সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

প্রায়শই অ্যালার্জির কারণে প্রচণ্ড চুলকানির সঙ্গে ত্বকে ফুটে ওঠে নানা আকারের ফোলা ফোলা দাগ। আবার ভাগ্য ভালো হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওই দাগ মিলিয়েও যায়। কখনও আবার চুলকানি চলতেই থাকে, অনেকে চুলকিয়ে ত্বক ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেন। তাই এ এক দুরুহ সমস্যা। যখন খাদ্য খাবারের মাধ্যমে বা পানীয়ের মাধ্যমে শরীর পছন্দ করেনা তেমন জিনিস শরীরের মধ্যে যায়, এমনকি গন্ধ দ্রব্য বা গায়ে লাগানো কোনও দ্রব্য বা শরীরের পরিধেয় জামাকাপড়, গামছা, বিছানার চাদর ইত্যাদি যখন শরীর আপন করে নিতে পারে না, তখন তার বিরুদ্ধে জেহাদ জানিয়ে ত্বকে চুলকানি, রেশ বার করা, ফোলা, জ্বালা ইত্যাদি প্রকাশ করে।

আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় একে অ্যান্টিজেন-আন্টিবডি-রিয়েকশনও বলা হয়। হঠাৎ হয়ে আবার কমে গেলে সেটা অ্যাকিউট আর্টিকেরিয়া। যদি না কমে তবে বড় ধরনের বিপদ অ্যানাফাইলেকটিক শক্ ও হতে পারে। আবার যদি অনেকদিন ধরে এই চুলকানি র রেশ বেরুনো চলতে থাকে তবে তাকে ক্রনিক আর্টিকেরিয়া ও বলে। যদি ছয় সপ্তাহের বেশি এই চুলকানি ও রেশ এর আসা যাওয়া চলতে থাকে, তবে তাকে ক্রনিক প্রুরাইটাসও বলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যত ধরনের অ্যালার্জি, যেমন শ্বাসকষ্ট বা খাদ্যদ্রব্য সংক্রান্ত অ্যালার্জি আছে তার মধ্যে ত্বকের চুলকানিতে প্রায় ৪৭ শতাংশ মানুষ ভোগেন। সাধারণত আধুনিক চিকিৎসায় অ্যান্টিহিস্টামিন প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু তাতে তৎকালীক কিছুটা কষ্ট লাঘব হলেও, আবার চুলকানি ও রেশ ফিরে আসে। স্টেরয়েড ইত্যাদি প্রয়োগও ডাক্তারবাবুরা করেন, কিন্তু তাতেও ক্রনিক সমস্যা মেটে না। অধিকন্তু সেই সমস্ত ওষুধগুলি নিয়ে আসে অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, যা বাঞ্ছনীয় নয়।

দেখা যাক প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র এই সমস্যার সমাধানের কী উপায় নির্ধারণ করেছে।
আয়ুর্বেদের তিনটি বিশেষ রোগকে লক্ষণগত সাদৃশ্য অনুযায়ী এই ধরনের সমস্যার পাশে দাঁড় করানো যেতে পারে। যা ক্রনিক আরটিকেরিয়া বা অ্যালার্জিক স্কিন রিঅ্যাকশনের সমতুল্য। সেই তিনটি রোগ হল শীতপিত্ত, উদর্দ এবং কোঠ। শীতপিত্ত নামক সমস্যাতে ত্বকের উপর ভোমরা কামড়ানোর মতো লাল আভাযুক্ত ফোলা ফোলা দাগ দেখা যায়, উদর্দ রোগে ত্বকের উপর প্রচণ্ড চুলকানির সঙ্গে ফোলা ফোলা দাগ দেখা দেয়, আর কোঠ রোগে প্রচণ্ড চুলকানির সঙ্গে লাল ফোলা চাকতির মতো দাগ তৈরি হয়, এবং বারবার যদি এরকম প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, তখন তাকে উৎকোঠ বলা হয়।
আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: মুখের লাল-কালো-বাদামি দাগ-ছোপ কিছুতেই কমছে না? সমাধান লুকিয়ে আছে আয়ুর্বেদে

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৮: আমি শুনি গো শুনি তোমারে…

 

শীতপিত্ত, উদর্দ এবং কোঠের নিদান বা কারণ

অত্যধিক শীতল বাতাসের সংস্পর্শে থাকা, বমির বেগকে চেপে রাখা, পঞ্চকর্মের বিশেষ করে বমন কর্মের যদি সম্যক যোগ না হয়, গরম ও ঠান্ডা পানীয় বা খাদ্য যদি একসঙ্গে নেওয়া হয়, গরম ও ঠান্ডা পরিবেশে বারবার যাতায়াত করা হয়, অসাত্ম্য আহার বা পানীয় অর্থাৎ সংযোগ বিরুদ্ধ আহার যেমন: দই, পায়েস, মাংস ইত্যাদি একসঙ্গে ভোজন করা, যা সহজপাচ্য নয়, বিষাক্ত, দুষ্ট, কীটদ্রংস্ট্র, কৃমি কীটের দংশন, দুষিত মদ্যপান, আঁশযুক্ত খাবার, ছুঁচোলো মুখযুক্ত গণ্ডপদ কৃমির স্পর্শ, যেমন শুঁয়োপোকা ইত্যাদির সংস্পর্শ।
 

রোগ উৎপত্তির ক্রম

পূর্বে উল্লিখিত নিদান বা কারণগুলি থেকে কফ ও বায়ু প্রকুপিত হয়, পাশাপাশি অন্যভাবে পিত্ত ও প্রদূষিত হয় এবং ত্বক রক্ত ইত্যাদি ধাতুর মধ্যে প্রসরিত হয়ে বাহ্য ত্বকে এসে স্থান সংশ্রয় করে , অভ্যন্তরীণ রক্তাদি ধাতুকে দূষিত করার কারণে ফোলা ও চাকতির মতো দাগ ত্বকে দেখা যায়।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩০: আ দেখে জারা কিসমে কিতনা হ্যায় দম… এই গানে পঞ্চমের বাজি ছিলেন কিশোর ও আশা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?

 

রোগের লক্ষণ

 

শীতপিত্ত

যেখানে বায়ু দোষের প্রাবল্য। ত্বকে ভোমরা দংশনের মতো চাকতি আকারের ফোলা, চুলকানি, সুচ ফোটানোর মতো ব্যথা, বমি, জ্বর, দাহ ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
 

উদর্দ

যেখানে কফ দোষের আধিক্য থাকে। মাঝখানে নিচু অথচ চারদিকে ওঠানো ফোলা, লাল রক্তবর্ণ এবং চুলকানি যুক্ত ফোলা যা চক্রাকারও বটে। শীতকালে বেশি দেখা যায়।
 

কোঠ

সাধারণত বমন কর্মের অসম্যক যোগ থেকে হয়। অথবা স্বাভাবিক বমির বেগকে রোধ করলে এই কোঠ উৎপন্ন হয়। এখানে লাল আভাযুক্ত চুলকানি-সহ চাকা চাকা ফোলা দেখা যায়। মূলত পিত্ত ও কফ দোষের আধিক্য থাকে।
 

চিকিৎসা

সাধারণত শীতপিত্ত, উদর্দ ও কোঠ একই রকম ভাবে চিকিৎসিত হয়।
প্রথমত নিদান পরিবর্জন অর্থাৎ যে কারণগুলি আগে বলা হয়েছে তা বাদ দিতেই হবে। যেমন দুষ্ট ভোজন, শীতল ও উষ্ণ ক্রিয়া একইসঙ্গে করা ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে।
সংশোধন চিকিৎসা তেল মেখে মাসাজ বা অভ্যঙ্গ, বিভিন্ন ঔষধাদি দ্রব্য সেদ্ধ করে সেই জলের সেঁক, বমন কর্ম, বিরেচন কর্ম, রক্তমোক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে শরীরকে ডিটক্সিফাই বা শোধন করে নিতে হবে।
সরষে তেল মাখা, গরম জলে স্নান, পটলপাতা, নিমপাতা ও বাসকপাতা চূর্ণ বা ফোটানো জল খাইয়ে বমি করানো, ত্রিফলা চূর্ণ খাইয়ে পায়খানা করানো, মহাতিক্ত ঘৃত খাওয়ানোর পর জলৌকা ইত্যাদি প্রয়োগ করে রক্তমোক্ষণ করানো হয়

আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১২: জয়রামবাটিতে প্রত্যাবর্তন

 

সংশমন চিকিৎসা (ঔষধ খাইয়ে শরীরের দোষকে সাম্যাবস্থায় আনা)

 

চূর্ণ

ত্রিফলা চূর্ণ, পঞ্চশিরীষ চূর্ণ, ত্রিকটু চূর্ণ যেকোনও একটি ৩ গ্রাম করে দু’বার জল, দুধ ও চিনি অনুপান সহকারে খাওয়া যেতে পারে।
 

ক্বাথ

অমৃতাদি যোগ ২০ মিলি লিটার করে দু’ বার খাওয়া যায়।
 

বটি

আরোগ্য বর্ধনী বটি বাতস্পর্শনী বটি ২৫০ থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম খাওয়া যেতে পারে।
 

পাক বা খণ্ড বা লেহ

হরিদ্রা খণ্ড, বৃহৎ হরিদ্রা খণ্ড, আদ্রক খণ্ড, নিম্বপত্রাদি লেহ এদের যেকোনও একটি ৩ থেকে ৬ গ্রাম খাওয়া যায়।
 

ঘৃত

মহাতিপ্ত ঘৃত, বাসা ঘৃত ৫ থেকে ১০ গ্রাম খাওয়া যায়।
 

রসৌষধি

সর্বতোভদ্র রস, কাম দুধা রস, প্রবাল ভস্ম, সুতশেখর রস, চন্দ্রকলা রস ১২৫ মিলিগ্রাম থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার মধু-সহ খাওয়া যায়।
 

মালিসার্থক তেল বা প্রলেপ

চন্দনাদি তৈল, দূর্বাদি লেপ, সৈন্ধবাদি লেপ।
 

পথ্য

পুরানো শালি চাল, মুগ, করলা, সজিনা, মধু, সর্ষপ তেল, গুলঞ্চ, রক্ত চন্দন, উপবাস, মাসাজ।
 

অপথ্য

মিষ্টি জাতীয় জিনিস, পায়েস, জলজ প্রাণীর মাংস, নতুন মদ, সংযোগ বিরুদ্ধ খাদ্য, টক, কড়াপাক খাবার, বমির বেগ চেপে যাওয়া, দিনে ঘুম, উষ্ণ ও শীতল ক্রিয়া একযোগে করা ইত্যাদি

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content