রবিবার ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


জরাসুর ও পঞ্চানন্দ ঠাকুরের সঙ্গে পাঁচু ঠাকুর (ডানদিকে)।

আমার গ্রামের বাড়ির পাশে নিম্নবিত্ত এক পরিবারের বাস ছিল। সেই পরিবারের কর্তার এক ছেলে ছিল আমার চেয়ে বছর দু’য়েকের ছোট। তাকে পাড়ার সবাই ডাকত ‘চৈতন্যা’ বলে। না, শ্রীচৈতন্যের ভক্ত ছিল না ওরা। আসলে চৈতন্যার মাথায় ছিল ইয়া বড় একটা টিকি। টিকিটা তার ঘাড় ছাড়িয়ে কাঁধে লুটোপুটি খেত। বৈষ্ণব বা শ্রীচৈতন্যের পুরুষ ভক্তদের টিকি থাকে বলেই ছেলেটার ডাকনাম ছিল চৈতন্য, আর তা গেঁয়ো বিকৃত উচ্চারণে হয়ে যায় চৈতন্যা। ওর মা বলত, পাঁচু ঠাকুরের মানত আছে, তাই মাথায় টিকি রাখা আছে। শুনেছিলাম চৈতন্যার আগে নাকি আরও এক দাদা ও এক দিদির জন্ম হয়েছিল। কিন্তু খুব ছোটবেলাতেই ওর দাদা পুকুরের জলে ডুবে গিয়ে মারা যায়। আর ওর দিদিও মারা যায় কলেরায় ভুগে। তারপর জন্ম চৈতন্যার। আর তাই ওকে রক্ষা করার জন্য ওর বাবা-মা পাঁচু ঠাকুরের মানত করেছিল। কিন্তু সেই ঠাকুর কে বা কোথায় তাঁর মন্দির আছে তা আমার তখন জানা ছিল না।

দেখতে কেমন পাঁচু ঠাকুর? তাঁর প্রচলিত চেহারা কিন্তু অতি ভয়াবহ, আদিম দেবতাদের সঙ্গে অনেক মিল দেখা যায়। তাঁর গায়ের রং কালো। হুতোম প্যাঁচার মতো বড় বড় গোলাকার চোখ এবং চোখের রং লাল। মাথায় ঝাঁকড়া কোঁচকানো চুল। কোথাও কোথাও মূর্তির মাথায় দুটো শিং-ও থাকে। পুরু ও লাল রঙের ঠোঁট। বড় বড় দাঁত। অনেক ক্ষেত্রে বড় দুটো ছেদক দাঁত বাইরে বেরিয়ে থাকে। কান দুটো বেশ বড়। কানে, হাতে, পায়ে ও গলায় আদিবাসীদের মতো অলঙ্কার পরে থাকেন। কপালে রক্ততিলক। এ ছাড়াও সারা গায়ের নানা জায়গায় লাল ও সাদা রঙের ফোঁটা দেওয়া থাকে। হলুদ রঙের খাটো একটা ধুতি মালকোঁচা মেরে পরে থাকেন। মোটের উপর তাঁর চেহারা দেখে ভক্তির চেয়ে ভয়ই হয় বেশি।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও সুন্দরবনের অধিকাংশ জায়গা ছিল দুর্গম। ফলে চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। তাছাড়া শিক্ষার অভাবে শিশুমৃত্যুর বা গর্ভস্থ ভ্রূনের মৃত্যুর কারণ ছিল মানুষের অজানা। পোলিও, টিটেনাস (ধনুষ্টঙ্কার), কলেরা ইত্যাদি নানা রোগে প্রচুর শিশু ভুগত বা মারা যেত। বহু গর্ভবতী মহিলা অপুষ্টির কারণে বা জিনগত কারণে মৃত সন্তান প্রসব করতেন। ফলে জন্মের আগে ও পরে সন্তানের মঙ্গল কামনা করে অসংখ্য মহিলা দেবতার কাছে মানত করতেন। সেইসব দেবতার মধ্যে অন্যতম হলেন পাঁচুঠাকুর। আগেকার দিনে রিকেট রোগকে চলতি কথায় বলা হত ‘পেঁচোয় ধরা’। তার মানে পাঁচু ঠাকুর যদি কারও ওপর কূপিত হন তবে তার সন্তানের রিকেট হয়! আবার কেউ কেউ ‘ভূতে ধরা’-কেও বলে পেঁচোয় ধরা। অনেকে মনে করে পাঁচুঠাকুর হলেন ভূত-প্রেতের দেবতা বা অপদেবতা। সন্তানের ওপর যাতে তাঁর ‘কুনজর’ না পড়ে সেজন্য মায়েরা সচেষ্ট থাকতেন। তাঁরা পাঁচুঠাকুরের থানে গিয়ে গাছের গায়ে দড়িতে ঢিল বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে আসতেন। এখনও এই প্রথা বজায় আছে। মানুষের বিশ্বাস, ওই ঢিল পাঁচুঠাকুরের দৃষ্টিগোচর হলে তিনি শিশুটিকে রক্ষা করবেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৬: সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা পঞ্চানন্দ বা বাবাঠাকুর

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১৩: সাগর দীঘির ধারে হিরণ্যগর্ভ শিবমন্দির ও মধুপুর ধাম

যে সন্তানের নামে মানত করা হয় তার জন্মের পর থেকে চুল কাটা হয় না। আবার কারও কারও যদিও বা চুল কাটা হয় তবে তার সামান্য কিছু চুল রেখে দেওয়া হয় যতদিন না মানত পূরণের পুজো দেওয়া হয়। এই চুলই টিকি হয়ে থাকে। আর ওই সন্তানের হাতে থাকে মানতের একটি বালা। পুত্রসন্তান রক্ষার জন্যই মানত করতে আমি দেখেছি। কন্যাসন্তানের জন্য পাঁচুঠাকুরের মানত করতে আমি অন্তত দেখিনি। সাধারণত এগারো বছর বয়স হলে সেই সন্তানকে তার বাবা-মা বা বাড়ির বয়োজ্যোষ্ঠরা পাঁচুঠাকুরের থানে নিয়ে যান। তারপর থানের কাছাকাছি কোনও তাল, বট বা অশ্বত্থ গাছের তলায় নাপিত দিয়ে তার চুল কামানো হয়। তারপর তার মা থান সংলগ্ন পুকুরে স্নান করে ভেজা কাপড়ে দন্ডী কাটতে কাটতে তিনবার থান প্রদক্ষিণ করেন। তারপর শুরু হয় পুজো। সন্তানের মা মাথায় জ্বলন্ত ধুনুচি নিয়ে পুরোহিতের পাশে বসে থাকেন। আর পুরোহিত পুজোর শেষে সন্তানের হাত থেকে মানতের বালা খুলে দেন। পুজোয় নৈবেদ্য থাকে চিড়ে, গুড়, কলা, দই, বাতাসা ও ফলমূল। যদি মানতকারীর আর্থিক সামর্থ্য বেশি হয় তবে পাঁচু ঠাকুরের ছলন দান করেন ও ঢাকির দল নিয়ে ঢাক-কাঁসি বাজিয়ে পুজো দিতে আসেন। কখনও কখনও গ্রামের লোককে ভোজ খাওয়ানোর ব্যবস্থাও করেন।

চেহারায় কিছু মিল থাকায় পঞ্চানন্দ ঠাকুরকেই এখন অনেকে বলেন পাঁচু ঠাকুর।

কোনও উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ পাঁচুঠাকুরের পুজো করেন না। সাধারণত ‘দেয়াসী’ পদবির অনুন্নত ব্রাহ্মণ পাঁচুঠাকুরের পুজো করেন। যেহেতু ইনি লৌকিক দেবতা তাই কারও বাড়িতে তিনি পূজিত হন না। গ্রামের কোনও প্রাচীন বট বা অশ্বত্থ বা তাল গাছের নীচে পাঁচুঠাকুরের থান থাকে। সাধারণত শনিবার ও মঙ্গলবার পুজো হয়। বার্ষিক পুজোর সময় জাঁকজমক হয়। গ্রামের অনেক মহিলা সন্তানের মঙ্গল কামনায় পাঁচুঠাকুরের উদ্দেশ্যে পুঁটলিতে প্রতিদিন বা সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে খুচরো পয়সা জমান। বার্ষিক পুজোর সময় তাঁরা সেই পয়সা আয়োজক ভক্তদের হাতে তুলে দেন। অনেক সময় বার্ষিক পুজোর উদ্দেশ্যে ভক্তরা গ্রামে গ্রামে ‘মাঙন’ চাইতে বেরোন।

তবে বর্তমানে সুন্দরবনসহ দুই চব্বিশ পরগনা, কলকাতা, নদীয়া, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান ইত্যাদি জেলার অনেক স্থানে পাঁচু ঠাকুর আর পঞ্চানন ঠাকুর বা পঞ্চানন্দ ঠাকুর বা বাবাঠাকুরকে একই দেবতা হিসেবে ধরা হয়। এই পঞ্চানন বা পঞ্চানন্দ ঠাকুর বা বাবাঠাকুরও পাঁচু ঠাকুরের মতো শিশুরক্ষক দেবতা। ফলে অনেক জায়গায় পাঁচু ঠাকুরের থান হয়ে গিয়েছে পঞ্চানন্দের থান। দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনায় বাবাঠাকুর নামটি বেশি প্রচলিত। পঞ্চানন্দ ঠাকুরও লৌকিক দেবতা।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৯: সাসারামের ঝর্ণাধারা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪০: ব্রণ হয়েছে? তার মানেই কি লিভার খারাপ?

তবে অনেকে তাঁকে শিবের আর এক রূপ বা অনুচর বলে মনে করে। বাংলার লৌকিক দেবদেবী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু লিখেছেন, “পঞ্চানন্দ বা পঞ্চানন নামে একটি প্রসিদ্ধ লৌকিক দেবতা আছেন। তাঁকেও ‘পাঁচুঠাকুর’ বলা হয়, তাঁর মঙ্গল কাব্যের নাম ‘পাঁচুঠাকুরের পাঁচালী’। কিন্তু এই পাঁচুঠাকুর ও পঞ্চানন্দ ভিন্ন দেবতা।” পঞ্চানন্দের গায়ের রঙ কিন্তু পাঁচু ঠাকুরের মতো নয়। এঁর গায়ের রং টকটকে লাল। মাথায় আধা জটা ও আধা খোলা চুল। কোথাও আবার মাথায় মুকুটও দেখা যায়। এঁর মূর্তিতেও পাঁচু ঠাকুরের মতো বড় বড় চোখ ও বড়ো বড়ো দাঁত দেখা যায়। খালি গা। পরণে বাঘছাল বা ধুতি। এক হাতে ডমরু আর অন্য হাতে ত্রিশূল। তিনি আসীন ঘোড়ার উপরে। এঁর পুজো করেন ব্রাহ্মণ এবং শিবের মন্ত্র ব্যবহার করা হয়। যেমন খিদিরপুরে প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো পঞ্চানন্দের মন্দিরে পঞ্চানন্দের এমন রূপ দেখা যায়। আবার ডোমজুড়ে নারনা গ্রামে পঞ্চানন্দের মন্দিরে দেবতার পুজো হয় ঘটে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৮: ও দয়াল! বিচার করো!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৪: সারদা মায়ের বিশ্বাসে জাগ্রতা হল দেবী সিংহবাহিনী

তবে সুন্দরবনের গ্রামাঞ্চলে পাঁচু ঠাকুরের অধিকাংশ থান হয় পুকুর বা নদীর পাড়ে ও গাছের নীচে। পাঁচু ঠাকুর স্বাধীন দেবতা হিসেবে পূজিত হলেও কোথাও কোথাও তাঁর সঙ্গে এক দেবীও পূজিতা হন। তাঁকে লোকে পাঁচি ঠাকুরানি বলে ডাকে। লোকে বলে, ইনি পাঁচু ঠাকুরের স্ত্রী। তাঁর চেহারা কিন্তু মোটামুটি সুশ্রী। গায়ের রং হলুদ। পরণে লাল পাড়যুক্ত সাদা শাড়ি। স্বাভাবিক চোখ। তবে দাঁতের আকার বড়। সম্ভবতঃ বহু জায়গায় পেঁচো-পেঁচি নামে যে যুগ্ম দেবতার পুজো হয় তাঁরা হলেন এই পাঁচু ঠাকুর ও পাঁচি ঠাকুরানি। আবার অনেক জায়গায় পাঁচু ঠাকুরের সাথে অন্য এক দেবতারও পুজো হয়। লোকে তাঁদের একসঙ্গে বলে পেঁচো-খেঁচো ঠাকুর। তবে যেহেতু এখানে উভয় মূর্তি হয় খুব রুগ্ন তাই নিশ্চিতভাবেই এখানে পেঁচো, পাঁচু ঠাকুর নন। সম্ভবতঃ এঁরা ভিন্ন লৌকিক দেবদেবী। কেউ কেউ এঁদের ধনু-টঙ্কার ঠাকুর বলেও ডাকে। তবে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় সন্তানের জন্মের আগে তার মঙ্গল কামনায় আজও পেঁচো-পেঁচির নামে মানত করা হয়। অনেক সময় যুগ্ম ঘট স্থাপন করেও পেঁচো-পেঁচির পুজো হয়। আবার পঞ্চানন্দের অনেক মন্দিরে পঞ্চানন্দ ঠাকুরের সহচর হিসেবে পাঁচু ঠাকুরের মূর্তি দেখা যায়।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরে দেউলি সুলতানপুর গ্রামে পাঁচু ঠাকুরের মন্দির ও সামনে তাল গাছের নীচে দেবতার প্রতীক।

সাম্প্রতিককালে দেখেছি সুন্দরবন এলাকায় পাঁচুঠাকুরের প্রভাব অনেক কমেছে। হয়তো চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস ও মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিই এর কারণ। আবার পাঁচুঠাকুরের সঙ্গে পঞ্চানন্দ মিশে গিয়ে শেষে পৌরাণিক দেবতা শিবে উত্তরণও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনও আমার নজরে এসেছে, কেউ কেউ মুখে পাঁচু ঠাকুরের মানত করেছে বলে পাঁচুগোপাল মন্দিরে অর্থাৎ কৃষ্ণের কাছে পুজো দিয়ে এসেছে। আজকাল অনেক লৌকিক দেবতার থানে দেখি স্থান পেয়েছে শিব, কালী, গনেশ বা রাধা-কৃষ্ণের মতো পৌরাণিক দেবদেবী। অব্রাহ্মণ পুরোহিতের স্থান নিয়েছেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত। সুতরাং সুন্দরবন অঞ্চলে পাঁচুঠাকুরের অস্তিত্ব কতদিন থাকবে তা ভবিষ্যতই বলবে।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content