শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ঘাগরবুড়ির চণ্ডীমন্দির অনেক অনেক দিনের পুরনো। ঘাগরবুড়ির এই চন্ডীমন্দির ঘিরে অনেক অলৌকিক উপাখ্যান এবং কিংবদন্তি। রানিগঞ্জ টপকে আরও খানিকটা এগোলেই জিটি রোড থেকে আসানসোল চিত্তরঞ্জন রোড চলে গিয়েছে সে-দিকেই আসানসোল জংশন। সেখান থেকে জিটি রোড ধরে খানিক এগোলেই ঘাগরবুড়ি চন্ডীমাতা মন্দির। তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নুনিয়া নদী। আসানসোল থেকে কুলটি ছাড়িয়ে বরাকর টপকালেই এখন অন্য রাজ্য। ঝাড়খণ্ড। আমাদের কিশোর যুবক বেলায় এমনটা ছিল না । প্রায় ৫০০ বছর আগে আজকের আসানসোলের এ চেহারা ছিল না। ধুধু মাঠ এবং আসান গাছের জঙ্গল। আসান গাছের জঙ্গল। এক ধরনের বড়সড় গাছ, যার ছাল থেকে সুমিষ্ট জল পাওয়া যেত। সল হচ্ছে রাঢ় বঙ্গের জমি। তবে এখন আর আসানসোলে আসান গাছ নেই।

সে-দিনের জনমানবহীন প্রান্তরের দূরে একেকটি ক্ষুদ্র গ্রাম। মাঝে নুনিয়া নদী। সেখানে যজমানের ঘরে পুজোআচ্চা করতে যেতেন এক গরীব ব্রাহ্মণ। প্রতিদিন তখনকার নুনিয়া নদী পেরিয়ে ওধারের গ্রামে গ্রামে যেতেন, আবার হাঁটাপথে নদী পেরিয়ে বাড়ি। এ ভাবেই বহুকষ্টে দিন চলত। এরকমই এক শীতের দিন। দিনটি ছিল ১লা মাঘ। যজমানের ঘরে পুজো কিছুই মেলেনি। নদী পেরিয়ে এসে ক্লান্ত ব্রাহ্মণ এক গাছতলায় বসে কাতর ভাবে ডাকতে লাগলেন মা চণ্ডীকে। মায়ের কৃপায় ব্রাহ্মণের কষ্ট দূর হল। তিনি শুরু করলেন ১লা মাঘের চন্ডীমাতার বন্দনা।
কিশোর জীবনের রোমাঞ্চে সে মেলা স্মৃতি হয়ে মিশে ছিল। আচমকা এত বছর পর রূপোর কালো হয়ে যাওয়া আংটির খোঁচায় ব্যথাটা সব প্রায় ভুলতে বসা ঘুমিয়ে থাকা মূহূর্তগুলোকে জাগিয়ে দিল।

শবনমের বিয়ে আসানসোলেই হয়েছে। তবে তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে এ সব নিয়ে কথা বলাটা শোভনীয় হবে না ভেবে বুনি শবনমকে ওদের বাড়িতে ডেকে পাঠালো।

বিয়ের পরে নতুন সংসার নতুন শহর আফিফা ফিরোজের সঙ্গে ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে তুলছিল। সংসারে স্বচ্ছলতা ছিল অল্প জায়গার মধ্যে সংসার গুছিয়ে ফেলেছিল আফিফা। বছর তিনেক বাদে তাদের প্রথম সন্তান এল। মেয়ে। নাম রাখা হল মাসুদা। মানে সৌভাগ্যবতী।

বেশ চলছিল বুর দুবাইয়ের আল ফাহিদি স্ট্রিটের কাছে ফিরোজের মিনি মার্ট। এই জায়গাটার নাম কসমো লেন। জায়গাটা জমজমাট দিল্লির মীনাবাজারের সঙ্গে অনেক মিল আছে। বিক্রিবাটা বেশ ভালো। আসানসোলে থাকলেও শবনমেরও কলকাতা ভালো করে ঘোরা। তাই আমরা ভালো চিনবো বলেই ও বলল আফিফা জানিয়েছিল জায়গাটা কলকাতার গড়িয়াহাটের চত্বর। কথাটা শুনে মনে হল আফিফা কবে কলকাতা এসেছিল আমি তো জানতেই পারিনি। বিয়ের আগে নাকি বিয়ের পরে। বুনির কাছে শুনলাম আফিফার বাড়ির লোকজন তার বিয়ের সমস্ত বাজারহাট কলকাতার গড়িয়াহাট থেকেই করেছিল। তার মানে আফিফা নিজে এসেছিল গড়িয়াহাটে তার বিয়ের বাজার করতে? আমাকে জানায়নি। কী আশ্চর্য সঙ্গে তো বাড়ির লোকজন ছিল নিশ্চয়ই। আর আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকেবুকে যাওয়ার পরেই তো…তখন আবার আমাকে ডেকে নিয়ে এসে জটিলতা বাড়ানোর তো কোনও মানে হয় না।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১৮: আংটিটা এখানে এল কী করে? পুড়েই বা গেল কী ভাবে?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

আফিফা চিরকাল চুপচাপ প্রকৃতির। ফিরোজ যতটুকু বলে ততটাই শোনে। অযথা কৌতুহল দেখানো তার স্বভাবে নেই। সারাদিন মেয়ে সামলানো রান্নাবান্না ঘরগোছানো ফিরোজ লোক পাঠালে তার হাতে স্টক থেকে কখনও কখনও মাল দিয়ে লিখে রাখা এতেই দিন থেকে রাত শেষ।

দুবাই ধনীদের শহর। সেখানে টিকে থাকতে গেলে প্রচুর অর্থ রোজগার প্রয়োজনীয়। আল ফাহিদি সুউকের কাছেই ফিরোজের মিনি মার্ট। একেবারে মেনরোডের ওপরে। উত্তর আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সুউক শব্দের অর্থ মার্কেট কমপ্লেক্স। সোজা কথায় আমাদের মল। একদিকে দুবাই নোভা হোটেল উল্টোদিকে আল রমাইজান, আল হাসিনার মতো বিশাল বিশাল দোকান। মীনা বাজারের দোকানের ভাড়া লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফিরোজের সামনে উভয় সংকট। মিনি মার্ট থেকে যা লাভ হচ্ছে তাতে এই জায়গায় দোকান টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব।

এই দোকান এখন হাতছাড়া হলে আশেপাশে দোকান পাওয়া মুশকিল। যেতে হবে মেনরোড থেকে অনেকটা ভেতরে। সেখানে গিয়ে দোকান দিলে সুনিশ্চিত ভাবে বিক্রি কমে যাবে। মিনি মার্ট বন্ধ করে সেখানে ডিজাইনার জুয়েলারির দোকান দেবে। মিনি মার্টে জিনিসপত্র কিনতে আসতো আশপাশের বাসিন্দারা। কিন্তু মীনাবাজারের মূল ভিড়টা হল দুবাই দেখতে আসা টুরিস্টদের। তাদের আকর্ষণ করার জন্যই মীনা বাজার ঝলমল করে ডিজাইনার জুয়েলারি নানা ধরনের জুতো নানান পোশাকের সম্ভারে।

আফিফার মতামত দেওয়ার কিছু ছিল না। সে শুনলো। জানলো। মিনিমার্টের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের স্টক খালি হতে লাগলো আর সেখানে জায়গা নিল ইমিটেশন এবং ডিজাইনার জুয়েলারির নতুন স্টক।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৪: হাজরা মোড়ে নাম না জানা কচুরিখানা

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৭: আশাকে নিয়ে পঞ্চমের সব প্রশ্নের জবাব চিঠিতে জানিয়েছিলেন লতা

এই নতুন ব্যবসার পর ফিরোজ যেন অচেনা হয়ে গেল। রোজগার অনেক বেড়ে গেল। ব্যস্ততা বাড়ল। কিন্তু ফিরোজ যেন অনেক বেশি সাবধানী। কখনও রাতে বেরিয়ে যায়। ফেরে মাঝরাত গড়িয়ে ভোরবেলা। ফোনে কথা বলে গোপনে যেন চুপিচুপি। আফিফার মনে একটা অজানা আশংকা দানা পাকাতে লাগল। ফিরোজ কোন বিপদে জড়িয়ে পড়ছে না তো?

ভয় একদিন সত্যি হল আচমকা একদিন ফিরোজ এসে জানালো, জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে ওরা ইন্ডিয়ায় ফিরে যাবে। হঠাৎ কি হলো আফিফা বুঝতেই পারল না। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে খানিক পরে জানতে চেয়েছিল কোন বিপদ আপদ কিনা। ফিরোজ যেন একটু থতমতো খেয়ে গিয়েছিল পরে জানাল—

—বাজার আগুন হয়ে গেছে।আমার মত ছোটখাটো ব্যবসায়ী দুবাইতে না খেতে পেয়ে মারা যাবে। তার থেকে সময় থাকতে নিজের দেশে ফিরে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।

আসানসোল নয় ফিরোজ ফিরলো বোম্বেতে। মেন বোম্বে থেকে অনেকটা দূরে নেরুলে নিরিবিলিতেএকটা দুকামরা উঠোন রান্নাঘর সমেত ছোট্ট একতলাবাড়ি ভাড়া নিল। কেন তারা দুবাই থেকে দুম করে চলে এসেছিল সেটা আফিফা জানতে পেরেছিল অনেক পরে। দুবাইতে সেই শেখের প্ররোচনায় অনেক রোজগারের আশায় ফিরোজ ব্লু ফিল্মের সিডি বানানোর চক্করে জড়িয়ে পড়েছিল। দুবাই পুলিশ এসব ব্যাপারে ভীষণ কড়া। এক দুটো রেড হতেই ফিরোজ আর কোনও ঝুঁকি নেয়নি। দুবাইতে পাঁচ বছরের রেসিডেন্সি ভিসা ছিল ফিরোজের। আরও পাঁচ বছরের জন্যে রিনিউয়ালের সময় হয়ে গিয়েছিল। আসিফার ডিপেন্ডেন্ট ভিসা ছিল। আর মাসুদা তো জন্মেছে ওখানে। দুবাই থেকে বের হতে বা ভারতে ফিরে আসতে কোনও সমস্যা হয়নি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১২: সুন্দরবনের আর এক ব্যাঘ্রদেবতা বড় খাঁ গাজী

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…

এরপরে ঠিক কি ঘটেছিল।আফিফা এবং মাসুদার মৃত্যু কি করে ঘটলো সেটা শবনম জানে না।

শবনমের বাড়ি থেকে ফিরে সেদিন বুনিদের বাড়িতেই ছিলাম। রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। আসানসোলে ওদের বড় তিন তলা বাড়ি। তিন তলার ঘরে একাই শুয়ে ছিলাম। মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গেল। মানে আমার ঘুমটা সত্যি ভেঙে ছিল নাকি আমি ঘুমের মধ্যে মনে করেছিলাম ঘুম ভেঙেছে। সেটা এখন মনে পড়ছে না।
আমি স্পষ্ট দেখলাম আফিফাকে। রাতপোশাক পরা। আমার দিকে ফিরে আছে কিন্তু মুখের পুরোটাই চুল দিয়ে ঢাকা। দুর্গাপুর থেকে রাতে কলকাতা ফেরার সময় রেল লাইনের ধারে যেমন সেই কিশোরীকে দেখেছিলাম ঠিক তেমনি। আফিফা মাথা ঘুরিয়ে যেন আমাকে ডাকলো আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত আফিফাকে অনুসরণ করলাম। তেতলার ঘরের দুটো দরজা একটা দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নামা যায় অন্য দরজাটা খুলে সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নামলেই ধুধু খোলা ছাদ। আমি ওই বন্ধ দরজাটা খুলিনি। আমার স্পষ্ট মনে আছে।

কিন্তু দরজাটা খুলে গেল আফিফা খোলা দরজা দিয়ে অন্ধকার ছাদে নেমে গেল। আমি আফিফাকে দেখতে পাচ্ছি না মানে, মুখটা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু তার অবয়ব এখনো আমার চেনা। কয়েকপর যাবার পর আফিফা হাত উঁচু করে দূরে দেখালো সেখানে একটা বছর চারেকের বাচ্চা মেয়েকে যেন সাদা চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে আর বাচ্ছাটা দম আটকে ছটফট করছে চিৎকার করছে।—চলবে।
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content