রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

ঠাকুর ও সারদা মায়ের গৃহী জীবন অন্যদের গৃহস্থ জীবনের মতো নয়। তাই তাঁদের মধ্যে যে সম্বন্ধ ও তাঁদের পারস্পরিক আচরণ সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা মুশকিল। তাঁদের অলৌকিক আচরণ দেবতুল্য হলেও তাঁরা দু’ জনেই সকলের মতো এই পৃথিবীরই মানুষ ছিলেন। ঠাকুরের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ইন্দ্রিয় সংযম একাধিকবার বিভিন্ন লোকের দ্বারা পরীক্ষিত হয়েছে। কখনও মথুরবাবু স্বয়ং, কখন বা ভৈরবী ব্রাহ্মণী তাঁকে পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং তা সকলেরই জানা আছে। কিন্তু সাধ্বী স্ত্রীর চরিত্রের সংযম স্বামী স্বয়ং না জানালে লোকের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়।
এই সময় দক্ষিণেশ্বরে সারদা মা আট মাস ধরে ঠাকুরের সঙ্গে এক শয্যায় শয়ন করেছেন। পরে সারদা বলেছেন, ‘আমার বয়স তখন আঠারো-উনিশ বছর হবে, ওঁর সঙ্গে শুতুম। একদিন তিনি বললেন, ”তুমি কে? বললুম, আমি তোমার সেবা কত্তে আছি। তিনি বললেন, কী? সেবা কত্তে আছি? তুমি আমা বই আর কাকেও জান না? না। আর কাকেও জান না? না। কাকেও না? না”। এই সময় প্রায় সমস্ত রাত ঠাকুরের মন উচ্চ ভাবের ভূমিতে বিচরণ করত। যদিও বা তিনি ভাবের ঘোর থেকে কখনও মনকে নীচে নামিয়ে আনতেন, তাতে সাধারণ মানুষের মতো দেহচেতনা থাকত না।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮: নহবতে সহধর্মিণী সারদা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

যত মত, তত পথ, পর্ব-৩: আদর্শ শিক্ষক শ্রীরামকৃষ্ণ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?

এক এক দিন তিনি সমাধিতে এমন লীন হয়ে যেতেন যে অনেকক্ষণ কোনও বাহ্য চেতনা থাকত না। সারদা তাঁর স্বামীর ভাব সমাধি অবস্থায় কী করবেন বুঝতে না পেরে ভীত হয়ে পড়তেন। ঠাকুরের মনে মাঝে মাঝে সংশয় হয়, এই নবযৌবনা নারী যদি কখনও তাঁকে ভোগ বাসনার দিকে নিয়ে যায়। তখন তিনি কী করবেন। একদিন তিনি সারদাকে স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি গো, তুমি কি আমাকে সংসারপথে টেনে নিতে এসেছো’? লেশমাত্র দ্বিধা না করে সারদা বললেন, ‘না, আমি তোমাকে সংসার পথে টানতে যাব কেন? তোমার ইষ্টপথেই সাহায্য করতে এসেছি’। কথাটি ছোট হলেও তা এক ঐতিহাসিক উক্তি।

জগতে নারীর সান্নিধ্যে বহু মনীষীরই স্খলন ঘটে। কথায় বলে, মুনিদেরও মতিভ্রম হয়। অনেক পৌরাণিক আখ্যানেই এর দৃষ্টান্ত আছে। বহু জ্ঞানীজন তাই সহধর্মিণীকে পরিত্যাগ করেই নিজের ইষ্ট পথে যান। নিমাই সন্ন্যাসও এর ব্যতিক্রম নন। সারদা এ কি কথা বললেন তাঁর স্বামীকে আজ! তিনি স্বামীর আধ্যাত্মিক উত্তরণের সোপান হতে চাইছেন, কোনও চাওয়া-পাওয়া তার মধ্যে ছিল না। মুখের কথায় তো আর সব প্রমাণ হয় না। এই কারণেই তিনি সারদার সঙ্গে রাতের পর রাত কাটিয়ে লক্ষ্য করেছেন, কোনও চাঞ্চল্য বা চিত্তবিক্ষেপ নেই তাঁর। ‘রতির পৃথিবীতে যেন মূর্তিমতী বিরতি সারদা’। নিশ্চিন্ত হয়েছেন তাঁর নৈকট্যে ঠাকুর।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-8: চলতি কা নাম কিশোর

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১১: সুন্দরবনের ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়

এই বিষয়ে ঠাকুর পরবর্তীকালে অন্তরঙ্গ ভক্তদের কাছে বলেছেন, ‘ও যদি এত ভালো না হত, আত্মহারা হয়ে আমাকে আক্রমণ করত, তাহলে সংযমের বাঁধ ভেঙে দেহবুদ্ধি আসত কি না, কে বলতে পারে’? মনীষী রামানন্দ যথার্থই বলেছেন যে, সারদা সাত্ত্বিক প্রকৃতির নারী না হলে রামকৃষ্ণ ‘রামকৃষ্ণ’ হতে পারতেন কি না, সে বিষয়েও সন্দেহের অবকাশ আছে।

ঠাকুরের নিজ মুখের কথায় সেই সন্দেহের অবকাশের কথার তিনি নিজেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। একবার কিছুতেই ঠাকুরের সমাধি ভাঙছে না দেখে সারদা কেঁদে ভাগনে হৃদয়কে ডেকে পাঠালেন। পরে ঠাকুর সব শুনে তাঁকে কিরূপ ভাব হলে কোন নাম বা বীজমন্ত্র কানে শোনাতে হবে, তা শিখিয়ে দেন। তবুও ঠাকুরের কখন সমাধি লেগে যাবে, এই চিন্তায় সারদা ঘুমাতে পারতেন না। সারা রাত জেগে থাকতেন। ঠাকুর জানতে পেরে নহবতে তাঁর মায়ের কাছে সারদার শোওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

ঠাকুর যেমন বালকস্বভাব, সকলের কথায় আস্থা রাখতেন। সারদাও তেমনই সরল ছিলেন। কোন একজন মহিলা সারদাকে বুঝিয়েছিলেন যে, সন্তান না হলে সংসারধর্ম রক্ষাকরা যায় না। তাই সংসারবিমুখ স্বামীকে সংসারে ফেরানো স্ত্রীর কর্তব্য। সেই মহিলার কথা শুনে সারদা ঠাকুরের কাছে এসে জানতে চান যে, ছেলেপুলে একটাও না হলে সংসারধর্ম বজায় থাকবে কেমন করে। উত্তরে ঠাকুর বলেছিলেন, ”একটা ছেলে কি খুঁজচ গো, তোমার এত ছেলে হবে যে, তুমি মা-বোলে তিষ্ঠাতে পারবে নি।”
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৪: ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে কোচস্থাপত্যের অন্যতম কীর্তি দেওতাপাড়া শিব মন্দির

প্রথম আলো, পর্ব-৩: পৃথিবীর প্রথম কবি কে, জানেন?

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১২: আমাকে আমার মতো থাকতে দাও

পরবর্তীকালে মা সারদা তাঁর শিষ্য সন্তানদের কাছে এই কথা মনে করে বলেছেন, ”তাই আজ দেখচি বাবা, কত দেশদেশান্তর থেকে কত ছেলেই যে আমার কাছে আসচে।” যিনি মাতৃত্বের মহিমায় ভবিষ্যতে অসংখ্য মানবের কাছে পূজার আসন পাবেন। যৌবনে সেখানে মাতৃভাবের উন্মেষ যে খুব স্বাডাবিক। ঠাকুরও তা বুঝতে পেরেছিলেন। এই একটি দিনের কথা ছাড়া আর কোনওদিন সারদা নিজের জন্য স্বামীর কাছে কিছু চাননি। শুধু ঠাকুরের সেবার অধিকারই তাঁর কাম্য ছিল। তাও নিজের মুখে কোনদিন বলেননি। প্রতীক্ষায় থাকতেন, ঠাকুরকে খাওয়ানোর সময় তাঁর দর্শনলাভের।

কোনও সময়ে ঠাকুরের শিষ্যা ও সারদা মায়ের সেবিকা অন্নপূর্ণাদেবী, যাঁর সুপরিচিত ডাকনাম ছিল ‘গোলাপমা’ কিছুদিন যাবৎ রোজ নহবত থেকে ঠাকুরের থালা তাঁর ঘরে দিতে থাকায় সেই নিত্যকার দর্শন থেকেও সারদা বঞ্চিত হন। এ নিয়ে তাঁর কোনও অভিযোগ ছিল না। ঠাকুরের ভক্তদের চেয়ে তাঁর দাবি যে বেশি, তা তিনি ভাবতেই পারতেন না। গোলাপ মাকে ঠাকুর বলেছিলেন, ‘ওর সহ্যগুণ কত, ওকে নমস্কার’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content