রবিবার ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫


প্রধান আকর্ষণ ক্যানেল ক্রুজে বেড়ানো।

লন্ডন ঘোরা শেষ হল। যদিও বেশ কিছু রইল বাকি। সময়ের টানাটানি। এ বার বেলজিয়াম ও হল্যান্ড। বাসে এলাম হারউইচ পোর্ট। মস্ত বড় পোর্ট। কিন্তু ভিড় নেই। সবাই পোর্ট থেকে ছাড়পত্র নিয়ে জাহাজে উঠলাম। স্টিনা লাইনের জাহাজ। মস্ত বড়। ভেতরে ঢুকে চোখ ছানাবড়া। কি না আছে ভিতরে। দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, বিনোদনের জায়গা। যার যার কেবিনে জিনিসপত্র রাখলাম। ছোট ছোট কেবিন। কিন্তু সবরকম সুবিধে রয়েছে। শোবার, বসার, জামাকাপড় রাখার। একটা ইন্টারকমের টেলিফোনও আছে। অনেক সকালে পৌঁছবে। তাই সকালে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেবে বললো।

জাহাজ ছাড়ার সময় হল। মস্ত খোলা ডেকে দাঁড়ালাম। ওপরে রাতের আকাশে তারার ঝিলিমিলি। নীচে জলের উপর জাহাজের আলোর ঝিকিমিকি। কী সুন্দর যে লাগছিল। কোনও কথাই যথেষ্ট নয় তাকে বোঝাবার। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। জাহাজের ভিতরেও ঘুরলাম তারপর। দোকানপাট দেখে খেতে গেলাম। নানা রকমের খাবার সাজানো। বুফেতে খাওয়া। পছন্দমতো খাবার নিয়ে ধারের টেবিলে বসলাম। আমরা উত্তর সাগর (North Sea) দিয়ে যাচ্ছি। অন্ধকারে সমুদ্রের জল জাহাজের আলোয় চিকচিক করে উঠছে। ভিতরে খাবার জায়গায় একটা ছোট স্টেজে গান করছে একজন। সব মিলিয়ে প্রাণ-মন ভরে গেল। অনেক রাতে শুতে গেলাম।
ভোর চারটেয় ‘ওয়েকআপ কল’। জাহাজ ভিড়েছে কুলে। জিনিসপত্র গুটিয়ে নামলাম। বাস দাঁড়িয়ে ছিল। এখন থেকে পুরো ইউরোপে ভ্রমণে এই বাসটি আমাদের সঙ্গে থাকবে। বাসের পেটে সব মালপত্র ঢুকে গেল। বেশ বয়স্ক ড্রাইভার। পরে জেনেছিলাম ওর বয়স ৭০ বছর। খুব শক্তপোক্ত মানুষ। সব মালপত্র টানাটানি করে বাসে ঢোকাচ্ছেন। সারাদিন বাস চালাচ্ছেন। খাবার সময় খেয়াল করেছি শুধু একটা চিকেনের লেগ পিস আর খানিকটা স্যালাড খেতেন। এটাই বোধ হয় ওর কর্মক্ষমতার চাবিকাঠি।

প্রথমে গেলাম বেলজিয়াম। অটোমিয়াম দেখলাম। এটি ১৯৫৮ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড ফেয়ারে তৈরি করা হয়েছিল। কারিগরি শিল্পের এক মহান নিদর্শন। অটোম ও অ্যালুমিনিয়াম এই দুই শব্দ মিলে অটোমিয়াম। এটি দেখে সবাই আত্মহারা। গাইড বারবার সাবধান করেছিলেন নিজেদের দামি জিনিসপত্র নিয়ে সতর্ক থাকতে। আত্মহারা হওয়ার অসতর্ক মুহূর্তে একজনের পার্স খোয়া গেল। আমরা অটোমিয়ামের সামনে গিয়ে ঘুরে দেখলাম। মনে হল মস্ত বড় বড় ঝকঝকে স্টেনলেস স্টিলের বলের আকৃতির জিনিসগুলো এক নাগর দোলার মতো চাকাতে লাগানো। ভিতরে অনেক কিছু আছে। আমাদের ঢোকা হয়নি।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন: বর্ণময় ইংল্যান্ড: লন্ডনের অন্যতম আকর্ষণ বাকিংহাম প্রাসাদের রক্ষী বদল অনুষ্ঠান

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৩: ধরবো ধরবো করছি কিন্তু…

এরপর ব্রাসেলসের প্রাসাদ। অবিশ্বাস্য স্থাপত্য তার। আর সামনে বিরাট ফুলের বাগান। নানা রঙের ফুলের বাহার। সবার ছবি তোলার ধুম পরে গেল। বেলজিয়ামের চকোলেট বিখ্যাত। আমরা একটা চকোলেট ফ্যাক্টরিতে গেলাম। অল্পস্বল্পই কেন হল। খুব দাম। ব্রাসেলসের দ্রষ্টব্যর মধ্যে আছে মাননেকেন পিস। মূলত একটি ঝর্ণা যার উৎস একটি ছোট শিশুর মূর্তি। কথিত আছে যে শিশুটি ব্রাসেলসকে খরা ও আগুনে ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচায়। অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী সে। এটি এখন ব্রাসেলসে শান্তি ও প্রতিরক্ষার প্রতীক। ফেরার সময় দেখলাম একটা গাছতলায় বাঁধানো চত্বরে এক যুবক গিটার বাজিয়ে গান গাইছে। সামনে একটা খোলা বাক্স। কেউ দাঁড়িয়ে শুনছে, কেউ পয়সা দিচ্ছে। ইউরোপের অনেক শহরে এমনটি দেখেছি পরে।
আরও পড়ুন:

রিভিউ: নতুন থ্রিলার সিরিজ ‘সাড়ে ষোলো’—সিজন-১ ষোলো কলা পূর্ণ করেছে

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-8: চলতি কা নাম কিশোর

বেলজিয়াম থেকে গেলাম আমস্টারডাম। নেদারল্যান্ডের প্রধান শহর। এখানে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ ক্যানেল ক্রুজে বেড়ানো। শহারের মধ্য দিয়ে ক্যানেল। আমাদের দলের জন্য একটা ক্রুজ নেওয়া হল। ক্রুজে ওঠার সময় একজন বিদেশি মহিলা সব কাপলদের দাঁড় করিয়ে আলাদা আলাদা ছবি তুললেন। সবাই তো বেজায় খুশি। পরে নামার সময় দেখি একখানা বড় বোর্ড এ সব ছবিগুলো সাঁটানো। নিজেদের এত সুন্দর ছবি দেখে কেউ আর কিনতে আপত্তি করেনি। বুঝলাম ভালোই ব্যবসা ওঁর। ক্যানেলের দু’ ধারে সবকিছুর সঙ্গে পরিচিত হতে হতে চললাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যান ফ্রাঙ্ক যে বাড়ির চিলেকোঠায় ছিলেন সে বাড়িটা দেখলাম। এছাড়া হাইনেকেন বিয়ারের প্রথম যে ফ্যাক্টরি বিল্ডিং সেটাও দেখলাম। সরু ক্যানেল শহর ঘুরে ঘুরে মস্ত এক সাগরের মতো জায়গায় মিশেছে। ওটাকে বলে আইজে বে। ওখানে জল উথাল পাথাল। আমাদের ছোট হালকা ক্রুজ। ভয় করছিল। যাই হোক। যেখান থেকে উঠেছিলাম সেখানেই ফিরলাম।

অটোম ও অ্যালুমিনিয়াম এই দুই শব্দ মিলে অটোমিয়াম। এটি দেখে সবাই আত্মহারা।

আমস্টারডামে আরেকটি দ্রষ্টব্য ওখানকার চিজ মিউজিয়াম। ছোট মিউজিয়াম। সেখানে চিজ বানানোর পদ্ধতি, তার ইতিহাস এ সব ব্যাখ্যা করার লোক রয়েছে। আর বিভিন্ন তাকে সাজানো রয়েছে নানারকমের চিজ। আমাদের দেশে পুরোনো দিনে বড় বড় গোল গোল কাপড় কাচার সাবান পাওয়া যেত, কতগুলো চিজ ওই রকম দেখতে। শুনলাম ওদেশে গোচারণ ভূমি প্রচুর। তাই দুগ্ধ জাতীয় খাবার প্রাচুর্য ও খ্যাতি।

পরদিন গেলাম মাদুরদাম দেখতে। এটি পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় পার্ক। বড় শহরের সব জিনিসের একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। মনে হল গল্পের লিলিপুট দের দেশে এসেছি। রাস্তাঘাট, যানবাহন,পাহাড় নদী, হাইডেল প্রকল্প কি না আছে। ছোট ছোট রাস্তায় ছোট গাড়ি চলছে। নদীতে নৌকো চলছে, বিমান উড়ছে, ফোয়ারা দিয়ে জল পড়ছে। প্রতিটি জিনিস নিখুঁত ছোট প্রতিরূপ। আসল জিনিসের। ছোট ছোট পুতুল মানুষ রাস্তা ঘাটে। বিস্ময়ে হতবাক সবাই। ছোট জিনিস সকলের মন কেড়ে নেয়। কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কবিতার কথা মনে পড়ল— ‘ছোট যে হায় অনেকসময় বড়র দাবি দাবিয়ে চলে’। পরে জেনেছিলাম যে প্রতিটি মডেল মূল জিনিসটির চেয়ে ২৫ গুণ ছোট। কত পরিশ্রম দিয়ে এসব জিনিস বানানো হয়েছে ভাবা যায় না। ইউরোপের যতগুলো দেশে যত বিস্ময় আছে আমার কাছে মাদুরদাম তার মাঝে সেরা।

নেদারল্যান্ডে যেটি না দেখা রইল সেটি টিউলিপ গার্ডেন। আমাদের ঘোরার তালিকায় সেটি ছিল না। টিউলিপ গার্ডেনের বর্ণময় ছবি দেখি সব জায়গায়। একটু ক্ষোভ রয়ে গেল। আবার যদি কখনও আসি…
আরও পড়ুন:

যত মত, তত পথ, পর্ব-২: গুরুমশায় শ্রীরামকৃষ্ণ

কলকাতার পথ-হেঁশেল: উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া—প্রাণের আশ-প্যান্থেরাস

এ বার যাওয়া প্যারিস। সন্ধেবেলা পৌঁছলাম…an evening in Paris. মোহময়ী সুন্দরী প্যারিস। হোটেল থেকে রাত বারোটায় আলোকসজ্জায় আইফেল টাওয়ারকে দেখব বলে রওনা হলাম। ছোট ছোট আলোর মালায় পুরো টাওয়ারটি ঝলমল করছে। ভেতরে লিফট আছে। একদম শেষ লেভেল পর্যন্ত গেলাম। স্বপ্নের নগরীর রাতের এক অপূর্ব রূপসী ছবি দেখলাম। আকাশ আর পৃথিবীর ঝিকিমিকি আলো এক হয়ে গিয়েছে। অনেক পর্যটকই এসেছে এই সময়।

ইউরোপের প্রায় সব দেশেই ক্যানাল ক্রুজে ঘোরার ব্যবস্থা। প্যারিস এ আছে স্যেন নদী। পরদিন ক্রুজে সে নদীতে ঘোরা হল। আগেই বলেছি, ও সব দেশের খালের মতো নদী দেখে আমাদের নদী নিয়ে গর্ব হয়। তবে শহরের মধ্য দিয়ে নদী। তাই দু’ পাশের সব জায়গা ও বিশিষ্ট দর্শনীয় জিনিসের একটা ধারণা হয়।

প্যারিস বেড়ানোর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ল্যুভ মিউজিয়াম। সেখানে ঘোরার জন্য ওখানকার গাইড নিতে হয়। এক সুসজ্জিতা বয়স্কা মহিলা আমাদের গাইড। খুব ভিড় ওখানে। আমাদের মতো অনেক দল ট্যুরিস্ট এসেছে। গাইড আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে পতাকা দিলেন। সরু কাঠির মাথায় রঙিন কাগজের পতাকা। দলের প্রতীক। কেউ যাতে হারিয়ে না যায়। আর সবাইকে এয়ার ফোন দিলেন। ওঁর কথা যাতে সবাই শুনতে পায়।

আইফেল টাওয়ার।

সবাইকে বারবার সাবধান করে হল নিজেদের সঙ্গে দামি জিনিসপত্র সম্বন্ধে। ছিনতাইকারীর স্বভাব দেশ-কাল-পাত্র-ভেদে অপরিবর্তিত। তাই মিউজিয়ামের ভিড়ের সুযোগ নিয়ে অনেক ছিনতাই হয় শুনলাম। ল্যুভ মিউজিয়াম একদিনে দেখার নয়। আর সব জিনিস মনে রাখা তো সাধারণ মানুষের সম্ভবই নয়। প্রায় ৩৫ হাজার দর্শনীয় ছবি, ভাস্কর রয়েছে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম শিল্পকলা মিউজিয়াম। প্রাচীন গ্রিস, রোম, মিশর ইত্যাদি সব দেশের স্থাপত্য আলাদা আলাদা গ্যালারিতে আছে। গ্র্যান্ড গ্যালারি উইং মিউজিয়ামের সবচেয়ে লম্বা ঘর।

এখানে বেশিরভাগই ইতালির পেইন্টিং। বিশ্বব্যাপী নাম যে ছবির সেই মোনালিসার সামনে সবসময় ভিড়। সামনে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখার সুযোগ নেই। তাও ভিড় ঠেলেঠুলে মোবাইলে, পার্স হাতে শক্ত করে ধরে গেলাম। শিল্পীর হাতের টানে সেই রহস্যময় হাসি কী অপূর্ব ফুটে উঠেছে। এ হাসি নিয়ে দেশে দেশে কালে কালে কত গল্প, কত ব্যাখ্যা। এর সামনে দাঁড়িয়ে সবাই বুঝি এর ভারী ইতিহাসে বিভোর হয়ে যায়। আর সেই সুযোগেই ঘটে যায়…এ বারেও গেল…আমাদের দলের একজনের পার্স ছিনতাই হল। যার গেল সে বকা খেল। অসতর্কতার জন্য। প্রায় সারা দুপুর ঘুরে শ্রান্ত হয়ে দলের লোকেরা একসঙ্গে হলাম।

প্রথমবার ল্যুভ মিউজিয়াম ঘোরা অসম্পূর্ণ থাকাই স্বাভাবিক। ঠিক কতদিন ধরে দেখলে সম্পূর্ণ হয় আন্দাজ করতে পারব না। তবে এর বিশালত্ব, প্রাচীনত্ব এবং সংগ্রহের বিপুলতা আমায় বিস্মিত করেছে। যেন এক ইতিহাসের সঙ্গে কিছুক্ষণ হলেও একাত্ম হওয়ার সুযোগ ঘটে গেল।
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content