রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


কামতেশ্বরী মন্দির। ছবি: লেখক।

বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শাক্তকেন্দ্রগুলির মধ্যে কোচবিহার অন্যতম। পূর্বে উল্লিখিত খেন রাজাদের পারিবারিক উপাস্য দেবী হলেন কামতেশ্বরী। যাকে এই অঞ্চলের এক অন্যতম প্রাচীন দেবীরূপেও গণ্য করা হয়। প্রথম খেন রাজা নীলধ্বজ সর্বপ্রথম নিজ সাম্রাজ্যের রাজধানী অধুনা গোসানিমারির গড় বা দূর্গ অঞ্চলে এই কামতেশ্বরী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদিও আনুমানিক ১৪৯৩ সালে হোসেন শাহের কামতা আক্রমণকালে তা ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। পরবর্তীতে কোচ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহের আমলে দ্বিতীয়বার কামতেশ্বরী দেবীর মন্দির পুনর্নির্মীত হয়। কিন্তু কালাপাহাড় ও মীরজুমলার অভিযানকালে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে তা পুনরায় ধূলিসাৎ করা হয়।
এখনকার সৌধটি কোচ মহারাজা প্রাণনারায়ণের সক্রিয় উদ্যোগে ১৬৬৫ সালে নির্মীত। কামতেশ্বরী দেবীর এই সর্বশেষ পুনর্গঠিত নতুন মন্দিরটি কোচবিহারের দিনহাটার অন্তর্গত গোসানিমারীর গড় বা দূর্গ অঞ্চল থেকে প্রায় ১.৫ কলমিটার দূরত্বে অবস্থিত। মন্দিরটি সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা চতুর্দিকে বেষ্টিত, যার দুটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমদ্বারটি প্রধান। মূল মন্দিরটির চতুর্পার্শ্বে ঐস্লামিক মিনার সদৃশ গম্বুজ সমন্বিত চারটি ক্ষুদ্রায়তন দেবমন্দির বিদ্যমান।

মন্দিরগুলিতে বিষ্ণু, তারকেশ্বর শিব, ভৈরবী, লক্ষ্মী-সরস্বতী ও শিবলিঙ্গ উপাস্যরূপে পূজিত। অনুপম স্থাপত্যটিকে নিঃসন্দেহাতীতভাবে এই অঞ্চলের একটিমাত্র উল্লেখযোগ্য পঞ্চায়তন মন্দিররূপে গণ্য করা যায়। তাছাড়া মূল মন্দিরের সংলগ্ন ভোগঘর, হোমঘর এগুলিও স্থাপত্যগতভাবে অনন্যতার স্বাক্ষর রাখে।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-২: ভারতের স্থাপত্যশৈলীতে ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিব মন্দিরের অবদান অপরিসীম

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৬: ঐতিহাসিক বিরল বিবাহ ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া

মন্দিরের নিত্যপুজোর বংশানুক্রমিকভাবে দায়িত্বে রয়েছেন মৈথিলি ‘ঝা’ পদবিপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণগোষ্ঠী। বছরের বিভিন্ন সময়ে এখানে দেবী কামতেশ্বরীর পুজো উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে বহু ভক্তের সমাগম হয়। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সমগ্র বৈশাখ মাসের বিশেষ পুজো ও দুর্গাপুজোর সময় মহিষবলিকে কেন্দ্র করে ভক্তবৃন্দের জোয়ার পরিলক্ষিত হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোচবিহারের বহু মন্দিরে রাজ আমল থেকেই বিভিন্ন বিশেষ তিথিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রাণীর (যেমন মহিষ, ছাগল, পায়রা, মোরগ ইত্যাদি) বলিপ্রথা সাড়ম্বরে পালিত হয়। সেই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জনজোয়ারও ঘটে। কিছু ক্ষেত্রে ছোটখাট মেলাও বসে যায়। যেমন দুর্গাপুজোর সময় প্রায় পঞ্চশতাব্দী প্রাচীন কোচরাজদের অন্যতম আরাধ্যা বড়দেবী পাটদেহড়ার মহাষ্টমীর পুজো।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১০: ধনু হেসে বলে, শর, জান না সে কথা—আমারি অধীন জেনো তব স্বাধীনতা

মূল মন্দিরটি বর্গাকার গঠনাকৃতি বিশিষ্ট। আনুমানিক ৪৫ ফুট উচ্চতাসমন্বিত এই দেবায়তন একটি সিঁড়ি সমন্বিত প্রায় ২.৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এক নাতিউচ্চ প্ল্যাটফর্মের ওপর প্রতিস্থাপিত। স্থাপত্য শব্দকোষ অনুযায়ী যাকে ‘জগতি উইদ অধিস্থান’ (Jagati with adhiṣṭhāna) বলা হয়। জগতি গুপ্তযুগ থেকেই মন্দির স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যরূপে স্বীকৃত। এরই পাশাপাশি এই অনুপম স্থাপত্যটির আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আমার চোখে পড়েছে। যেমন: মূল মন্দিরের পাশ্ববর্তী ক্ষুদ্রায়তন তারকেশ্বর শিব দেউলটির ভিতরের দেওয়ালে বেশ কিছু গঠনাকৃতির কুলুঙ্গির উপস্থিতি [অর্ধবৃত্তাকার, যোগী আর্চ (Ogee arch) বা তীক্ষ্ণ খাঁজকৃতি], যা আলোচ্য স্থাপত্যে ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর প্রভাবকে সুনিশ্চিত করে। কারণ এই বিশেষ ধরণের (Ogee arch) কুলুঙ্গি সর্ব প্রথম মরক্কোর স্থাপত্যে লক্ষিত হয়। যদিও ভারতে এই বিশেষ স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যটি মূলত মুঘল যুগ থেকে প্রয়োগ এবং জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৩: কানে ব্যথা? তেল দেবেন কি?

মূল মন্দিরের চূড়াটি পেয়াঁজাকৃতির গম্বুজ দ্বারা সজ্জিত, যা পুনরায় আরেকটি ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যরূপে স্বীকৃত। মূল মন্দিরটির চূড়ার ঠিক নিম্নের অংশটি স্থাপত্যশব্দকোষ অনুযায়ী যাকে বেকি (beki) বলা হয়, সেটি দেখতে অনেকটা বাঁকানো বাঁশসদৃশ যেটির নিম্নে বেশ কিছু বহুখাঁজবিশিষ্ট কৃত্রিম দ্বার তথা বাতায়নের অলঙ্করণ লক্ষিত হয়। প্রধান তোরণদ্বারে এমন বহুখাঁজবিশিষ্ট অলঙ্করণসমৃদ্ধ কৃত্রিম দ্বার তথা বাতায়নের উপস্থিতি সুনিশ্চিতভাবে আলোচ্য স্থাপত্যে ইসলামিক মুরিশ স্থাপত্যশৈলীর গভীর প্রভাবকে প্রমাণিত করে।

মন্দিররের প্রধান উপাস্য তথা অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন, দেবী কামতেশ্বরী। যাকে একটি কবচের মাধ্যমে আরাধনা করা হয়। যদিও দুঃখজনকভাবে সেই উপাস্য পবিত্র কবচটি ১৯৬৪ সালে চুরি হয়ে যায়। সব শেষে এটা বলা যেতে পারে যে, কোচ স্থাপত্যের একটি যথার্থ বিমিশ্র স্থাপত্যশৈলীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্বরূপ কামতেশ্বরী মন্দির এক বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছে।—চলবে।
* মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ (Temples in North Bengal): অর্ক আচার্য (Arka Acharjee), অধ্যাপক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়, কোচবিহার। লেখকের গবেষণার বিষয়: ‘Origin and Development of Unique and Composite type of Temple Architecture from 16th to 19th Century in the Northern Region of Bengal.’

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content