নারীসুন্দরী, সরযুবালা ও তারাসুন্দারী।
গিরিশচন্দ্রের অসাধারণ আরেকটি নাটক ‘মায়াবসান’। সামাজিক নাটক। এটি স্টার থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয়েছিল ১৮৯৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর। প্রথম রাত্রিতে যাঁরা বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ (কালীকিঙ্কর বসু), সুরেন্দ্রনাথ মিত্র (মাধব), কাশিনাথ চট্টোপাধ্যায় (যাদব), সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (হলধর), তারা সুন্দরী (অন্নপূর্ণা), সরযুবালা দেবী (নিস্তারিণী), নরী সুন্দরী (রঙ্গিনী)।
‘কালাপাহাড়’ রচনা প্রায় এক বছর পরেই গিরিশচন্দ্র ‘মায়াবসান’ নাটকটি রচনা করেন। ‘কালাপাহাড়’ নাটক যেমন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভাবে, ‘মায়াবসান’ নাটকটি তেমনি স্বামী বিবেকানন্দের ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। যবনিকা পতনের পূর্বে ‘মায়াবসান’ নাটকের শেষ গানটি হল—
‘‘মেদিনী মিশিল রল সলিলে
তপন শুষিল বারি।
তপন নিভিল অনিল বহিল
বিপুল ব্যোমচারি”।
‘‘মেদিনী মিশিল রল সলিলে
তপন শুষিল বারি।
তপন নিভিল অনিল বহিল
বিপুল ব্যোমচারি”।
আরও পড়ুন:
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৪৩: স্টার থিয়েটারে ফিরে আসার পরে গিরিশচন্দ্রকে নাট্যাচার্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’
‘কালাপাহাড়’ নাটকে যেমন ভগবত প্রেম ভক্তি ও ভালোবাসার বিকাশ, ‘মায়াবসান’ নাটকে তেমনি জ্ঞান ও চৈতন্যোদযে অবিদ্যার নাশ। কালীকিঙ্কর বসু এই নাটকের নায়ক। তিনি কঠোর সত্যানুরাগী, জ্ঞানপিপাসু, পরদুঃখ কাতর, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে কেবল জড় বিজ্ঞানের আলোচনা করেছেন, যখন তার সুখের সংসার পরের অনিষ্ট সাধনে সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের চক্রে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তিনি তা টেরও পেলেন না। বিজ্ঞান আলোচনা এবং পরীক্ষা করে কালীকিঙ্কর যেসব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন তা তিনি লিখে রাখতেন। চাটুজ্জে তাঁর লেখা কাগজগুলি চুরি করবার জন্যই আসতেন। উদ্দেশ্য ছিল সেগুলো পুড়িয়ে ফেলে তাঁকে চরম আঘাত দেবেন। কালীকিঙ্কর প্রশ্ন করেছিলেন, “তাতে তোমার লাভ কি?” কিন্তু চাটুজ্জে লাভ ক্ষতি মানেন না। পরের যাতে দুঃখ পরের যাতে অনিষ্ট তাতেই তাঁর আনন্দ। তাই বলেছেন “আমি আমুদে লোক। আমোদ করেই বেড়াই। কার কী হল, কার কী হবে, অত ধার ধারিনে।” কালীকিঙ্কর ভাবতে লাগলেন, “পরের অনিষ্ট জীবনে ব্রত কিন্তু আশ্চর্য একেতো আমি একদিনও বিমর্ষ দেখি না।”
আরও পড়ুন:
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৬: তোমার গানের এই ময়ুরমহলে
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?
রঙ্গিনী এই নাটকের আরেকটি বিচিত্র সৃষ্টি। রঙ্গিনী দরিদ্র কন্যা। কালীকিঙ্করের সযত্ন শিক্ষিতা, গুরু বাক্যে অখণ্ড বিশ্বাস এবং সত্যনিষ্ঠা এ চরিত্রের বিশেষত্ব। ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগ করে মৃত্যু দ্বার থেকে ফিরে এসেছিলেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৪: হাজরা মোড়ে নাম না জানা কচুরিখানা
কালাপাহাড় এবং মায়াবসান ধর্ম জগতে দুটি উচ্চ তত্ত্বের অবতারণা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই যে, এই দুটি নাটক গিরিশচন্দ্রের পরিণত সৃষ্টি হলেও, এই দুটি নাটক কিন্তু রঙ্গালয়ে তেমন করে প্রচারিত হয়নি। দর্শক মনোরঞ্জনেও সাফল্য লাভ করতে পারেনি। সম্প্রতি আমাদের শিক্ষক দিবস পালন করা হয়ে গেল। এই কালীকিঙ্কর বসুর মতো সত্যিকারের শিক্ষক এখনকার দিনের দুর্লভ। সেই রকম শিক্ষকের উদ্দেশ্যেই কিন্তু গিরিশচন্দ্র এই নাটকটি লিখেছিলেন।—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।