বৃহস্পতিবার ৩ অক্টোবর, ২০২৪


হিরণ্যগর্ভ শিবমন্দির ও মধুপুর ধাম। ছবি: সংগৃহীত।

 

সাগর দীঘির ধারে হিরণ্যগর্ভ শিবমন্দির

শিব পুজোর মরশুম এলেই শহরের নতুন বাজার এলাকায় রাধা কৃষ্ণের লীলা কীর্তন মহোৎসব। প্রায় সাত দিন ধরে বাজার এলাকায় বসত অদ্ভুত রঙিন চাঁদোয়ার নীচে বিভিন্ন দিক থেকে আগত কীর্তনীয়ার ভিড়। প্রহরে প্রহরে, সময়ের ভাগ থাকত-কখন বাল্য লীলা পর পর কালীয় দমন তার আগে জন্মকথা তো ছিলই। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ‘নৌকা বিলাস’। এই প্রবন্ধ কারের বাড়ি বৈষ্ণব মতাবলম্বী। বাড়িতে দাদু ঠাকুর্দার আমল পেরিয়ে জেঠু-বাবার হাত ধরে ওই কীর্তনের আসর দেখেছি। রাত জেগেছি। অষ্টপ্রহর শুরুর আগে চন্দন বেটে কপালে গাঁদা ফুল দিয়ে সকলকে টিপ এঁকেছি। সেই কোন শৈশব থেকে। তাই আগ্রহ উৎসাহ ভিতরে তো থাকেই।

সেই সঙ্গে আর একটি ব্যাপার লক্ষ্য করেছি সপ্তাহান্তে বা মাসে অন্তত একবার মদনমোহন বাড়ি থেকে সেবায়েত মাঝ দপুরে বা বিকেলে পুজো শেষে মদনমোহনের প্রসাদ কালো কাঠের বারকোশে এ বাড়িতে কর্তার নামে এনে দিত। শুনেছি বহু পুরোনো বিশিষ্ট মানুষের বাড়িতেই এ প্রসাদ যেত। এত ভালো লাগত ওই সামান্য পরিমাণ প্রসাদ সকলে মিলে খেতে। ছানা, মিছরি, ফল এসবই সাদা সুতোর কাজের কাপড়ের ঢাকনায় ঢেকে নিয়ে আসতেন। আমরাও অপেক্ষায় থাকতাম, নিজেদের ভাগ্যবান মনে হতো।

হিরণ্যগর্ভ শিবমন্দিরের কথা বলতে গেলে আমাদের সেই কৈশোর বেলা ঘুরে ঘুরে আসে। বাড়ির মেয়ে বউয়েরা সকলে শিব পুজোর নির্জলা উপোস করত। কেউ কেউ আগের দিন থেকে পারণ পর্ব ও চালাত। এর পিছনে মা জেঠিমার নিশ্চুপ এক পরামর্শ ছিল। উপোস করলে শিবচতুর্দশীতে শিবের মতো বর পাওয়া যায়। ফলে পাড়ায় সমবয়সী বন্ধুরাও বাদ যেত না। সকলে সন্ধে পর্যন্ত চূড়ান্ত ক্ষিধে হজম করে শুকনো মুখে পিতলের ঘটিতে দুধ, তোর্সার ধার থেকে ধুতুরা, ভাঁট ফুল আর বাড়ির উঠোনেই বড় বেলগাছ থেকে বোঁটা শুদ্ধ বেল নিয়ে শিব পুজোর উদ্দেশে রওনা হতাম। মনে আছে, খালি পায়ে যেতাম সকলে। আমরা যারা ছোটর দল তারা নতুন বাজারের মোড়ের পুরোনো এক ভাঙাচোরা শিবমন্দিরে জল ঢেলে পুজো মন্ত্র আওড়ে ছুটে বাড়ি এসে মা বা জেঠিমার সঙ্গে প্রসাদ খেতাম। সেই ভাঙা মন্দিরটি এখন আর নেই। বিরাট দোকান বাজারে ভরে গিয়েছে।

একটু বড় হতে মা জেঠিমার সঙ্গে ওই সাগর দীঘির ধারের শিবমন্দিরে পুজো দিয়েছি দু’ এক বার। সেখানে এত ভিড় যে, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সময় বয়ে যেত। অনেকের ধারণা আজো এই মহাদেব জাগ্রত।
আরও পড়ুন:

কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১২: স্বপ্নাদেশের দেবী ভবানী

দেশের প্রথম আধুনিক চিত্রকর নিরীহের হত্যা মানতে না পেরে গৃহত্যাগী হন

সাগর দিঘির পশ্চিম তীরে ইটের তৈরি এই শিব মন্দিরটি প্রায় ১২ফুট। চারচালা। উপরে গম্বুজ। নকল দরজা ও জানালা আছে মন্দিরের গায়ে। হিরণ্যগর্ভ শিব নামে খ্যাত। লিঙ্গটি বেদীহীন ভিত্তির উপর মাটির সমতলে প্রতিষ্ঠিত। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ণ এই মন্দির স্থাপন করেন। বর্তমানে রূপ অনেক পরিবর্তন হয়েছে মন্দিরের।

মন্দিরটি পূর্বমুখী, সকাল থেকে সন্ধে পুজো হয়। খোলা থাকে বিভিন্ন পালা পার্বণে। শিবচতুর্দশীতে এখন ওই মন্দিরের বিপরীত দিকে সাগর দীঘির ঘাটের উপর উৎসব, ভক্তিগীতি, পুজোর প্রসাদ বিতরণ নতুনভাবে হয়। যেটা আগে তেমন নজরে পড়ত না। প্রাতর্ভ্রমণ বা সান্ধকালীন ভ্রমণের জায়গা এই সাগরদীঘি পুরোনো চত্বর। সাগরদীঘিকে সম্পূর্ণ ঠিকমতো একবার ঘুরলে এক কিমি হাঁটা হয়। সুতরাং শরীর স্বাস্থ্য রক্ষায় সাগর দীঘির পাড়ের চওড়া রাস্তা পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ বড়ই খোলামেলা রাখা প্রয়োজন। রাখার চেষ্টা করা হয় বটে, বর্তমানে ‘হেরিটেজ শহর’ কোচবিহারে নানা কাজকর্ম চলতে থাকায় রাস্তা সাগর দীঘির পাড় বহুদিন ধরে হাঁটাচলার অনুপযুক্ত হয়ে আছে। মানুষকে অসুবিধেয় পড়তে হচ্ছে তো বটেই। এখন এই মন্দিরটিকে অপূর্ব আলোক মালায় সজ্জিতও করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:

পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত এই তিন মন্দির ছাড়াও শহরের এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে বহু মন্দির। যেমন, রাজমাতা ঠাকুরবাড়ি, অনাথ শিবমন্দির, শনি মন্দির, ব্রহ্মচারী কালী মন্দির, গঙ্গা বিষণ ঠাকুরবাড়ি, গজেন্দ্র নারয়ণ প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দির, নিউ ডাবরি শিবমন্দির, মারোয়াড়িদের বিষ্ণু ও রাধা গোবিন্দ মন্দির। সেই সঙ্গে আছে পুরাণ মসজিদ, গির্জা, ব্রাহ্ম মন্দির। বর্তমানে শহরে রাজবাড়ি এলাকা পেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছাকছি এলে বড় লোকনাথ বাবার মন্দির আছে। হাসপাতালের পাশেও একটি লোকনাথ বাবার মন্দির আছে। নিত্য পুজো হয় এই দুই মন্দিরেই।

শিবের উপাসক বলা হলেও মহারাজাদের মধ্যে ধর্মের গোঁড়ামি খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন মদনমোহন বাড়ি ও দেবী ভবানী মন্দির। ধর্ম সমন্বয়ের আর এক নিদর্শন মধুপুর ধাম। শহরের উপকন্ঠে এবং বিভিন্ন মহকুমায় আছে অনেক ঐতিহাসিক দেব দেউল। এদের মধ্যেই এক গুরুত্বপূর্ন তীর্থস্থান এই মধুপুর ধাম।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৯: খাবারে একদম মশলা নয়?

পরিযায়ী মন, পর্ব-৮: চোখিধানির জগৎখানি

 

মধুপুর ধাম

শহর থেকে প্রায় সাড়ে নয় কিলোমিটার দূরে মধুপুর গ্রামে শঙ্করীয় বৈষ্ণবদের বিখ্যাত তীর্থস্থান মধুপুর ধাম। ১৯৬৪ সালে রেখ দেউলের অনুকরণে যে পাকা মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছে তারই নাম শঙ্কর মন্দির বা শ্রী মন্দির নামে পরিচিত। পূর্বমুখী এই মন্দিরের দেয়ালের ও শিখরের প্রস্থচ্ছেদ আটকোণ। দেয়ালের প্রতি অংশের দৈর্ঘ্য ১৪ ফুট ৫ ইঞ্চি। উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। কোচবিহারের মহারাজা, আসাম সরকার ও অসমীয়া বৈষ্ণব ভক্তদের অর্থ সাহায্যে এই মন্দিরটির নির্মাণ। মন্দিরের বাইরের অংশ ও নাট মণ্ডপ শ্বেত পাথরের। প্রবেশ পথের দেয়ালে বালি ও সিমেন্ট দিয়ে শুকদেব, পরীক্ষিৎ, সুগ্রীব, গজলক্ষ্মী, গড়েন ও হনুমানের মূর্তি উৎকীর্ণ। শ্রী মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি উঁচু রূপোর সিংহাসনের উপর ভাগবত দশম স্কন্ধের একটি পুঁথি, অসমীয়া বৈষ্ণব গুরুত্বপূর্ণ শঙ্করদেব ও মাধবদেবের যুগল ছবি, তাঁদের অস্থি খন্ড, রূপার হার, জপমালা, শঙ্করদেবের ব্যবহৃত দোয়াত কলম ও মাধবদেবের পাদুকা রক্ষিত আছে। অন্য পাশে কীর্তন ঘর ও দোল মন্দির। ধামের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দ আঁতৈ।—চলবে।

ঋণ স্বীকার:
কোচবিহার পরিক্রমা ও অন্যান্য

* মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস। সাহিত্যিক ও কবি। কোচবিহার সুনীতি অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষিকা। www.samayupdates.in -এ লিখছেন ‘কোচবিহারের রাজকাহিনি’। একাধিক উপন্যাস, ছোটগল্প সংকলন, প্রবন্ধ সংগ্রহ ও কাব্যগ্রন্থ রয়েছে লেখিকার।

Skip to content