্তম্ভ। ‘মস্তক’ অংশটির মূল বিশেষত্ব তথা অনন্যতা হল এর অলঙ্করণ ও বিন্যাস। যদিও এই অঞ্চলের অন্যান্য শিবমন্দিরগুলির ঠিক বিপরীত আলোচ্য অংশে ত্রিশূলের অনুপস্থিতি বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
আরও পড়ুন:
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১০: কী উপহার সাজিয়ে দিলে…
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর
বিখ্যাত গবেষক তারাপদ সাঁতরার বক্তব্য, মন্দিরের প্রবেশপথের দেওয়ালে পাথরের বিষ্ণুপট্ট নিবদ্ধ ছিল। এর পাশাপাশি এখান থেকে পাথরের অমূল্য কুবের মূর্তি এবং মন্দিরসংলগ্ন পদ্মপুকুর থেকে খননকার্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত এগারোটি প্রস্তর মূর্তি যার মধ্যে শিব, চণ্ডী, গণেশ, বিষ্ণু উল্লেখযোগ্য। এর সময়কাল আনুমানিক দ্বাদশ শতকের বলে গবেষকদের অনুমান। সেই সঙ্গে এগুলি জটিলেশ্বর শিবমন্দিরের প্রাচীনত্ব তথা ঐতিহ্যেরর ইঙ্গিতবাহী। বিষ্ণুপট্ট-সহ সমস্ত মূর্তিগুলিই আমাদের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে সংরক্ষিত আছে।
আরও পড়ুন:
পাখি সব করে রব, পর্ব-৫: জঙ্গল অভিযানের পরে অবশেষে দেখা মিলল মন ভুলিয়ে দেওয়া সেই রেইন কোয়েলের
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৯: রাবণ-মারীচ সংবাদ এগোল কোন পথে?
জটিলেশ্বরের মূল শিবমন্দিরের সংলগ্ন ছোট একটি মন্দির রয়েছে, যা সিদ্ধেশ্বরী মন্দির নামে স্থানীয়ভাবে সুপরিচিত। মূল মন্দিরের পাশাপাশি এখানেও একটি গোলাকার গৌরীপট্ট প্রতিষ্ঠিত। যদিও মূল মন্দিরটির উচ্চতা আনুমানিক ২৫ ফুটের কাছাকাছি হলেও সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের উচ্চতা ১০ ফুটের বেশি হবে না।
জটিলেশ্বর শিবমন্দিরের গর্ভগৃহে অবস্থিত গৌরিপট্ট-সহ জটিলেশ্বর শিবলিঙ্গ।
বস্ততপক্ষে জটিলেশ্বর শিবমন্দিরের স্থাপত্যকৌশল যে মৌলিকতা ও অনন্যতার দিক থেকে এ অঞ্চলে তুলনারহিত তা পরিষ্কার। এই অনুপম স্থাপত্যটিতে একদিকে যেমন উত্তর ভারতীয় ‘Śēkharī’ স্থাপত্যশৈলীর প্রয়োগ লক্ষিত হয়, তেমনি আবার ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান। যেমন প্রবেশদ্বার, গর্ভগৃহ, ঝরোখা বা ঝুলন্ত ঘেরা অলিন্দ ইত্যাদি। তবে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই দুই কৌশলের সুন্দর সংমিশ্রণ যা আদতে সৌধশিল্পীদের স্থাপত্যজ্ঞানকেই প্রতিভাত করে। কিন্ত জানা যায়, এই অনুপম স্থাপত্যকীর্তিটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে থাকলেও মন্দিরটির সার্বিক অবস্থা একদমই ভালো নয়। এই অব্যবস্থার আশু সমাধান প্রয়োজন। কারণ, স্থাপত্যগত দিক থেকে এমন অসাধারণ সৌধ এই অঞ্চলে বিরল। উত্তরবঙ্গের মন্দিরসমূহের মধ্যে জটিলেশ্বর শিবমন্দির একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী, যা নিজ শিল্পগুণে আমাদের আবিষ্ট ও মোহিত করে। —চলবে।
ছবি: লেখক।
ছবি: লেখক।
* মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ (Temples in North Bengal): অর্ক আচার্য (Arka Acharjee), অধ্যাপক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়, কোচবিহার। লেখকের গবেষণার বিষয়: ‘Origin and Development of Unique and Composite type of Temple Architecture from 16th to 19th Century in the Northern Region of Bengal.’