সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


মাথায় ত্বকের রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে জবা ফুল। ছবি: সংগৃহীত

ভারতীয় সংস্কার ও সংস্কৃতিতে প্রাক আর্য যুগ থেকেই বিভিন্ন ধরনের ফুলের ব্যবহার হয়ে আসছে। দেবতাদের পুজোর ক্ষেত্রে যেমন সাদা ফুলের বহুল প্রচলন রয়েছে এদেশে, তেমনই আমাদের দেশে মাতৃ আরাধনার ক্ষেত্রেই শুধু জবা ফুলের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে, সূর্যদেব এবং বজরঙ্গবলী অর্থাৎ হনুমানজির পুজো জবা ফুল ছাড়া অসম্পূর্ণ। ‘জবা’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘জপা’ থেকে। এই কথার প্রকৃত অর্থ হল—প্রার্থনা। অর্থাৎ দেবী শক্তির (মা কালী, দেবীচন্ডী, দেবীদুর্গা, মাজগদ্ধাত্রী ইত্যাদি) প্রার্থনা করা। ঋকবেদে ‘যসুম’ বা ‘জপাকুসুম’ শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, লাল রংয়ের কুসুম বা ফুল। পরবর্তী ক্ষেত্রে লোকোমুখে তা জবা ফুল নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

এই জবা ফুল নিয়ে একটি পৌরাণিক গল্পকথাও আছে। ভাগবত পুরাণে বর্ণিত আছে জসুম নামক এক নারী দেবী দুর্গার এক নিষ্ঠাবান ভক্ত ছিলেন। অশুর কুলের অত্যাচারে যখন ত্রিলোক অতিষ্ঠ, তখন দেবতাদের অনুরোধে দেবী রণচণ্ডী রূপ ধারণ করে অসুর বধ করতে উদ্ধত হলেন। জন্মান্তরে ওই ‘জসুম’, জবা ফুলের গাছ রূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধকালীন দশায় তাঁর পুষ্প পাপড়ির রং, দেবীর চক্ষুতে প্রদান করে দেবীর প্রকট রাগ প্রকাশের সাহায্য করেন। দেবী তারে এই ভক্তের আচরণে অতিশয় প্রসন্ন হয়ে তাকে ইচ্ছামতন বর প্রার্থনা করার আদেশ দেন। তখন জবা বলেন—”সারা জীবন যেন লালফুল রূপেই দেবীর পদতলে থেকে দেবীর সেবা করতে পারেন।” দেবী অতিশয় প্রসন্ন হয়ে তাঁকে জানালেন যে লালজবা দিয়ে কোনও ভক্ত, ভক্তি ভরে দেবীকে অঞ্জলি নিবেদন করেন তবে তার প্রতি দেবী অতিশয় প্রসন্ন হবেন এবং সারা জীবন তার ওপর দেবীর আশীর্বাদ ঝরে পড়বে। এই ভবেই লাল জবা দেবী শক্তির আরাধনার ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: হিবিসকাস রোজা-সাইনেন্সিস (Hibiscus rosa sinensis)
● গোত্র: মালভেসি।
● বাংলা নাম: জবা।
● সংস্কৃত নাম: ‘যসুম’।
● গাছের প্রকৃতি: জবা গাছ চির সবুজ গুল্ম জাতীয় অসংখ্য শাখা প্রশাখাযুক্ত উদ্ভিদ। এই গাছের উচ্চতা কমবেশি পাঁচ থেকে ছয় ফুট হয়। এটি গুপ্তবীজী, দ্বিবীজপত্রী প্রকৃতির গাছ এবং পাতা একক পত্র ও জালিকাকার শিরাবিন্যাস বিশিষ্ট। পুষ্পবিন্যাস একক প্রকৃতির এবং সারা বছরই ফুল ফোটে।
● গাছের বিস্তৃতি: জবা গাছের আদি উৎপত্তিস্থল চিন হলেও বর্তমানে এটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া তিব্বত মিশর প্রভৃতি দেশে লক্ষ্য করা যায়। মরুভূমি এবং পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া ভারতের মোটামুটি সর্বত্রই এটি দেখতে পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: রুদ্রাক্ষ সম্পর্কে এই কথাগুলি জানতেন?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৫: কোন আলো লাগলো ‘পুত্রবধূ’-র চোখে

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

কুয়ারসেটিন: ৩ ডাই গ্লুকোসাইড।
কোয়ারসেটিন: ৩, ৭ ডাই গ্লুকোসাইড।
সায়ানিডিন: ৩, ৫ ডাই গ্লুকোসাইড।
কোয়ারসেটিন: ৩ সপ হোপোট্রাইওসাইট।
ক্যামফেরল: ৩ জাইলোসাইলগ্লুকোসাইট (xylosylglucoside)।
সায়ানিডিন ক্লোরাইড।
সাইক্লোপেপটাইড অ্যালকালয়েড।
অ্যাসকরবিক অ্যাসিড।
থায়ামিন।
রাইবোফ্লাভিন।

এগুলি ছাড়াও আধুনিক গবেষণায় জানা গিয়েছে, জবা গাছের বিভিন্ন অংশ থেকে নিষ্কাশিত পদার্থ অ্যান্টিটিউমার, অ্যান্টিফার্টিলিটি, অ্যান্টিইমপ্লান্টেশন, আন্টিইনফ্লামেটরি, অ্যান্টিঅ্যালার্জিক, অ্যান্টি ভাইরাস, অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিপাইরেটিক, অ্যান্টিএসট্রোজেনিক, হাইপোটেনশিপ রূপে কাজ করে।

আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-8: চলতি কা নাম কিশোর

ডায়েট ফটাফট: শুধু স্বাদে নয়, পুষ্টিতেও মাছের রাজা, একঝলকে জেনে নিন ইলিশের গুণাগুণ

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার

 

চুলের পরিচর্যায়

ফুলের লাল পাপড়ির রসের সঙ্গে নারকেল তেল মিশিয়ে ফোটাতে হবে মিনিট দশেক। তারপর সেই জলীয় অংশ খানিকটা শুকিয়ে নিয়ে স্নান করার আধ ঘণ্টা আগে মেখে স্নান করলে চুল পড়া থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। রুক্ষ চুলের জৌলুষ ফেরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহার করা হয়।
 

মূত্র জনিত সমস্যা নিরাময়

যাদের ইউরিনারি ডিসঅর্ডারে আছে তারা আট থেকে দশটি জবা ফুল অর্ধেক লিটার (Half Litter)জলে সারারাত ভিজিয়ে রেখে পরের দিন ভোরবেলা থেকে শুরু করে ২ থেকে ৩ চামচ করে সারাদিনে চারবার খেলে উপকার পাবেন।
 

মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে

মনোতত্ত্ববিদের মতে, জবা ফুল মনকে শান্ত রাখে। আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত যে জবা গাছ থেকে নিষ্কাশিত বিভিন্ন পদার্থ হাইপোটেনসিভ এবং সিএনএস (CNS) ডিপ্রেসেন্ট হিসাবে কাজ করে মানসিক সুস্থতা প্রদান করে।
 

গনেরিয়া রোগ দূরীকরণে

রোগীকে দুধ, চিনি ও গোটা জিরের সঙ্গে জবা ফুল বেটে খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৩: কোচ কামতেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য এক অনন্যসাধারণ মিশ্রশৈলীর উদাহরণ

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১১: মশ্যা রে তুঁহু মম শ্যাম-সমান

 

মূত্র জনিত প্রদাহ দূরীকরণে

মূত্র প্রদাহে উপকার পেতে হলে একটি লাল রঙের জবা ফুলের পাপড়ি বেটে এক গ্লাস জলের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে বেশ কিছুদিন।
 

জন্মনিয়ন্ত্রক হিসেবে

জবা ফুলের মধ্যে উপস্থিত জৈব রাসায়নিক পদার্থ আন্টিফার্টিলিটি গুণসম্পন্ন হওয়ায় এই ফুল জন্মনিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা নেয়।
 

চুলের রং কালো করতে

লাল ফুলের পাঁপড়ির রস এবং আমলকি রসমিয়ে লোহার পাত্রে একদিন রেখে মাথায় দিলে চুলের রং মিশমিশে কালো হয়।
 

রোগ প্রতিরোধে

বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধে যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, স্কার্ভি রোগ সহ নানান ধরনের ব্যাকটেরিয়াল, ভাইরাল এবং ফাংগাল জনিত অসুখ নিরাময়ের ক্ষেত্রে লাল জবা ফুল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
 

বেদনা নাশক হিসেবে

৫০ গ্রাম ফুলের পাপড়ি ২০০ মিলি লিটার ইথানল দ্রবণে ডুবিয়ে রেখে ওই নির্যাস নিয়মিত ব্যবহার করলে তা বেদনা নাশক হিসেবে কাজ করে।
 

মহিলাদের রক্তস্রাব নিয়ন্ত্রণে

পঞ্চমুখী রক্ত জবার পাপড়ি বেটে জলের সঙ্গে মিশিয়ে খালি পেটে খেতে হবে। রক্তস্রাবের প্রত্যাশিত তারিখের এক সপ্তাহ আগে থেকে নিয়মিত পান করলে রক্তস্রাব নিয়মিত হবে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content