সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


রাজবাড়িতে।

আধুনিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত নৃপেন্দ্রনারায়ণের মানসিকতায় ধর্মীয় আচারের আগল পরিণয়ের আবেগকে বন্দি করতে পারেনি। তাহলে সেই মুহূর্তেই বোধহয় লেখা হয়েছিল কোচবিহারের নবজাগরণের এক নতুন পান্ডুলিপি।

প্রাচীনকাল থেকেই কোনও রাজ্য বা দেশের চরিত্র চিত্রণে ধর্মের এক অবশ্যম্ভাবী ভূমিকা থাকে। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সীমানা ছাড়িয়ে ধর্মীয় আচার দিয়েই এক একটি দেশের ভাগ্য রচিত হয়। হিন্দু রাজবংশ দ্বারা শাসিত কোচবিহার রাজ্যও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বার বার ধর্মের উগ্রতা বা কুসংস্কারের অন্ধকারে পথের অগ্রগতি হারিয়ে গিয়েছে। আধুনিকতাও অনেক সময় ধর্মীয় গোঁড়ামির আড়ালে চাপা পড়েছে। ইংরেজদের মতো কেশবচন্দ্রও বুঝেছিলেন, ‘ব্রাহ্ম’ সমাজের ছোঁয়া আলোর পথ অবশ্যই দেখাতে পারে।

এই বিবাহ কোচবিহারের রাজ পরিবার তো বটেই, রাজ্য তথা ভারতের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক স্মরণীয় পথনির্দেশ। মহারানির কথায়, “এক ব্রাহ্ম কন্যাকে বিবাহ করিয়া মহারাজ অন্তরের আলোকিত সত্ত্বার প্রতি যথেষ্ট সুবিচার করিয়াছিলেন সন্দেহ নাই। কিন্তু বলাই বাহুল্য ইহা স্পষ্টতই বোধগম্য ছিল যে, এই সম্পর্ক তাহার কোচবিহার ও বাহিরে আত্মীয়রা সকলে সমান চোখে দেখিবেন না। বিশেষ করিয়া যাহারা তখনও পুরাতন কুসংস্কারগুলিকে আপন কণ্ঠের মালা করিয়া পরিয়াছিলেন এবং যাহাদের নিকট পুরাতন হিন্দু রীতি হইতে কোনও রূপ বিচ্যুতি অত্যন্ত শঙ্কার বিষয় হইয়া প্রতীয়মান হইতো।”
এরপর এই বিবাহ কলকাতা তথা বাংলার জ্ঞানীগুণীদের সঙ্গে মহারাজের সম্পর্ক সহজ করে দিয়েছিল, যা পরবর্তীকালে কোচবিহারের নবজাগরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ শুধু নিজে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেই ক্ষান্ত থাকেননি, ১৮৮৩ সালে ব্রাহ্ম ধর্মকে কোচবিহার রাজ্যের ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এর ফলশ্রুতিতে নিজের পরিবারের ভিতর যে টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল তাকে তিনি সামাল দিয়েছিলেন অদ্ভুত শান্তভাবে, চারিত্রিক দৃঢ়তায় এবং অবশ্যই মহারানি সুনীতি দেবীর ইতিবাচক সাহচর্যে।
নিজের বিশ্বাসকে কখনওই তিনি জোর করে পরিবার বা প্রজাদের উপর চাপানোর নীতি নেননি বলে এর এক ইতিবাচক প্রভাব ধীরে সারা রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্ম ধর্মীয় বিশ্বাস কোচবিহার রাজ্য জুড়ে এক শক্তিশালী সমাজ সংস্কার মূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর উন্নতি সাধনে মহারাজ অগ্রণী ভূমিকা নেন।

কোচবিহারে রাজ আনুকূল্যে গড়ে ওঠে ব্রাহ্ম মন্দির। সুনীতি রোডের ধারে অবস্থিত এই মন্দির দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্ব বৃহৎ ব্রাহ্মমন্দির হিসেবে খ্যাত। মহারাজের উদার সংস্কারমনস্কতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কেশবচন্দ্রের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অবতীর্ণ সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজকে রাজ্যে আহ্বান। বহু পার্থক্য সত্ত্বেও দুই সমাজের অভিন্ন লক্ষ্য ছিল কোচবিহারের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতিসাধন।

১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা ভিক্টোরিয়া কলেজ। মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের সময়ই ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে আসেন আমাদের অত্যন্ত পরিচিত নাম মহাজ্ঞানী দার্শনিক ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম সদস্য আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। ভিক্টোরিয়া কলেজে তাঁর কার্যকাল ১৮বছর (১৮৯৬-১৯১৩)। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় ভিক্টোরিয়া কলেজ কোচবিহারে শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৭০ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ ‘আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কলেজ’ (ABN SEAL COLLEGE) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

এর আগে ১৮৮১ সালে মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণের ও মহারানি সুনীতি দেবী ‘সুনীতি কালেজ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা পরে (১৯১৬ সালে) সুনীতি অ্যাকাডেমি নামে আত্ম প্রতিষ্ঠা পায়। শিক্ষাক্ষেত্রে এক বিপুল আবেদন ও সাড়া পড়ে, বিশেষ করে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও অগ্রগতিতে।
আরও পড়ুন:

কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৬: ঐতিহাসিক বিরল বিবাহ ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া

প্রথম আলো, পর্ব-১: বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি জানেন?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৯: ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড কোনও ভাবেই শরীরে ঢুকছে না? অজান্তেই এই সব অসুখ ডেকে আনছেন কিন্তু

কলেজের কাজ, শিক্ষাদান, শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেওয়া, সব কিছুতেই মহারানির ছিল অত্যন্ত উৎসাহ ও আগ্রহ। এমনকি, এইসময় যখন হিন্দু মেয়েরা পর্দানশীন ছিলেন, সে সময়ও মহারানির ইচ্ছায় মেয়েদের সুবিধার্থে রাজবাড়ির ঘোড়ার গাড়িতে মেয়েদের বাড়ি থেকে স্কুল এবং স্কুল থেকে বাড়ি পৌঁছনোর ব্যবস্থা হয়। প্রথমদিকে গাড়িতে পর্দা টানা থাকত। পরে অবশ্য কোচবিহারে মেয়েদের পর্দা প্রথা থেকে মুক্তি ঘটে ব্রাহ্ম সমাজের অগ্রণী ভূমিকাতেই।

বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মেয়েদের যোগদানের সংখ্যা বাড়ে। ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যরাও প্রচার করেন জনসমক্ষে বিধবা বিবাহের পক্ষে ও বাল্য বিবাহের বিপক্ষে। নানা বার্তা দিতে শুরু করেন। এ ভাবেই কোচবিহারবাসী রাজ সাহায্যে আধুনিকীকরণের পথে এগিয়ে যান। এমনকি সে সময় স্কুলে সূচী শিল্প, অন্যান্য হাতের কাজ, অক্ষর শিক্ষা বাংলা, ইংরেজি শিক্ষিত মেমদের দিয়ে চর্চা করানো হত।

মহারানি শিক্ষার্থীদের শংসাপত্র স্বাক্ষর করতেন এবং পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশ নিতেন। কলেজের ‘অ্যানুয়াল অ্যাডমিশন রিপোর্ট’ (১৮৯০-৯১) দেখলে বোঝা যায় কত যত্নে এবং আগ্রহে মহারানি কলেজের কাজ দেখাশোনা করতেন। শুধু কলেজ নয়, সুনীতি অ্যাকাডেমি স্কুলেও পুরস্কার বিতরনীতে নিজে সেখানকার ঐতিহাসিক হলঘরে উপস্থিত থেকে কৃতি ছাত্রীদের পুরস্কার দিতেন, এমনকি স্বর্নালঙ্কারেও ভূষিত করতেন বিশেষ ক্ষেত্রে।

কলেজের অনেক ছাত্রীকে কোনও কোনও সময় প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানাতেন। তাদের সামনে নারীর কর্তব্য বিষয়ে মূল্যবান উপদেশ দিতেন তাঁর বক্তব্যে। সুগভীর ভাষায় তা ব্যক্ত করতেন। একেবারে শেষে উপহার হিসেবে বই, কাপড়, প্লেট, বাক্স ও অন্যান্য সুদৃশ্য জিনিসপত্র দিতেন। পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মহারাজা ও অনেক সময়ই সেখানে উপস্থিত থাকতেন। কলেজের প্রথম স্থানাধিকারী একবার রৌপ্যপদক পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৫: কোন আলো লাগলো ‘পুত্রবধূ’-র চোখে

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৩: কোচ কামতেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য এক অনন্যসাধারণ মিশ্রশৈলীর উদাহরণ

নৃপেন্দ্রনারায়ণ ও সুনীতি দেবীর প্রভাব রাজ পরিবারে কীভাবে যে বিস্তৃতি পেয়েছিল তার প্রমাণ হিসেবে দেখি, মহারাজের ভ্রাতা কুমার গজেন্দ্র নারায়ণ, তাঁর বিবাহ হয়েছিল কেশবচন্দ্রের দ্বিতীয় কন্যা সাবিত্রী দেবীর সঙ্গে। গজেন্দ্র নারয়ণ ও সাবিত্রী দেবীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সাবিত্রী লজ, ভদ্রমহিলা সমাজ, কোচবিহারে নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। মেয়েদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯০৮ সালে এই সাবিত্রী লজেই প্রতিষ্ঠা পায় কারিগরী বিদ্যালয়। সুনীতি দেবী, সাবিত্রী দেবী ও পরে সুনীতি দেবীর পুত্র নিত্যেন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী নিরুপমা দেবীর ঐকান্তিকতায় ব্রাহ্ম সমাজের নীতি ও মূল্যবোধ কোচবিহার রাজ্যে সুদৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজপরিবারের ব্রাহ্ম ধর্মের এমন প্রতিপত্তি পরিবারের বাইরে সাধারণ সমাজেও ছড়িয়ে পড়েছিল।

ব্রাহ্ম পল্লী, ব্রাহ্ম বোর্ডিং, কেশব আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সব প্রতিষ্ঠান থেকেই সমাজের কুসংস্কার মুক্ত দৃষ্টি সমাজের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০৬ সালে তৈরি হওয়া ‘Young Men’s Theistic Association’ কোচবিহারের সামাজিক অগ্রগতিকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পেরেছিল। সামাজিক মূল্যবোধ, ব্রাহ্ম নীতির প্রচার, কৃষক ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন ছিল এই সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে অন্যতম।

অদ্বৈতবাদী তত্ত্ব বা ‘Monistic Theory’তে বিশ্বাসী যাঁরা তাঁরাই এই ‘Young Men’s Theistic Association’-এর সদস্য হতে পারতেন। একেবারে প্রথম থেকেই এই সংস্থা ব্রাহ্মধর্মের মূল লক্ষ্যে স্থির থেকে সমাজ সংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭: গৃহিণী সারদার প্রথম দক্ষিণেশ্বর আগমন

ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে তারাপীঠ পুণ্যভূমির পবিত্র নদী দ্বারকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

কোচবিহারের সর্বত্রই ব্রাহ্মবাদীরা বিশেষ সমাদৃত হতেন। মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের আমলে রাজ্যে উচ্চশিক্ষা প্রসারের মূল দায়িত্ব তাঁদের ওপরেই ন্যস্ত ছিল। এ বিষয়ে আবার মহারানির বিশেষ নজর ছিল। বিভিন্ন সময় বাংলার নানা প্রান্তের ব্রাহ্মবাদী বুদ্ধিজীবীরা আমন্ত্রিত হতেন। তবে শুধূ শিক্ষা নয়, রাজ্যের অন্যান্য দপ্তরের উচ্চপদেও এঁদের অনেকেই আসীন ছিলেন

রাজ্যের দেওয়ান কালিকা দাস দত্ত, প্রিয়নাথ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ সেন ও একাউন্টেন্ট জেনারেল অমৃতলাল সেন কোচবিহার রাজ্যের আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিলেন। রাজ্যে ব্রাহ্মধর্ম ও সাংস্কৃতিক দর্শন প্রসারের লক্ষ্যে প্রচার মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। রামচন্দ্র সিংহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল ‘সুকথা’ নামে একটি পত্রিকা। এই পত্রিকাই পরবর্তীকালে কোচবিহারে বৌদ্ধিক ও সামাজিক নবজাগরণের দূত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

১৮৭৮ সালে মার্চ মাসের সেই বিশেষ মধ্যরাত পেরিয়ে বিলম্বিত লয়ে যে কন্যার বিবাহ হয়েছিল, তাঁর পিতার বাসস্থান বহু দূরের হলেও সেই সময়ের রাজ পরিবার ও এক রাজ্যের নবজাগরণের পরোক্ষ নিয়ন্তা সেই কন্যা ও পিতা।তাঁদের হাত ধরে যেমন উন্নত কোচবিহার, তেমনি মহারাজার কৃতিত্ব ও সাক্ষরিত হল।

এখনো কোচবিহারবাসী সেই মাহেন্দ্রক্ষণের দিকে যদি ফিরে তাকান, মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণ, মহারানি সুনীতি দেবী, রাজ পরিবার ও দ্বিধা বিভক্ত ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হন, সেইসঙ্গে কেশবচন্দ্র সেনকেও প্রণাম জানান। যাঁর একটি সম্মতি সেদিন একটি বিবাহ শুধু নয়, কোচবিহার নামের সেই সময়ের এক অভিজাত রাজ শহরের নবজাগরণ ঘটিয়েছিল।—চলবে।
* মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস। সাহিত্যিক ও কবি। কোচবিহার সুনীতি অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষিকা। www.samayupdates.in -এ লিখছেন ‘কোচবিহারের রাজকাহিনি’। একাধিক উপন্যাস, ছোটগল্প সংকলন, প্রবন্ধ সংগ্রহ ও কাব্যগ্রন্থ রয়েছে লেখিকার।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content