রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

একদিন ঠাকুর তাঁর ঘরের উত্তরদিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন দেখে ভাগ্নে হৃদয় কৌতুক করে নহবতের কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে সারদাকে বললেন, ‘মামী, তুমি মামাকে বাবা বলে ডাক না’? সারদা কোন সংকোচ না করেই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বাবা কি বলচ হৃদু, পিতা, মাতা, বন্ধুবান্ধব সবই উনি’। সারদা মা এই প্রসঙ্গে বলেছেন যে, একদিন সারদা ঘর ঝাঁট দিচ্ছিলেন আর ঠাকুর তাঁর ঘরের ছোট খাটে বসেছিলেন।

সারদা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আমি তোমার কে’? ঠাকুর বলেছিলেন, ‘তুমি আমার আনন্দময়ী মা’। লীলা প্রসঙ্গে আছে, এইসময় একদিন ঠাকুরের পদসেবা করতে করতে সারদা জানতে চান, তাঁকে ঠাকুরের কি বলে মনে হয়। উত্তরে ঠাকুর নির্দ্বিধায় বলেন, ‘যে মা মন্দিরে আছেন, তিনিই এই শরীরের জন্ম দিয়েছেন এবং এখন নহবতে আছেন। তিনিই এসময় তাঁর পদসেবা করছেন।
ব্রহ্মজ্ঞানী ঠাকুরের দৃষ্টিতে সবকিছুই ব্রহ্ম। তিনি সারদার ঐশ্বরিক স্বরূপ সহজেই উপলব্ধি করেছেন। আত্মস্বরূপের আড়ালে সেবানিরতা সহধর্মিণীর প্রকৃত সত্তা ও শক্তি ব্রহ্মনিষ্ঠ ঠাকুরের কাছে অজানা ছিল না। কোন একসময় তিনি গোলাপমাকে নিজেই বলেছেন, ‘ও সারদা, সরস্বতী জ্ঞান দিতে এসেচে’। এমনকি, ভাগ্নে হৃদয়কেও সাবধান করেছিলেন সারদার সঙ্গে দুর্বিনীত আচরণ ও কটুবাক্য না বলার জন্য।

তাঁর চোখে সারদা ও ভবতারিণী মা একাকার হয়ে আছেন। তাই তো মাতৃসাধক ঠাকুরের দৃষ্টিতে কালী কখনও সাকার, কখনও বা নিরাকার, অসীম, অনন্ত। কখনও তিনি চৈতন্যদায়িনী, কখনও গর্ভধারিণী জননী। আবার তিনিই নহবতে সহধর্মচারিণী। সবে মিলে একাধার।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯: ঠাকুরের ঘরণী সারদার গার্হস্থ্য জীবন

যত মত, তত পথ, পর্ব-৪: শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান

আদ্যাশক্তি মহামায়া হলেন স্বয়ং শক্তি, ব্রহ্মময়ীস্বরূপা। ব্রহ্মশব্দ ক্লীবলিঙ্গ ব্রহ্মণ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে। যখন ব্রহ্ম ও শক্তি নিরাকার থাকে অর্ধনারীশ্বরভাবে, তখন কোন সৃষ্টি হয় না। অখণ্ড কালে নিহিত থাকে নিরাকার চৈতন্য বা জ্ঞানরূপ পরব্রহ্ম। জ্ঞানশব্দও ক্লিবলিঙ্গ। কিন্তু যে ব্রহ্মজ্ঞানকে মননের মাধ্যমে ঋষিরা মন্ত্রশক্তি পেয়েছিলেন তা হল সংস্কৃতে পুংলিঙ্গ শব্দ।

ঠাকুর বলেছেন, নিরাকার ব্রহ্ম হলেন সাকার পরমপুরুষের বাঙ্ময়স্বরূপ মন্ত্র আর তার শক্তি হল পরমাপ্রকৃতির সাকার স্বরূপ নিরাকার মহামায়ার মহাবিদ্যা। মহাবিদ্যা হল মহাজ্ঞান। দশজ্ঞানস্বরূপা বিগ্রহের ধ্যান করলে, তার তত্ত্ব জানলে মানুষের ইহজীবনের চতুর্বর্গ লাভ হয়। প্রকৃতপক্ষে দশমহাবিদ্যার স্বরূপ প্রথম জেনেছিলেন স্বয়ং মহাদেব।
আরও পড়ুন:

যে উপদেশ গিয়েছি ভুলে…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

সত্যযুগে ব্রহ্মার মানসপুত্র প্রজাপতি দক্ষ ছিলেন দাম্ভিক ও ঘোর শিব-বিরোধী। তিনি মহামায়াকে তপস্যায় তুষ্ট করে তাঁকে কন্যারূপে পান। তার নাম দেন সতী। সতী পিতার অমতে পতিরূপে শিবকেই বরণ করেন। ক্রুদ্ধ পিতা দক্ষ অপমানিত বোধ করে শিবহীন এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন। সেখানে সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেও শিব ও সতীকে আমন্ত্রণ জানালেন না। উদ্দেশ্য ছিল শিবকে অপমানিত করা।

এ দিকে দেবর্ষি নারদের কাছে সব শুনে সতী পিতার যজ্ঞে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তবুও অন্তর্যামী শিব বিনা নিমন্ত্রণে সতীকে সেখানে যেতে দিতে চাইলেন না। সতী প্রথমে শিবের কাছে অনেক অনুনয় করলেন। মহাদেব কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না দেখে মহামায়ারূপী সতী তাঁকে নিজের দশমহাবিদ্যার স্বরূপ দেখিয়েছিলেন। তাঁরা হলেন কালী, উগ্রতারা, ছিন্নমস্তা, ভুবনেশ্বরী, বগলা, ধূমাবতী, ত্রিপুরাসুন্দরী কমলা, মাতঙ্গী, ষোড়শী ও ভৈরবী।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৫: অনন্যসাধারণ হরিপুরের হরিহর শিবমন্দির

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১২: সুন্দরবনের আর এক ব্যাঘ্রদেবতা বড় খাঁ গাজী

দশমহাবিদ্যার তৃতীয় রূপ হলেন অপূর্ব সুন্দরী ষোড়শী। ইনি সর্বজ্ঞানদায়িনী সরস্বতীরূপা, যাঁকে শ্রীবিদ্যা ও রাজরাজেশ্বরীও বলা হয়। তিনি ত্রিনয়না, রক্তবর্ণা ও চতুর্ভুজা। তিনি লোহিতবস্ত্র ধারণ করে আছেন ও মহাদেবের নাভিপদ্মে উপবিষ্টা। তাঁর আসন ধারণ করে রয়েছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, রুদ্র ও মহেশ। তাঁর মুখে মধুর হাসি। ইনি সংসারে সর্বসৌভাগ্যদাত্রী, লক্ষ্মীস্বরূপা। ষোড়শীর চার হাতে যথাক্রমে পাশ, অঙ্কুশ, শর ও ধনু বিদ্যমান।

একবৎসরের বেশি সময় ধরে সারদার সঙ্গে বাস করে তাঁর সব আচরণ লক্ষ্য করে ঠাকুরের উপলব্ধি হয় যে সারদা জগদম্বার অংশ। তখন তিনি সারদাকে শ্রীবিদ্যা ষোড়শীরূপেই প্রতিষ্ঠা করার সঙ্কল্প গ্রহণ করেন। সারদার ঈশ্বরীয় সত্তাকে ঠাকুর যে স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন, তাও এক অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content