রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


সুন্দরবনে ঊণবিংশ শতকে আঁকা গাজী পীরের চিত্র। ছবি: সংগৃহীত।

সুন্দরবন তথা নিম্নবঙ্গের লৌকিক দেবদেবীরা হলেন এমন দেবদেবী যাঁরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার পুজো পান। মাঠে-ঘাটে, জঙ্গলে, গাছের তলায় যেমন দক্ষিণ রায়, মাকাল ঠাকুর, বাসলী প্রমুখ দেবদেবীর থান দেখা যায় তেমনই বনবিবি, ওলাবিবি, গাজীসাহেব প্রমুখের থান বা দরগাও দেখা যায়। মউলে ও বাউলেরা মধু ও কাঠের জন্য যখন অরণ্যের গভীরে যাত্রা শুরু করে তখন চাহিদামতো কাঠ, মধু ও মোম লাভের জন্য এবং নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য তারা বনবিবি আর দক্ষিণ রায় ছাড়া আর যাঁর আরাধনা সবচেয়ে বেশি করে তিনি হলেন বড় খাঁ গাজী।

‘গাজী’ কারও নাম নয়, এ হল উপাধি। ইসলামি অর্থে ‘গাজী’ হলেন তিনি যিনি ধর্মযুদ্ধে বিজয়ী। তিনি মৈত্রী ও অহিংসার মাধ্যমে ভিনধর্মের মানুষেরও হৃদয় জয় করার ক্ষমতা রাখেন। আর তাই বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের নিম্নবঙ্গ অঞ্চলে গাজীসাহেবের প্রতি মানুষের জনভক্তি অটুট আছে। এইসব অঞ্চলে বহু জায়গায় রয়েছে গাজীসাহেবের থান যেখানে ফকিররা হলেন মূল কর্তা। গাজীসাহেবের আরাধনার শেষে তাই অনেকে সুর করে বলেন—
গাজী মিঞার হাজোত
সিন্নি পূর্ণ হল।
হিন্দুগণে বল হরি,
মোমিনে আল্লা বল।

আবার সুন্দরবনের নদীপথ ধরে সমুদ্রে যাত্রা শুরু করার সময় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মাঝি-মাল্লারা গাজীসাহেবকে স্মরণ করে বলেন—
আমরা আজি পোলাপান।
গাজী আছে নিখাবান,
শিরে গঙ্গা দরিয়া,
পাঁচ পীর বদর বদর।
এখানে উল্লেখ্য যে সমস্ত পীরের মধ্যে বড় খাঁ গাজী হলেন অন্যতম পীর। ‘পীর’ হল ফরাসি শব্দ যার অর্থ আধ্যাত্মিক গুরু। অষ্টম শতাব্দীতে আরবদেশীয় সুফী বা পীর-দরবেশরা এদেশে এসে সাধারণ গরিব ও অবহেলিত মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলতে সমর্থ হন। তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন রামানন্দ, নানক, কবীর, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ।

তবে নিম্নবঙ্গে পীরদের আগমন দশম-একাদশ শতাব্দী থেকে। সপ্তম শতকে বঙ্গে রাজা শশাঙ্কের রাজত্বের সময় থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সঙ্কট শুরু হয়। তখন থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অনেকটা বাধ্য হয়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আশ্রয় নিতে থাকে। কিন্তু দ্বাদশ শতকে সেন রাজাদের আমলে বর্ণবিভাজন প্রথা বঙ্গের হিন্দুসমাজকে ভেদাভেদে জর্জরিত করে তুলেছিল। সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয়ে পড়ে অবর্ণ হিন্দুরা। স্বভাবতই তারা এইসময় পীর-দরবেশদের দিকে আকৃষ্ট হতে থাকে।

নিম্নবঙ্গে সবার আগে যে পীর এসেছিলেন তিনি হলেন ভাঙ্গড় পীর। তাঁর নামে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার একটি স্থানের নাম ভাঙ্গড়। পরবর্তী সময়ে আগত পীরেরা তাঁর পরামর্শ নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মপ্রচারে যেতেন। হিন্দুরা পীরদের তখন থেকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করত।
“সিদ্ধিগুণে সিদ্ধপুরুষ হৈল সিদ্ধিদাতা।
মুসলমান বলে পীর হিন্দুর দেবতা।”
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১১: সুন্দরবনের ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৮: রাজবাড়িই রাজনগরের নারীর উন্মুক্ত আকাশ

সুন্দরবন অঞ্চলে এমনই কয়েকজন বিখ্যাত পীর হলেন পীর মোবারক গাজী, শতর্ষা গাজী, রক্তা খাঁ গাজী, বামন খাঁ গাজী, বড় খাঁ গাজী প্রমুখ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘুটিয়ারি-শরিফে মোবারক গাজীর মাজার খুবই বিখ্যাত। দক্ষিণ বারাসতে রয়েছে শতর্ষা গাজীর মাজার। দক্ষিণ বারাসত স্টেশনের কাছে রায়নগর গ্রামে একসময় এসেছিলেন রক্তা খাঁ গাজী। এখানে বার্ষিক জাঁতাল উৎসব হয়।

মন্দিরবাজার থানার তাজপুর গ্রামে মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে বামন গাজীর মূর্তি রয়েছে যেখানে পুজা-হাজোত হয়ে থাকে। মথুরাপুরে দুটি জায়গায় বড় খাঁ গাজীর আস্তানার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। জয়নগর ২ নং ব্লকের চন্ডীপুর গ্রামে রয়েছে বড় খাঁ গাজীর জীর্ণ সমাধি। যদিও এই অঞ্চলে লোকমুখে বরখান গাজী নাম বেশি প্রচলিত। অনেকে তাঁকে ‘জিন্দাপীর’ বলেও সম্বোধন করে। বড় খাঁ গাজীর খ্যাতি একসময় বঙ্গদেশের নানা অঞ্চলে প্রসারিত ছিল।

পরবর্তীকালে দক্ষিণ রায়ের মতো বড় খাঁ গাজীও সাধারণ সুন্দরবনবাসীর কাছে ব্যাঘ্রদেবতা বলে পূজিত হন। তবে একজন ধর্মপ্রচারক পীর কীভাবে দেবত্বে উন্নীত হলেন তা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত এই গাজী পীরের মহত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট সাধারণ মানুষ গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তিবোধ থেকে তাঁকে দেবতুল্য মর্যাদা দেয়। পরে কালক্রমে আদি কোনও ব্যাঘ্রদেবতার সাথে বড় গাজী খাঁর মিশ্রণ ঘটে। অবশ্য “বাংলার লৌকিক দেবতা” গ্রন্থে গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু জানিয়েছেন যে বড় খাঁ গাজী কারও ব্যক্তিগত নাম নয়—ইসলাম ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে যিনি শীর্ষস্থানীয় তাঁকে ওই নামে অভিহিত করা হত।

বড় খাঁ গাজী। ছবি: সংগৃহীত।

পূর্ববঙ্গে প্রচলিত মুসলমানি পুঁথি “গাজীকালু চম্পাবতী” থেকে আমরা জানতে পারি, বিরাটনগরের বাদশাহ সেকেন্দার শাহ ও রানি অজুপাসুন্দরীর দ্বিতীয় পুত্র হলেন গাজী। তাঁর ভাই কালু হলেন বাদশাহের পালিত পুত্র। গাজী যৌবনে পৌঁছোলে বাদশাহ তাঁকে রাজ্যের ভার নিতে বলেন। কিন্তু গাজী তাতে রাজি হলেন না। বললেন, “আমি বাদশাহী চাই না, ফকির হতে চাই।” এই শুনে বাদশাহ ক্ষুব্ধ হলেন কারণ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র জুলহাস সুন্দরবনে শিকারে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। কিন্তু বাদশাহের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও গাজী যখন রাজি হলেন না তখন বাদশাহ নিজের পুত্রকে শিরশ্ছেদ করার আদেশ দেন।

কিন্তু গাজীর এমনই ঐশ্বরিক ক্ষমতা যে জল্লাদ তরবারি দিয়ে তাঁর মাথা তো দূর, একটা লোমও কাটতে পারল না। তারপর গাজীকে সমুদ্রে, অগ্নিকুন্ডে, এমনকি হাতির পায়ের নিচে নিক্ষেপ করা হল। কিন্তু কিছুতেই গাজীকে হত্যা করা গেল না। তখন তাঁকে গভীর সমুদ্রে ফেলে দেওয়া একটা চিহ্নিত সূচ তুলে আনতে বলা হল। গাজী সমুদ্রকে শুকিয়ে দিয়ে সেই সূচ খুঁজে আনলেন। যখন কোনওভাবেই গাজীকে রোখা গেল না তখন বাদশাহ হাল ছেড়ে দিলেন। আর অতুল ঐশ্বর্য ত্যাগ করে ভাই কালুকে সাথে নিয়ে গাজী চলে এলেন সুন্দরবনে। সুন্দরবনে আসার পর তাঁর অলৌকিক ক্ষমতায় সেখানে সমস্ত বাঘ ও কুমির তাঁর বশীভূত হল।
গাজী ভাই কালুকে নিয়ে নানা রাজ্য ঘুরে শেষে পৌঁছোলেন ব্রাহ্মণনগরে রাজা মুকুট রায়ের রাজ্যে। রাজা মুকুট রায়ের সাত পুত্র ও এক কন্যা চম্পাবতী। গাজী একদিন স্বপ্নে দেখলেন চম্পাবতী অসামান্যা সুন্দরী। সংসারত্যাগী ফকির গাজীর চম্পাবতীকে বিয়ে করার ইচ্ছে হল। তিনি ভাই কালুকে দিয়ে রাজার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। কিন্তু রাজা মুকুট রায় ছিলেন ঘোর মুসলিম-বিদ্বেষী। তাই কালুকে বন্দী করলেন।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন: বিদেশ ভ্রমণে বিভ্রাট

কলকাতার পথ-হেঁশেল: অফিসপাড়ার ক্যান্টিন ডেকার্স লেনে কোলাহল

এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন গাজী সাহেব। তিনি তাঁর বিশাল ব্যাঘ্রবাহিনী নিয়ে মুকুট রায়ের প্রাসাদ আক্রমণ করলেন। তখন মুকুট রায়ের সেনাপতি প্রবল পরাক্রমশালী দক্ষিণ রায় তাঁর কুমির সেনাবাহিনী নিয়ে গাজীর সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। তারপর প্রবল যুদ্ধের পর দক্ষিণ রায় পরাজিত হলেন এবং গাজীর হাতে বন্দী হলেন। গাজী শাস্তিস্বরূপ দক্ষিণ রায়ের কান ও বারো হাত লম্বা টিকি কেটে দিলেন।

এই খবর পেয়ে ‘বারো কোটি নয় শত সেনা’ ও ‘লক্ষ লক্ষ তোপতীর’ নিয়ে স্বয়ং মুকুট রায় যুদ্ধ করতে এলেন। কোনওভাবেই যখন মুকুট রায়কে পরাস্ত করা যাচ্ছে না তখন গাজী তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন। মুকুট রায়ের পরাজয় হল। রাজা-সহ রাজবাড়ির সমস্ত ব্রাহ্মণ মুসলিম ধর্মান্তরিত হয়ে প্রাণ বাঁচাল। আর মুকুট রায় গাজীর সঙ্গে তাঁর কন্যা চম্পাবতীর বিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। আমরা ‘সাত ভাই চম্পা’ বলে কবিতা ও গানে যে উল্লেখ পাই তাঁরা হলেন মুকুট রায়েরই সাত পুত্র ও কন্যা চম্পাবতী। যাইহোক, বিয়ের পর গাজী কালু ও চম্পাবতীসহ বিরাটনগরের দিকে রওনা দিলেন। যাওয়ার পথে গাজী তাঁর নিখোঁজ বড়ো ভাই জুলহাসকে পাতাল থেকে, অর্থাৎ সুন্দরবন থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন।

ঘুটিয়ারি শরিফ দরগা। ছবি: সংগৃহীত।

গাজীকালুর বিভিন্ন পুঁথিতে কাহিনির কিছু ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন দক্ষিণ রায়ের সাথে প্রথম যুদ্ধে গাজী পরাস্ত হন। তখন তিনি গৌড়েশ্বর সুলতান হুসেন শাহর কাছে গিয়ে অতিরঞ্জিত করে দক্ষিণ রায়ের কাছে পরাজয়, মুকুট রায় ও দক্ষিণ রায়ের তীব্র ইসলাম-বিদ্বেষ, ভ্রাতা কালুর কারাবাস, সুলতানের নীতি না মেনে মুকুট রায়ের মতো হিন্দু রাজাদের অবাধ্যতা ইত্যাদি এমন ভাবে বললেন যেন সুন্দরবন অঞ্চলে এক ধর্মসঙ্কট উপস্থিত। তখন সুলতান তাঁর বিরাট সেনাবাহিনী পাঠালেন গাজীকে সাহায্য করার জন্য। গাজী কিছু বাঘকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাবলে ভেড়া বানিয়ে মুকুট রায়ের প্রাসাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। আর বাইরে থেকে সুলতানের বাহিনী প্রাসাদ আক্রমণ করে। ভেতর ও বাইরে উভয় দিক থেকে আক্রমণে মুকুট রায় ও দক্ষিণ রায় উভয়েই পরাস্ত হন।

‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রণেতা সতীশচন্দ্র মিত্র মহাশয়ের মতে, গাজীসাহেবের ব্যাঘ্র সেনা সম্ভবত সুন্দরবন অঞ্চলের আদিবাসী মল্ল। এরা ছিল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। যাইহোক, এই কাহিনি অনুযায়ী গাজীসাহেব চম্পাবতীকে বিয়ে করেননি। চম্পাবতী তাঁর খপ্পর থেকে পালিয়ে সাতক্ষীরার গণরাজার কাছে আশ্রয় নেন এবং বাকি জীবন ধর্মসাধনা ও মানবসেবা করে অতিবাহিত করেন। এজন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ তাঁকে ভক্তি করত ও ‘মা’ বলে ডাকত। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভক্তরা সাতক্ষীরার কাছে লাপসা গ্রামে তাঁর নামে ‘মাইবিবিচম্পার দরগা’ তৈরি করেন।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪০: একসঙ্গে বহু ছবিতে অভিনয় করা সত্ত্বেও প্রদীপ কুমার সে দিন চিনতেই পারলেন না উত্তম কুমারকে!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯: ঠাকুরের ঘরণী সারদার গার্হস্থ্য জীবন

অবশ্য সপ্তদশ শতকে কবি কৃষ্ণরাম দাসের লেখা “রায়মঙ্গল” কাব্যে বড় খাঁ গাজীর কাহিনি কিছু ভিন্ন। সেখানে বলা হয়েছে পিতার সম্পত্তি ছেড়ে গাজী সুন্দরবন এলাকায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে এলে ওই অঞ্চলের রাজা মুসলিমবিদ্বেষী দক্ষিণ রায়ের সাথে সঙ্ঘর্ষ হয়। যুদ্ধে গাজীসাহেব তাঁর পয়গম্বরের দেওয়া খেরশান খাঁড়া দিয়ে দক্ষিণ রায়ের সেনা সাত হাজার বাঘ মেরে শেষে দক্ষিণ রায়ের গলায় কোপ বসিয়ে দেন। কিন্তু অলৌকিক শক্তির প্রভাবে দক্ষিণ রায়ের কাটা মুন্ড বার বার ধড়ের সাথে জুড়ে গেল। বাধ্য হয়ে এই সঙ্কটকালে জগদীশ্বর হিন্দু ও মুসলিমের যৌথ দেবতা আধা শ্রীকৃষ্ণ-আধা পয়গম্বর হিসেবে আবির্ভূত হয়ে যুদ্ধবিরতি ঘটালেন। গাজীসাহেবের সাথে দক্ষিণ রায়ের সন্ধি হল।

সন্ধির শর্তানুযায়ী দক্ষিণ রায় হলেন সমগ্র ভাটি অঞ্চল অর্থাৎ সুন্দরবনের অধিপতি। আর গাজীসাহেব সর্বত্র শ্রদ্ধা ও সম্মানলাভের অধিকারী হলেন। হয়তো এই কারণেই যেখানে দক্ষিণ রায়ের থান আছে তার কাছেই দেখা যায় গাজীসাহেবের আস্তানা আছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মন্দিরবাজার ব্লকে রয়েছে বিখ্যাত ‘বামনগাজী’ থান। অনেকেই বলেন যে ‘বামন’ কথাটা এসেছে ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দের কথ্যরূপ হিসেবে। অর্থাৎ এই থান হল হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের এক অভাবনীয় সম্মিলন। যদিও ব্রাহ্মণ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বংশধররা বামনগাজীর সেবক এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই এখানে পুজো দিতে আসেন কিন্তু মূর্তিতে কোথাও ব্রাহ্মণের চিহ্ন নেই।

ঘুটিয়ারি শরিফে পীর মোবারক গাজীর সমাধি। ছবি: সংগৃহীত।

বড় খাঁ গাজীসাহেবের মূর্তি বীরপুরুষের মতো। তাঁর মূর্তি কোথাও পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা, কোথাও লুঙ্গি পরা ও ঘাড়ে গামছা, মাথায় টুপি বা পাগড়ি, মুখে দাড়ি, কান পর্যন্ত বিস্তৃত লম্বা গোঁফ, রঙ ফরসা, এক হাতে অস্ত্র বা রাজদন্ড অন্য হাতে লাগাম। তাঁর পায়ে বুট জুতো, পা দুটো রেকাবির উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত বা বিরাট আকারের ঘোড়ার উপর আসীন। কোথাও বাঘের উপরে বসে থাকতেও দেখা যায়। বাঘকেই অনেকে বলে ‘গাজীর ঘোড়া’। তবে বড় খাঁ গাজীর পূর্ণ মূর্তি পূজিত হয় কম, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্তূপ আকৃতির প্রতীক পূজিত হয়। অধিকাংশ থানে মুসলমান ফকিররা পূজা-হাজোত করেন। পূজায় নৈবেদ্য দেওয়া হয় চিনির বাতাসা, পাটালি, দুধ, ক্ষীর বা আতপ চালের শিন্নি। মূর্তির পায়ের কাছে সাজি ভর্তি ফুলের তোড়া রাখা হয়। সুন্দরবনের মানুষ কেবল জঙ্গলে প্রবেশ করার আগেই নয়, নিজের পরিবারের সদস্যদের ও গৃহপালিত পশুপাখিদের কল্যাণ কামনা করে গাজীসাহেবকে স্মরণ করে।

পীর গাজীদের কার্যকলাপ যে সুন্দরবনের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কাছে কতটা জনপ্রিয় হয়েছিল তা আজও গাজীর থানের জনপ্রিয়তা দেখে বোঝা যায়। তাঁরা কেবল ধর্ম প্রচার করেননি, সুন্দরবনের অবর্ন হিন্দুদের মনে ভরসার জায়গা তৈরি করেছিলেন। তাঁরা হিন্দুদের বদ্ধমূল কোনও সংস্কার ধ্বংস করার চেষ্টা করেননি, বরং আপস করেছিলেন। আর এভাবেই সুন্দরবনবাসীর কাছে পীর গাজীরা দেবতার আসনে অধিষ্টিত হয়েছেন।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content