সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

আমার পার্টনারের কোয়ার্টারে যিনি রান্না করেন ধরুন তার নাম সুনীতা। একটি দুর্ঘটনার কারণে তাঁর হাতে একটি সমস্যা দেখা দেয়। শহরের সরকারি চিকিৎসালয়তে বার দু’য়েক গিয়ে চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করার পরেও হাত যখন ঠিক হল না, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা করাবেন। তাঁর মনে হল গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসক জানে কীভাবে এই ধরনের সমস্যার চিকিৎসা করতে হয়।

এই সিদ্ধান্তে তিনি এতটাই অবিচল যতটা তিনি মনে করেন যে, তিনি রোজ নিজের মাথা, মুখ ঢেকে রেখে অন্যের বাড়িতে রান্না করতে এসেও নিজের পরিবারের সম্মান বা ইজ্জত রক্ষা করছে। রান্না করতে আসাটা তাঁর কাছে পেটের দায়। কারণ তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে দিয়েছেন। অর্থনৈতিক সাহায্যও করেন না। স্বামী মদ্যপ ছিলেন। সেই সঙ্গে মারধর করতেন।

তাই সুনীতা চায়নি তাঁর স্বামী আবার ফিরে আসুন। কিন্তু সুনীতা নিয়মিত স্বামীর খবর নিয়ে থাকেন। স্বামীর কারণে হওয়া মেয়েকে মানুষ করা থেকে বিয়ে না দেওয়া অবধি তার দায় স্বামী এবং নিজের পরিবারের ইজ্জত রক্ষা করা। সেই ইজ্জত রক্ষা করতে গিয়ে শহুরে ডাক্তারের ফিজিওথেরাপি করানোর প্রচেষ্টা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না।
গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসক আসলে তাঁর গ্রামতুত ভাই। আমাদের দেশে গ্রামে বসবাস করেন যারা তারা মূলত হয় এক পেশার বা এক জাতের। তাই তারা এক সঙ্গে বসবার করেন বলে নিজেদের এক পরিবার ভুক্ত মনে করেন।বৃহৎ গ্রামীণ পরিবারের মূল লক্ষ্য থাকে নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমা রেখার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু পারিবারিক সম্পর্ক যেমন ভাই-বোনের সম্পর্ক অটুট রেখে দিতে। জাতিগত এবং গোত্রগত সম্পর্ক অনুক্রমে বেঁধে রাখা হয় গ্রামে। এই ভাবে সম্প্রদায়ের শুধু অস্তিত্ব বজায় রাখা নয়, তাদের নিজেদের সম্পদের পরিমাণ ঠিক রাখাটাও একটি বিশেষ কাজে পরিণত হয়েছে।

বৈবাহিক সম্পর্ক দুটি আলাদা জাতের মধ্যে হলে সম্পদের বিভাজন হয়ে যাবে, এই উদারতা ভারতীয় রা এখনও দেখাতে পারেনি। আর কৌতূহলের বিষয় হল নারীদের জিনিসপত্র খুঁজে গুছিয়ে রাখার ক্ষমতা যা মূলত তৈরি হয়েছে নারীদের শস্য সংগ্রহ করার প্রবণতার অভ্যাস থেকে, সেই গুণকে কাজে লাগিয়ে তাঁদেরকেই বলা হয়েছে এই পারাবারিক তথা সম্প্রদায়ের নিয়ম এবং ন্যায় নীতির বিষয়টিকে গুছিয়ে রাখতে। তাই সুনীতা যখন বললেন যে, তাঁর হাতের চিকিৎসা গ্রামের হাতুড়ে করতে পারবে তখন তার আশপাশে থাকা পরিবারের বা অন্য মহিলারাও মেনে নেন। তর্ক করা বা অন্য উপায় বলতে যায় না। কারণ তাঁদের সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। যদি তাঁদের কোনও আচরণ, বলা কথা পরিবারের কিংবা নিজের সম্প্রদায়ের ইজ্জত নষ্ট করে ফেলে তাহলে খুব বিপদ হবে। তাই এঁরা খুব ধীরে ধীরে কথা বলেন এবং পারলে সব সময় মাথা চোখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৩৪: আইনের কথা, সাম্যের কথা, কাদের কথা?

প্রথম আলো, পর্ব-৩: পৃথিবীর প্রথম কবি কে, জানেন?

এই কিছুদিন আগে সংবাদমাধ্যমে আমি এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা পড়লাম। প্রতিটি ঘটনাতে একটি বিষয় বারে বারে উঠে এসেছে সেটা হল বাবা, মা এবং দাদা বা ভাই মিলে দিদি বা বোনকে হত্যা করেছে। কারণ এই সব মেয়েরা পরিবারের ইজ্জত নষ্ট করেছে। আশ্চর্যের বিষয় এখানে দুটি। এই ইজ্জত নষ্ট বিষয়টি নির্ধারণ করা হল কোন আইনি প্রক্রিয়াতে, আর কীভাবেই বা বিচার প্রক্রিয়ার শেষে হত্যা করা হল। কারণ দেশের দণ্ডবিধি বা পেনাল কোড কখনওই বাড়ির আত্মীয়দের বা গ্রামের পঞ্চায়েতকে এই ভাবে হত্যা করে শাস্তি দেওয়ার বিধান দেয়নি। তাহলে আমরা এই ইজ্জত রক্ষার জন্য হত্যা বা ‘অনর কিলিং’ বিষয়টির অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছি কেন?

আমরা এই ইজ্জত রক্ষার জন্য হত্যা বা ‘অনর কিলিং’ বিষয়টির প্রয়োগ বেশি মেয়েদের উপরে করে থাকি, তবে ছেলেদেরও দেখা যায় জাতিগত অবস্থানে নিচের দিকে অবস্থান করছে তাহলে তাদেরও এই মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি পেতে হয়। এবার আমাদের বুঝতে হবে এই পরিবারের বা গ্রামের বা সম্প্রদায়ের ইজ্জত বিষয়টি কী? মানে সংজ্ঞা কী? আর ইজ্জত চলে গেলে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে হবে কেন আর তারপর তাকে হত্যা করতে হবে কেন?
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১২: আমাকে আমার মতো থাকতে দাও

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৪: ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে কোচস্থাপত্যের অন্যতম কীর্তি দেওতাপাড়া শিব মন্দির

প্রথমেই বলি পৃথিবীর বহু দেশেই ইজ্জতের জন্য হত্যা করার বিষয়টি প্রচলিত। শুধু ভারতে বা প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানেই হয়, তা নয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং ইউনেস্কো যে সংজ্ঞা দিয়েছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, এটি একটি প্রাচীন রীতি। মূলত একতরফা ভাবে মেয়েদের হত্যা করার মধ্যে দিয়ে পালিত হয়।

এই হত্যার মূল কারণ এই মহিলারা তাঁদের পরিবার, সম্প্রদায়ের সম্মান ক্ষুণ্ণ করেছেন বিয়ের বাইরে গিয়ে কোনও সন্দেহজনক যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছেন বলে। বাড়ির পুরুষেরা বাড়ি, পরিবার, সম্প্রদায়ের, গ্রামের সম্মান রক্ষা করতে দায়বদ্ধ। তাই তাঁদের কাছে নারীদের করা অসম্মানের একটাই সমাধান আর তা হল হত্যা। এখানে ভারতীয় দণ্ডবিধি কী বলছে সেটা জানা বা প্রয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ দেখা গিয়েছে গ্রামের প্রতিটি সদস্য পরিবারের সন্মান রক্ষা করার জন্য হত্যা করাকে সমর্থন করে। প্রত্যেকেই সম্মতি জানায় ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছায়।

ইজ্জত বিষয়টি যেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে আমাদের একবার বুঝে নিতে হবে ইজ্জত বলতে আমরা কোন ধারণা লালন করে চলেছি। ভারতীয় উপমহাদেশে ইজ্জতের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে একজন ব্যক্তির যে সামাজিক অধিকারগুলি আছে সেগুলি মূলত গোষ্ঠীর নিয়ম নীতির অধীন। গোষ্ঠীর নিয়ম নীতিগুলি শক্তিশালি এবং প্রভাবশালী। এই নীতি মেনে চললে তবেই কোনও ব্যক্তিকে গোষ্ঠীর সদস্যপদ দেওয়া হয়। সদস্যপদ পাওয়া মানে নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমা রেখার মধ্যে সম্পদ-সহ বসবাস করতে পারবে।

সেই নীতিগুলির অবমাননা করলে বসবাস করার সন্মান চলে যাবে। মানুষ যখন ক্রমেই সরল সমাজ থেকে জটিল সমাজের দিকে এগিয়ে চলে তখন জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের অন্তর্ভুক্ত মানুষদের গোষ্ঠী টিকিয়ে রাখার জন্য নানা রকমের ন্যায় নীতি মেনে চলতে হয়। সেই ন্যায় নীতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে থাকে। একদম প্রাথমিক স্তরে যখন মানুষ গোষ্ঠী বজায় রাখার জন্য দমনমূলক ন্যায়-নীতি প্রয়োগ করে, তখন হত্যা বিষয়টি প্রাথমিক শাস্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু ক্রমেই যখন সমাজ আকারে আয়তনে জটিল হতে থাকে, তখন মানুষ বুঝতে পারে নজরদারিতে থাকলে হত্যা করে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া যায়। মানুষের ভূমিকা এবং সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো মানুষের ন্যায় নীতি বোধের দ্বারা অনেকটাই পরিচালিত হতে পারে। বিশেষ অসুবিধে হয় না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৫: সফল হোগি তেরি আরাধনা

ভারত-সহ উপমহাদেশে দেখা গেল আধুনিক ন্যায়-নীতি বোধের প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না যখন নারীদের স্বাধীন জীবনের কথা বলা হচ্ছে। উলটে সম্মান রক্ষার দায় চাপিয়ে দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। সমাজ মেনেও নিচ্ছে। কেন মেনে নিচ্ছে? এখানেই আসে পরিবার তৈরি করার মুল কারণ কী ছিল?

পরিবার মানুষ তৈরি করেছে সম্পদ রক্ষা করার জন্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যখন কিছু জমি, গবাদি পশু, কিছু সোনা, মানিক ইত্যাদি ছিল সম্পদ, তখন মানুষ মনে করল বিসমকামী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। নারীর যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নারীকে দাসীতে পরিণত করতে হবে। নারীকে একগামী মানে একজন পুরুষকেই বিয়ে করে নিজের যৌন ইচ্ছে পূরণ করতে হবে। কিন্তু পুরুষকে বহুগামী থাকতে হবে। তবেই উৎপাদিত সন্তান দিয়ে নিজের জাতের ধারা এবং ভারতে আর্যদের নিজেদের জাতি (রেস এখানে) গরিমা বজায় রেখে নিজেদের ক্ষমতাশালী করে তুলতে হবে। সেই জন্য বিয়ের সঙ্গে সন্তান উৎপাদন করাকে আবশ্যিক করে দেওয়া হয়েছে। বিয়ের এক বছরের মধ্যে সন্তান উৎপাদন না করতে পারলে না না মহলে কথা চালাচালি শুরু হয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১১: সুন্দরবনের ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

সমাজ এই ব্যবস্থা প্রয়োগ করে দেখল নারীদের উপর প্রভুত্ব করে সম্পদের এক রৈখিক বৃদ্ধি এবং লড়াই শুধু পুরুষদের সঙ্গে করলেই মিটে যাচ্ছে তখন তাদের সাহস উত্তরোত্তর বাড়তে শুরু করল। সেই সাহসের ব্যাপক প্রয়োগের নমুনা পাওয়া যায় যখন বাবা, মা, দাদারা বোনকে পিটিয়ে মেরে ফেলে।

কারণ হিসেবে বলে গ্রামের কোন নিচু জাতের ছেলের সঙ্গে প্রেম করছিল, কখনও বলে বাড়ির অমতে অন্য কোনও চাকরি করছিল, সঠিক পোশাক পরেনি, নিজের প্রেমিকের বিরুদ্ধে কোর্টে সাক্ষী দেয়নি। কারণ আজকাল আইনের সাহায্য নিয়ে প্রেমিকের পরিবারকে সায়েস্তা করতে চায় বহু পরিবার হত্যার মতো বিষয় থেকে নিজেদের আলাদা রাখবে বলে। এছারাও পরিবারের ঠিক করে দেওয়া পাত্রকে বিয়ে করতে না চাইলে কিংবা সমকামী সম্পর্কে থাকলে হত্যা করা পাপ নয় বলে ধরে নেওয়া হয়।

নারীর শরীর এবং মনের উপর যত বেশি পাশবিক শক্তি প্রয়োগ করা হবে, ততই নারীদের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা মুশকিল হবে। ভারত-সহ সমগ্র উপমহাদেশে আগ্রাসী পৌরুষ এই ভাবেই সংস্কৃতিতে স্থায়ী হয়ে যায়। আমরা গ্রহণ করতে থাকি সমাজে ইজ্জত পাওয়ার জন্য। তারপর যখন দেখি পর্দানশীন নারীরা, না প্রশ্ন করা নারীরা সমাজে ইজ্জত পেতে থাকেন, আমরাও তখন বাধ্য হই মেনে নিতে, না হলে ইজ্জত থাকবে না। কষ্ট করে বেঁচে থাকতে গেলে যে রসদ লাগে সেটাও যখন বন্ধ করে দিতে থাকে, তখন কল্পনা করে বানানো ইজ্জত মেনে নিতে নারীরা বাধ্য হয়। এ ভাবে মৃত মনের শরীরে পুরুষের দাপাদাপি চলছে, কিন্তু কত দিন? উত্তর মেয়েদেরই দিতে হবে।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content