![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/07/maa-sarada.jpg)
শ্রীমা।
দক্ষিণেশ্বরে সারদা মায়ের থাকার ব্যবস্থা নহবত বাড়িতেই করা হল। ১৮৪৭ সালে রানি রাসমণি গঙ্গাতীরের কুঠিবাড়ির সঙ্গে কুড়ি একরের এই জমি কেনেন, যেটি আগে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি জেমস হেস্টি সাহেবের ছিল, তখন এই স্থান ‘সাহেবান বাগিচা’ বলে পরিচিত ছিল। রাসমণি কালীমন্দির নির্মাণের দেখাশোনার জন্য জামাই মথুরবাবুকে নিয়ে প্রায়ই কুঠিবাড়িতে থাকতেন। পরবর্তী সময়ে ঠাকুর মন্দিরের পুরোহিত হয়ে এই বাড়ির নীচতলায় গঙ্গার দিকে একটা ঘরে বেশ ক’বছর ছিলেন। মথুরবাবুর দেহত্যাগের পর ঠাকুর কালীমন্দিরের উত্তর পশ্চিম দিকের ঘরে থাকতেন, বর্তমানে যাকে ‘ঠাকুরের ঘর’ বলা হয়।
এই কুঠিবাড়িরই পশ্চিমদিকে দোতলা নহবত বাড়ি। ঠাকুরের মা চন্দ্রমণিদেবী তাঁর নাতনি লক্ষ্মীর সঙ্গে নহবতেরই দোতলার একটা ঘরে থাকতেন। সারদা থাকতেন নহবতের নীচতলার ঘরে। এই ঘরটির আকার অষ্টভুজ ধরণের। ঘরের মেঝের পরিমাণ খুব বেশি হলে পঞ্চাশফুট। তার মধ্যেই মা সারদার খাওয়া, বসা, শোয়া। স্বল্প জায়গাতেই মায়ের রান্নার বাসন, হাঁড়ি, কড়াই, জলের মাটির জালা, মশলাপাতি, চাল, ডাল, তেল, নুন সব এক কোণে থাকত।
এছাড়া মাথার ওপরে শিকেগুলোতে থাকত ঠাকুরের জন্য হাঁড়িতে রাখা জিয়নো মাছ আর ওষুধ, পথ্য। রান্না করার স্থানটুকু না থাকায় সারদা সিঁড়ির নীচে রাঁধতেন। এই কারণে তাঁকে বারবার ঘর-বার করতে হত। ঘরের দরজা এত নীচু ছিল যে মাঝে মাঝে তাঁর মাথা ঠুকে যেত। অনেক সময় মাথায় ক্ষতও হয়ে যেত।
এছাড়া মাথার ওপরে শিকেগুলোতে থাকত ঠাকুরের জন্য হাঁড়িতে রাখা জিয়নো মাছ আর ওষুধ, পথ্য। রান্না করার স্থানটুকু না থাকায় সারদা সিঁড়ির নীচে রাঁধতেন। এই কারণে তাঁকে বারবার ঘর-বার করতে হত। ঘরের দরজা এত নীচু ছিল যে মাঝে মাঝে তাঁর মাথা ঠুকে যেত। অনেক সময় মাথায় ক্ষতও হয়ে যেত।
আরও পড়ুন:
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/07/sarada-maa.jpg)
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১২: জয়রামবাটিতে প্রত্যাবর্তন
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/09/Dream.jpg)
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৬: আজগুবি ‘নয়’, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা!
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/09/Sundarban-11.jpg)
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি
সারদা মায়ের ভাসুরঝি লক্ষ্মীও দোতলার ঘর ছেড়ে তাঁর কাছে শুতে আরম্ভ করল। এছাড়াও ঠাকুরের মহিলা ভক্তদের বসার ঘরও ছিল এইটি। ধর্মালোচনা শুনতে এসে বেশি রাত হয়ে গেলে মহিলা ভক্তদের ঠাকুর রাতে থাকার জন্য এই ঘরেই পাঠিয়ে দিতেন। তাঁদের জন্য সারদাকে আবার রাঁধতে হত। বিধবা মহিলা থাকলে তার জন্য আবার নতুন বাসন মেজে যা থাকত, তাই রান্না করে খাওয়াতেন। তার জন্য অনেক সময় সারদা মা নিজে অভুক্ত থাকতেন। যেমন সন্তানকে খাইয়ে মা ছিটেফোঁটা যা থাকে তাই খায়। শুধু কি তাই, অতিথিদের ওই ছোট ঘরে শোওয়ার জায়গা দিয়ে নিজে বসেই সারা রাত কাটিয়ে দিতেন। শ্রীমা কখনও একথা নিজমুখে বলতেন না। মাঝে-মধ্যে ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে বলেছেন, ‘নহবতে যে কি করে কাটিয়েছি তা কে বুঝবে’।
আরও পড়ুন:
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/09/Ishwar-Chandra-Vidyasagar.jpg)
পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/09/Street-Food.jpg)
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৭: ‘কর্ণ’nicles
শ্রীম’র স্ত্রী নিকুঞ্জদেবী, গোলাপমা, যোগিনমা সবাই বলত যে, মা এইটুকু ঘরে কী করে থাকে। সারদা বলতেন, ‘ঘর দেখেছ, ওপরে সব শিকে ঝুলছে, গেরস্ত ঘরে মানুষের যা যা দরকার, মশলা-টসলা সব, এমনকি ঠাকুরের জন্য মাছ পর্যন্ত জিয়নো আছে। সিধে হয়ে দাঁড়ানোর জো ছিল না, দাঁড়াতে গেলেই মাথায় লেগে লেগে ফুলে গিয়েছিল। তাতেই উঠতুম, বসতুম। আবার কোনও মেয়েকে ঠাকুর যদি বলতেন থাকতে, সেও আমার সঙ্গে সেইটুকুর ভেতর শুতো, হয়তো তাকে শুইয়ে আমায় বসে রাত কাটাতে হয়েছে’। ঠাকুর নিজেই নহবতের ঘরকে ‘খাঁচা’ বলতেন।
ঠাকুরের মহিলা ভক্তরা শ্রীমাকে দেখতে এসে বলতেন, ‘আহা, কী ঘরেই আমাদের সীতালক্ষ্মী আছেন গো, যেন বনবাস গো’। যেমন অসংখ্য কষ্টের মধ্যেও বনবাসকালে শ্রীরামের সঙ্গ লাভ করে সীতার মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে থাকত। কিন্তু এখানে কিছু দূরে থেকেও ঠাকুরের দর্শনলাভই অনেক সময় দুর্লভ হয়ে উঠত। নহবতের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাকুরকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে বাত হয়ে যায়। সেই বাতের যন্ত্রণা শ্রীমাকে সারাজীবন সইতে হয়েছে। দিন, রাত ঠাকুরের কাছে লোক আসছে আর সারদা নহবতের ঝুপড়ির ভেতর থেকে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে তাঁর কীর্তন শুনতেন ও মনে মনে প্রণাম করতেন।
ঠাকুরের মহিলা ভক্তরা শ্রীমাকে দেখতে এসে বলতেন, ‘আহা, কী ঘরেই আমাদের সীতালক্ষ্মী আছেন গো, যেন বনবাস গো’। যেমন অসংখ্য কষ্টের মধ্যেও বনবাসকালে শ্রীরামের সঙ্গ লাভ করে সীতার মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে থাকত। কিন্তু এখানে কিছু দূরে থেকেও ঠাকুরের দর্শনলাভই অনেক সময় দুর্লভ হয়ে উঠত। নহবতের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাকুরকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে বাত হয়ে যায়। সেই বাতের যন্ত্রণা শ্রীমাকে সারাজীবন সইতে হয়েছে। দিন, রাত ঠাকুরের কাছে লোক আসছে আর সারদা নহবতের ঝুপড়ির ভেতর থেকে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে তাঁর কীর্তন শুনতেন ও মনে মনে প্রণাম করতেন।
আরও পড়ুন:
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/09/Travel-1-1.jpg)
পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/09/Cooch-Behar-Palace-1.jpg)
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১২: স্বপ্নাদেশের দেবী ভবানী
ঠাকুরের মেয়ে ভক্তদের দেখে সারদা ভাবতেন, তিনিও যদি তাঁর মেয়ে ভক্ত হতেন, তবে তাঁর কাছে বসে কত কথা শুনতেন। তৃষিতা চাতকীর মতো সারদা নহবতবাড়িতে ঠাকুরের অপেক্ষায় সীতাদেবীর মত যেন নির্বাসিত জীবন যাপন করতেন। দক্ষিণেশ্বরের খাজাঞ্চি একবার বলেছিলেন যে, তিনি এখানে আছেন শুনেছি, তবে কখনও দেখিনি। নহবত থেকে লোকের সামনে সারদার বেরনোও কঠিন ছিল এমনকি, প্রাকৃতিক প্রয়োজন চেপে রাখতে রাখতে তাঁর স্থায়ী পেটের অসুখ হয়ে যায়।
সারদা মায়ের কষ্ট ঠাকুরের হৃদয়েও স্পর্শ করত। তিনি বলতেন, বুনোপাখি খাঁচায় রাতদিন থাকলে বেতে যায়। দুপুরে যখন কালীমন্দিরে খাওয়ার পর্ব মিটলে সকলে বিশ্রাম নিত; তখন ঠাকুর পঞ্চবটীতে গিয়ে নিজে দেখে আসতেন কেউ আশে-পাশে আছে কিনা। যদি দেখতেন কেউ নেই, তখন মা সারদাকে বলতেন, ‘এই সময় যাও, কেউ নেই’। সারদাও পাঁড়ে গিন্নীদের কাছে বেড়াতে যেতেন। সন্ধ্যার সময় যখন সকলে কালীমন্দিরের আরতি দেখতে যেত। তখন সারদা ফিরে আসতেন।—চলবে।
সারদা মায়ের কষ্ট ঠাকুরের হৃদয়েও স্পর্শ করত। তিনি বলতেন, বুনোপাখি খাঁচায় রাতদিন থাকলে বেতে যায়। দুপুরে যখন কালীমন্দিরে খাওয়ার পর্ব মিটলে সকলে বিশ্রাম নিত; তখন ঠাকুর পঞ্চবটীতে গিয়ে নিজে দেখে আসতেন কেউ আশে-পাশে আছে কিনা। যদি দেখতেন কেউ নেই, তখন মা সারদাকে বলতেন, ‘এই সময় যাও, কেউ নেই’। সারদাও পাঁড়ে গিন্নীদের কাছে বেড়াতে যেতেন। সন্ধ্যার সময় যখন সকলে কালীমন্দিরের আরতি দেখতে যেত। তখন সারদা ফিরে আসতেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।