রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


১২৮০ সালের ১৩ জ্যৈষ্ঠের অমাবস্যার রাত্রিতে দক্ষিণেশ্বরে ফলহারিণী কালীপূজোর দিন ঠাকুর সারদা মাকে ষোড়শী জ্ঞানে বিশেষ পূজার আয়োজন করেন। তবে ভবতারিণী মায়ের মন্দিরে নয়, নিজের ঘরে গোপনে। সাধনা গোপনেই করতে হয়, নাহলে ইষ্টসিদ্ধি হয় না।
ভাগনে হৃদয় কিছুটা পুজোর সাহায্য করে। তারপর তাকে ঠাকুর মন্দিরে ফলহারিণী কালীর বিশেষ পুজোর জন্য পাঠিয়ে দেন। এই তিথিতে দেবীর আরাধনা করলে তিনি সাধকের কর্মফল হরণ করে তাকে মোক্ষ দান করেন। এই দেবীই প্রথম মহাবিদ্যারূপিণী কালী যিনি কালকেও হরণ করেন। তাই তিনি ফলহারিণী। ফল দিয়ে তাঁর অর্চনা করা হয়। সে-দিন পূজারি দীনু রাধাগোবিন্দ মন্দিরের রাতের পুজো সেরে ঠাকুরকে পুজোর যোগাড়ের বাকিটা সাহায্য করে গেল। সব আয়োজন শেষ করতে প্রায় রাত ন’টা বেজে গেল। শ্রীমাকে আগেই বলা ছিল। এ বার ঠাকুর তাঁকে নিজের ঘরে আনালেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…

যত মত, তত পথ, পর্ব-৫: ঈশ্বরের আনন্দ ও সংসার—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ

ঠাকুর নিজে পূজারীর আসনে বসলেন। তাঁর ডানদিকে আলপনা করা দেবীর আসন পাতা। উত্তরমুখী হয়ে সেই আসনেই ঠাকুর শ্রীমাকে বসার জন্য ইঙ্গিত করলেন। ঠাকুর আগে পুজোর সব উপকরণ মন্ত্রোচ্চারণ করে শোধন করলেন। এবার দেবীর পুজো শুরু হল। ঠাকুর নিজ আসনে পূর্বমুখি হয়ে বসেছেন আর সারদা মা তাঁর পশ্চিমমুখী। ঠাকুর তাঁর সামনে রাখা মঙ্গলকলস থেকে জল নিয়ে বারেবারে সারদা মাকে অভিষিক্ত করতে লাগলেন। সম্মোহিত সারদা মায়ের বিহিত পূজার মন্ত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গেই অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৩: সুন্দরবনের গ্রামরক্ষক দেবতা আটেশ্বর

যে উপদেশ গিয়েছি ভুলে…/২

মূলপুজো সেরে এ বার ঠাকুর প্রার্থনামন্ত্র বলতে লাগলেন, ‘হে বালে, হে সর্বশক্তির অধিশ্বরী, মাতঃ ত্রিপুরসুন্দরী, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর, ইঁহার অর্থাৎ সারদার শরীর, মনকে পবিত্র করিয়া ইঁহাতে আবির্ভূতা হইয়া সর্বকল্যাণ সাধন কর’। এরপর ঠাকুর সারদাদেবীর অঙ্গসকল মন্ত্রের ন্যাস করে তাঁকে দেবীজ্ঞানে ষোড়শোপচারে পুজো করলেন। ভোগ নিবেদন করে কিছু ভোগ নিয়ে মায়ের মুখে তুলে দিলেন। ক্রমে সারদার বাহ্যজ্ঞান সম্পূর্ণ লোপ পেল। তিনি সমাধিস্থ হলেন। ঠাকুরও অর্ধবাহ্যদশায় মন্ত্র বলতে বলতে পূর্ণ সমাধিস্থ হলেন।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৫: ‘আপনজন’ Chronicles

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৪: মুহূর্ত মিলায়ে যায় তবু ইচ্ছা করে, আপন স্বাক্ষর রবে যুগে যুগান্তরে

এ ভাবে দু’ জনেই যখন সমাধিস্থ তখন ঠাকুর সারদাদেবীর সঙ্গে আত্মভাবে পূর্ণরূপে অভিন্ন ও একীভূত হলেন। রাত্রির দুই প্রহর পর্যন্ত তাঁদের এইরূপ সমাধিস্থ অবস্থা ছিল। তার পর ধীরে ধীরে সমাধি কাটলে ঠাকুর দেবী সারদার কাছে আত্মনিবেদন করে নিজের জপমালা-সহ এত দিনের সকল সাধনার ফল শ্রীমায়ের চরণে সমর্পণ করলেন ও তাঁকে প্রণাম করলেন। বললেন, ‘সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমস্তুতে’। হে সকল মঙ্গলের মঙ্গলরূপা, সর্ব কর্মসাধনকারিণী, হে শরণ্যা, হে ত্রিনয়না, শিবা, গৌরি, হে নারায়ণি, তোমাকে প্রণাম করি। এই বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথিতে খুব সুন্দরভাবে বলা হয়েছে—
‘এ পূজা পূজার ইতি, আর দেব দেবী মূর্তি, কভু না পূজিলা পরমেশ।
যেন পূজা শ্রীশ্রীমার, পরম চরম সার, পরিণাম সকলের শেষ। ’

দেবীপূজা হল শেষ। সারদার সমাধি ভাঙল, তিনি মনে মনে ঠাকুরকে প্রণাম করে নহবতে চলে গেলেন। বিদ্যারূপিণী মানবী সারদার ঈশ্বরীয় উপাসনার মাধ্যমে যেন ঠাকুরের সাধনা সমাপ্ত হল। আর সম্পূর্ণভাবে দিব্যমানবত্ব লাভ করে সারদা মা হলেন দেবী সারদেশ্বরী।
আরও পড়ুন:

প্রথম আলো, পর্ব-৫: বিশ্বের প্রথম ঘড়ি কোনটি? আবিষ্কারক কে?

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৬: তোমার গানের এই ময়ুরমহলে

এই প্রসঙ্গে শরৎ মহারাজ লিখেছেন যে, ষোড়শীপুজোর কালে মা এতটাই আবিষ্ট যে কী হচ্ছে তার হুঁশ ছিল না। ঠাকুর তাঁর কাপড় ছাড়িয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দিলেন, যেমন বিগ্রহকে পরানো হয়। তাঁর পায়ে প্রণাম করে ঠাকুর মালার্পণ করলেন। শ্রীমা কিছুই জানতে পারলেন না। সারদা মা কখনও মাংস খেতেন না। কিন্তু এইদিন তিনি প্রসাদী মাংস পর্যন্ত খেয়েছিলেন। মায়ের এতো লজ্জা ছিল যে এই নিয়ে লক্ষ্মীদিদি পরে মাকে মজা করে বলতেন, ‘তোমার কাপড় খুলে ঠাকুর কাপড় পরিয়ে দিলেন, এতেও তোমার হুঁশ হল না’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content