শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


প্রথম স্বদেশি বিজ্ঞানী।

গ্রেট ট্রাইগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে প্রকল্পের এক নেটিভ গণক তাঁর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী মেধা, অঙ্কের তুখোড় দক্ষতা ও অনেক হিসাব-নিকাশ কষে তাঁর উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সার্ভেয়ার জেনারেল জর্জ এভারেস্ট সাহেবকে বললেন ‘১৫ নং’ শৃঙ্গই হল পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। উচ্চতা ২৯০০২ ফুট, সাল ১৮৫২। ভারত তখন পরাধীন, ইংরেজ পদানত। তাই ‘১৫ নং’ শৃঙ্গের নাম হল ‘মাউন্ট এভারেস্ট’, ‘মাউন্ট রাধানাথ’ নয়।
ভারতে প্রথম স্বদেশি বিজ্ঞানী, স্বাধীনচেতা, নব্যবঙ্গ ডিরোজিয়ান, সমাজ সংস্কারক রাধানাথ শিকদার। কলকাতা জোড়াসাঁকো প্রধানত দুটি কারণে বিখ্যাত, প্রথমত: রাধানাথ শিকদার, দ্বিতীয়ত: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান এই অঞ্চলে। ১৮১৩ সালের অক্টোবর মাসে এক শিক্ষিত, যুক্তিবাদী, শিকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পরাধীন ভারতের জ্ঞানসূর্য রাধানাথ শিকদার। হিন্দু কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক হিসাবে পান দুই বিখ্যাত ব্যক্তির সান্নিধ্যে—এক, হেনরি লুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও, দুই. জন টাইটলার। ডিরোজিওর কাছে পান এক দৃঢ় যুক্তিবাদী মন ও টাইটলারের কাছে পেয়েছিলেন বিজ্ঞানী অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা।

ডিরোজিও এবং টাইটলার তাঁর সারা জীবনের পথের পাথেয় হয়। খুব সম্ভবত তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি নিউটনের প্রিন্সিপিয়া পড়েছিলেন অতি অল্প বয়সেই। কলেজে পড়ার সময়ই ত্রিকোণবিদ্যাতে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন, যা পরবর্তীকালে পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ পরিমাপে সাহায্য করে। গণিত যদি তাঁর প্রথম প্রেম হয়, তাহলে নিশ্চিতরূপে তাঁর দ্বিতীয় প্রেম জ্যোতির্বিজ্ঞান, যা তাঁকে ভারতের অন্যতম আবহাওয়াবিদ হতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন:

বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নাতি শিবতোষ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন প্রাণিবিদ্যার বাঘ

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৭: অ্যাঁ, বলো কী নন্দলাল…!

সমগ্র ভারতের জরিপ, ম্যাপ নির্ধারণ ও ভূপ্রকৃতি সম্বন্ধে নিখুঁত জানার জন্য ইংরেজ সরকারের পক্ষ থেকে এক প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়: ‘গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিক্যাল সার্ভে’ বা জিটিএস। এই সার্ভের কাজ দু’ রকম ভাবে করা হয়, এক. জরিপ, দুই. গণনা। রাধানাথ নেটিভ বলে মাত্র ৩০ টাকায় গণক বিভাগের কাজে যোগ দেন। অল্পদিনের মধ্যে সার্ভেয়ার জেনারেল, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জর্জ এভারেস্টের সুনজরে পড়েন। ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতায় প্রধান গণক পদে উন্নীত হন।

রাধানাথ গণক হলেও জরিপ বিভাগের ‘কোলবে বার সিস্টেম’-এর বিরল পরিবর্তন এনে, জরিপ পদ্ধতিরও আমূল পরিবর্তন ঘটান। ১৮৫১ সালে কলকাতায় তাঁর ওপর দায়িত্ব পরে ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ‘জিটিএস’ এর তথ্য বিশ্লেষণ করা। সালটা ১৮৫২, হঠাৎ করে ‘১৫ নং শৃঙ্গ’র বিভিন্ন তথ্য, চিত্র ইত্যাদি বিশ্লেষণ করতে করতে দেখেন ‘১৫ নং’ শৃঙ্গের উচ্চতা ২৯ হাজার ফুট, পরে ২৯০০২ ফুট, যা পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বলে তিনি দাবি করেন।
আরও পড়ুন:

প্রথম আলো, পর্ব-৮: বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র কোনটি?

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১৩: সাগর দীঘির ধারে হিরণ্যগর্ভ শিবমন্দির ও মধুপুর ধাম

রাধানাথ ইংরেজি সরকারের কাছে দাবি করেন, এটিই হল পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। নড়েচড়ে বসল প্রশাসন, চারিদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হল। শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাঁকে। মেনে নেওয়া হয় ‘১৫ নং শৃঙ্গ’ই পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। সমগ্র পৃথিবীতে বিরাট উন্মাদনা সৃষ্টি হয় যে শৃঙ্গকে নিয়ে, সেই শৃঙ্গের আবিষ্কার কর্তা চলে গেলেন প্রদীপের নিচে অন্ধকারে, ফ্লাশলাইট চলে এল জর্জ সাহেবের উপর, যার কিনা কোনও ভূমিকাই নেই এই উচ্চতম শৃঙ্গ আবিষ্কারে। এটাই ভাগ্যের পরিহাস, যা পরবর্তীকালে তাড়া করেছিল জগদীশ বোস ও সত্যেন বোসকেও।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৮: চোখিধানির জগৎখানি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪০: ব্রণ হয়েছে? তার মানেই কি লিভার খারাপ?

 

আবহাওয়াবিদ শিকদার

পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আবিষ্কার করেই তিনি কেবল ক্ষান্ত ছিলেন না, তিনি নিজেকে একজন বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ হিসাবেও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একজন মানুষের কী অদ্ভুত প্রতিভা থাকলে দুই ভিন্নধর্মী বিদ্যায় নিজেকে এমন ভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, রাধানাথবাবু ছিলেন সেই ব্যাতিক্রমী বিজ্ঞানী, যিনি আবহাওয়াবিদ্যারতেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার আবিষ্কৃত ‘সিকদার ফর্মুলা’ ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ মাপতে ব্যবহৃত হয়। মাঝ সমুদ্র থেকে জাহাজের বিভিন্ন বন্দরে আসার জন্য ‘টাইম সিগনালিং’ পদ্ধতির স্রষ্টাও তিনি। আবার এক দ্রাঘিমা থেকে অন্য দ্রাঘিমা যাওয়ার সময়, সময় পরিবর্তনের এক চার্ট জাহাজে রাখা হল তা ‘টাইমবল’ নামে পরিচিত ছিল। বলাই বাহুল্য তা রাধানাথ শিকদারের মস্তিষ্কপ্রসূত। এছাড়াও কলকাতা আবহাওয়া দপ্তরে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় বায়ুর গতি, চাপ ও উষ্ণতা নিরূপণ করার ব্যবস্থা তিনিই প্রথম শুরু করেন‍।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’

 

লেখক ও মানুষ রাধানাথ

আমৃত্যু ডিরোজিয়ান রাধানাথ ছিলেন হীরক শ্রেষ্ঠ কোহিনুর। একজন শ্রেষ্ঠ ও সর্বোপরি এক সম্পূর্ণ মানুষ। বাল্যবিবাহ ঘৃণা করতেন, তাই মায়ের আদেশ সত্বেও চার বছরের এক বালিকাকে বিবাহ করতে রাজি হননি। সারাজীবন অকৃতদার ছিলেন। শিক্ষা বিস্তারে টেকচাঁদ ঠাকুরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করেছিলেন। কোনও কুসংস্কারে তাঁর বিশ্বাস ছিল না, ছিল এক যুক্তিবাদী মন, যা তাঁকে এক সেরা বিজ্ঞানী হতে সাহায্য করেছিল। নেটিভ কুলিদের ওপর গোরাদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় তাঁর জরিমানা হয়েছিল এক বিপুল অঙ্কের টাকার, তা সত্বেও তিনি কখনও দমে যাননি।

তাঁর লেখা বই ‘দ্য ম্যানুয়াল অফ সার্ভেয়িংস’ (The Manual of Surveyings) আজও জরিপ বিদ্যায় পাঠ্যবই হিসাবে আদৃত। আজ বাঙালি হিসাবে, ভারতীয় হিসাবে বিজ্ঞানী রাধানাথ শিকদারের জন্য আমরা গর্বিত। আজ দিকে দিকে তাই দাবি উঠেছে ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ নয় ‘১৫ নং শৃঙ্গ’র নাম পরিবর্তন করে হোক ‘মাউন্ট রাধানাথ’ তবেই ইংরেজদের মুখের ওপর জবাব দেওয়া হবে।

* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content