লেখকের সঙ্গে অন্যরা।
আমাদের দেশে খুব গভীর এবং অপেক্ষাকৃত কম গভীরতার জলাধারের সংখ্যা অনেক। ছোট আকারের জলাধার ধরলে সংখ্যা তো অগুণতি। বিশাল এইসব হ্রদ বা জলাধার যাই বলি না কেন, এগুলি মাছ চাষের জন্য খুবই সম্ভাবনাপূর্ণ। এতদিন এইসব জলাশয়ে মাছচাষের কথা তেমনভাবে ভাবাই হয়নি। হয়তো এই বিশাল জলাধারে মাছ ছেড়ে তাকে ধরা খুব কঠিন কাজ।
এখন খুব দেখা যায়, এই জলাধারগুলির মধ্যে ঘেরাটোপ তৈরি করে তার মধ্যে খুব ভালোভাবে মাছ চাষ করা সম্ভব। অর্থাৎ এই ঘেরির মধ্যে মাছের চারা ছেড়ে সেগুলিকে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করে, বাইরে থেকে খাবার যোগান দিয়ে, মাছ সহজেই বাড়িয়ে তোলা সম্ভব। খাঁচাতে আঙুলের আকারের পোনা ছেড়ে তিন মাসের মধ্যেই খাবার মতো সাইজের মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। খাঁচা বা ঘেরি নির্মাণের জন্য সহজ সরল প্রযুক্তির ব্যবহার করে, স্থানীয় লোকজনের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এবং স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার করে, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগতভাবে টেকসই মাছ চাষ করা সম্ভব। এতে বিশালাকৃতি এই জলাধারের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যের কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭২: প্রজননক্ষম মাছের চাষে মুনাফা ভালো, তবে কোন কোন বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে?
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৬: ‘কোনওদিন কিছুই ছিল না, কিছুই কিছুই নেই আমাদের আজ’
এই বিষয়ে আই সিএআর-এর ব্যারাকপুরস্থিত গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন। তাঁরাও মনে করেছেন, অর্থনৈতিকভাবে এইসব জলাধারে মাছচাষ বেশ সম্ভাবনাময়। তাঁদের কতগুলি বিশেষ পরামর্শ আছে, সেগুলি মেনে চললে এই মাছচাষ খুব সুন্দরভাবে চলতে পারে। যেমন জলাশয়ের গভীরতা যেখানে কমপক্ষে পাঁচ মিটার, ঢেউ অপেক্ষাকৃত কম, জলজ উদ্ভিদ যেখানে কম থাকে, এইরকম জায়গা খাঁচা বা ঘেরি স্থাপন করার জন্যে আদর্শ জায়গা। বেশি জলজ ঝাঁঝি থাকলে সেই জায়গাটি পরিষ্কার করে নেওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন:
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৫: ‘আপনজন’ Chronicles
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল
খাঁচার কাঠামোর জন্যে হাইডেনসিটি পলিথিনের তৈরি ড্রাম, নাটবল্টু বাঁশ ইত্যাদি ব্যবহার করে পোক্তভাবে খাঁচার কাঠামো নির্মাণ করা যেতে পারে। যাতে খাঁচাগুলি অন্যত্র ভেসে যেতে না পারে তার জন্যে নোঙর ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে। মাছ বিশেষে এবং সাইজের ওপর নির্ভর করে একটি খাঁচায় কতগুলি আঙুলে পোনা ছাড়া যেতে পারে তারও একটা হিসাব ওই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ
রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাঁদের পরামর্শ, বিশেষ করে খাঁচার জলের গুণমান নিয়মিত পরীক্ষা করা, খাঁচার জাল নিয়মিত পরিষ্কার করা, সঠিকভাবে সঠিক সময়ে ও পরিমাণে খাবার দেওয়া, ইত্যাদি ব্যাপারেও তাদের খুব সুন্দর পরামর্শ লিখিত আকারে প্রকাশ করেছেন। যদি খাঁচার সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় এবং যথাযথভাবে খাবার প্রয়োগ করা যায় তাহলে মাছের বাড়বৃদ্ধি বেশ ভালোই হবে। সেক্ষেত্রের আয়ব্যয়ের অনুপাত ২.২ : ১ পর্যন্ত হতে পারে।
চলছে প্রস্তুতি।
খুব সম্প্রতি বাঁকুড়া জেলার মুকুটমণিপুর বাঁধে খাঁচায় মাছ চাষ খুব সুন্দরভাবে চলছে। এর আগে মাইথনে ড্যামেও অনুরূপভাবে সফল উপায়ে জলাধারের মধ্যে খাঁচা স্থাপন করে মাছ চাষ সম্ভব হয়েছে। আমাদের সব জলাধারগুলি এইভাবে মাছ চাষে আওতায় আনতে পারলে আমাদের মাছের ফলন উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ানো সম্ভব। সেই সঙ্গে স্থানীয় মানুষজনও আয়ের একটি পথ খুঁজে পাবেন।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।