শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


বিদূষী দীপালি নাগ। ছবি: সংগৃহীত।

যতদূর মনে পড়ছে বেহালা চৌরাস্তা পেরিয়েই বাঁ হাতে এক মিষ্টির দোকান। বীরেন রায় রোড ইস্ট ধরে কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে ঘুরে গলির শেষ বাড়ি। সবুজ দরজা-জানালাওয়ালা বড় বাগান দিয়ে ঘেরা। গেটে ঢোকার সময় থেকেই কানে আসছে রেওয়াজি, সুরেলা কণ্ঠে গলা মিলিয়ে কোরাসে অপূর্ব সরগম। সঙ্গে হারমোনিয়ামে মন মজানো সুর আর তানপুরার অনুরণন।

প্রায় ৪২ বছর আগেকার কথা বলছি। আমি তখন ফ্রক পরা স্কুলের মেয়ে। প্রতি রোববার সকালে বাবার হাত ধরে এই বাড়িটাই হতো আমার বেশ খানিক সময়ের ঠিকানা। কিন্তু আমি এ ঠিকানায় পৌঁছলাম কীভাবে?
সেই সময়ে বড়িশা সাংস্কৃতিক পরিষদ বেহালায় সারা বাংলা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সেখানে আমি খেয়াল (বিলম্বিত-মধ্য-দ্রুত লয়) এবং রাগপ্রধান বিভাগে প্রতিযোগী হিসেবে অংশ নিয়েছিলাম। খেয়াল বিভাগে সম্ভবত রাগ ইমন গেয়েছিলাম। প্রথম বা দ্বিতীয় হতে পারিনি। তৃতীয় স্থান লাভ করেছিলাম বলে নিজের ব্যর্থতার জন্য মনে বড় দুঃখ হয়েছিল। তবে রাগপ্রধান গানে রাগ বৃন্দাবনী সারং গেয়ে প্রথম হয়েছিলাম। ফলাফল জানতে পেরেছিলাম ফেরার পথে মিনিবাসে। সে গল্প পরে বলবো। যাই হোক থার্ড হবার দুঃখ পুরো না হলেও কিছুটা লাঘব হল রাগপ্রধানের প্রথম পুরস্কারে। পুরস্কার বিতরণীর দিনটা বেশ মনে আছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং…, ২য় খণ্ড, পর্ব-৩৩: মানুষটার লোভ বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিছুই নেই

২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের সন্ধ্যায় পুরস্কার বিতরণী মঞ্চ আলোয় ঝলমল করছে। সেখানে কে সভাপতি বা কে প্রধান অতিথি মঞ্চে কী বলা হচ্ছে, তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। ওই বয়সে সেটাই খুব স্বাভাবিক। পরে মায়ের কাছ থেকে জানলাম মঞ্চের প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রীমতি দীপালি নাগ। সেই মঞ্চে ঘোষিত হল যে তিনি রাগপ্রধান গানের প্রথম পুরস্কার প্রাপককে বিনা পারিশ্রমিকে তালিম দিতে ইচ্ছুক। তারপর থেকেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ এই নামটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলাম।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৭: আশাকে নিয়ে পঞ্চমের সব প্রশ্নের জবাব চিঠিতে জানিয়েছিলেন লতা

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৫: সফল হোগি তেরি আরাধনা

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষহল। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বাবা-মার কথা হল। তারাই জানালেন রাগপ্রধান সংগীতের সেই পুরোধা-নারীর বাড়ির ঠিকানা। ফেব্রুয়ারি মাসের এক বিকেলে একটা সময় দিলেন। বাবা-মাকে বললেন আমাকে নিয়ে ওঁর বাড়িতে আসতে।

এলাম অনেক গাছপালা দিয়ে ঘেরা সবুজ জানলা-দরজাওলা হলুদরঙা সেই বাড়িটাতে। ড্রয়িং রুমে বসলাম। চারপাশটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। সুন্দর সাজানো ছোট্ট ড্রয়িং রুম। সেখানে কোথাও যেন একটা পাশ্চাত্য আর দেশজের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। খুব ভালো লাগলো দেখে।
খানিক বাদেই উনি এসে বসলেন আমাদের সঙ্গে। বললেন—
—খুব ভালো দিনে এলে। আজ আমার জন্মদিন। প্রায় জনা চল্লিশেক ছাত্রী আজ এসেছিল। এই তো একটু আগেই তারা সব বেরিয়ে গেল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

যত মত, তত পথ, পর্ব-৪: শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান

ঠিক সেই দিনই নয়, তবে আজ বুঝতে পারি একজন ব্যস্ত সৃষ্টিশীল মানুষ ঠিক কীভাবে তাঁর সময়কে ব্যবহার করেন। আমার প্রথমদিন তাই তাঁর জন্মদিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিনের সময়কেও নিখুঁতভাবে সাজানো। যাতে তাঁর নিজের বা যারা আসবেন তাদের কারও সময় অকারণে নষ্ট না হয়। অপরের সময়কে সম্মান করার এই শিক্ষণীয় ভদ্রতার আজ বড়ই অভাব। কথার মাঝেই আমাদের জন্য এক সুদৃশ্য চিনামাটির বাওলে মিষ্টি এল। তাঁর রংও বোধহয় সবুজ ছিল। সঙ্গে সুন্দর কাচের গ্লাসে জল। বললেন— ‘আগে মিষ্টিমুখ করো।’

বীরেন রায় রোডের সেই বাড়ি। ছবি: সংগৃহীত।

এরপর আমাদের নিয়ে এলেন দোতলার হল ঘর—মানে গানঘরে। গানঘরের পুরোটাই মোড়ানো সুন্দর কার্পেট দিয়ে। একদিকে রাখা আছে হারমোনিয়াম। যেখানে আমরা সকলে এসে বসলাম। এই অংশের একদিকে ছোট্ট এক্সটেনশন। সেখানে পরপর রাখা কয়েকটা তানপুরা আর তবলা। আর এই ঘরেরই লাগোয়া রয়েছে আরও একটি ছোট্ট ঘর। খুব মনে পড়ে সেখানে রাখা মফ রঙের দামি বেডকভার বিছানো ছোট্ট এক ডিভান। ছোট কাঠের জলচৌকিতে সাজিয়ে রাখা পিতলের আয়না। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম দেওয়ালে সাজানো একটা সতেজ সবুজ দীর্ঘাকার নারকেলপাতা। পোশাকেও সবুজের ছায়া। এই সবুজ রঙের একটা প্রভাব বোধহয় ওঁর মধ্যে ছিল। সত্যি এমন যেন কারও বাড়িতে দেখিনি। সে বাড়ির-ঘরগুলোয় রন্ধ্রেরন্ধ্রে সূক্ষ্ম অভিজাত শিল্পমনস্কতার ছাপ স্পষ্ট।—চলবে।
* লেখিকা চন্দ্রাণী সরকারের ভালোবাসা গান, সংসার, বেড়ানো, ভ্রমণকথা লেখা।

Skip to content